এনআরসি: বিদেশী বানানোর আতঙ্ক by হার্শ মান্দের

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েল একটি ছোট নির্দেশ (দুই পৃষ্ঠারও কম) ভারতকে চিরদিনের জন্য বদলে দেয়ার, দেশটির সবচেয়ে অরক্ষিত কোটি কোটি মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়ার, ভারতের সংবিধানের মূল কাঠামো ধ্বংস করার, প্রজাতন্ত্রের মৌলিক নীতিমালা বদলে দেয়ার ভয়াবহ আশঙ্কা বহন করছে। গত ৪ জুন গ্যাজেটে প্রকাশিত এ নির্দেশ ভারতের যেকোনো অংশে যেকোনো রাজ্য, কেন্দ্রীয় ভূখণ্ড বা জেলা মেজিস্ট্র্যাটকে ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল’ প্রতিষ্ঠার কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই শক্তি কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের রয়েছে এবং তা বিশেষভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে আসামে।
পার্লামেন্টে বিতর্ক তো দূরের কথা কোনো ধরনের প্রকাশ্য আলোচনা ছাড়াই সামাজিক বিরোধে ইন্ধন সৃষ্টির ও ভারতের সাংবিধানিক ব্যবস্থা বদলে দেয়ার শঙ্কাময় এই আদেশটি জারি করা হয়েছে। এই আদেশ জারির ব্যাখ্যা কেবল পাওয়া যেতে পারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নির্বাচনী বক্তৃতাবাজিতে। তিনি ওই সময় বারবার বলেছেন, ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ চিহ্নিত করার জন্য ভারতের সব অংশে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) প্রয়োগ করা হবে।
এনআরসি প্রক্রিয়ায় অবিচারের মূলে রয়েছে প্রমাণ করার বোঝায় বৈপরিত্য। বেশির ভাগ অপরাধের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রসিকিউশন যতক্ষণ না তার অপরাধ প্রমাণ করতে পারবে, ততক্ষণ ওই লোক নির্দোষ। কিন্তু এখানে প্রমাণ করার দায়দায়িত্ব বর্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির। কেউ যখন প্রয়োজনীয় নথি আদালতে উপস্থাপন করতে না পারে, তখন তাকে বিদেশী ঘোষণা করা হয়ে যায়। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ভারতের সর্বোচ্চ আদালতই প্রমাণ করার দায়দায়িত্ব ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
আসামের এনআরসি লাখ লাখ লোককে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে গরিব মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে, তারা তাদের অতি সামান্য সম্পদও আইনজীবীদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে যাতে তারা এনআরসির আমলাতন্ত্রের বৈরিতার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে বাঁচতে পারে।
আমি এমন শত শত মামলা দেখেছি যেখানে ইংরেজি বা বাংলা নামের বানানে সামান্য ভুল বা বয়সের সামান্য হেরফেরের কারণে এনআরসি কর্তৃপক্ষ ও ফরেনার্স ট্রাইনাল তাদেরকে বিদেশী হিসেবে দণ্ডাদেশ দিয়ে দিয়েছে। আপনি যদি স্কুলে না গিয়ে থাকেন, তবে আপনার নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণপত্র নেই। আপনার যদি ভূমি না থাকে, তবে ভারতে আপনার অবস্থানের রেকর্ড থাককে কিভাবে। আবার নিজের জায়গা থাকলেও তাতে ভুলের কারণেও খেসারত দিতে হতে পারে।
এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আদেশে এনআরসি ও ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল সারা দেশে চালু হলে কী ঘটতে পারে, কল্পনা করুন। আমি দেশের সুদূর প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুসলিমদের উদ্বেগে তাদের নথিপত্র পরীক্ষা করার কথা শুনেছি। নথিগুলোতে ইংরেজি বানানে দাদার নামের পার্থক্য থাকলে কী করতে হবে, সেই চিন্তায় তাদের ঘুম নেই। আগামী মাসগুলো বা বছরগুলোতে ভারতের অন্যান্য অংশেও যদি এনারসি সম্প্রসারিত হয়, তবে আবার ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি ফিরে আসতে পারে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সারা ভারতে প্রতিষ্ঠিতব্য ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালকে তাদের সামনে আসা মামলাগুলো শুনানির নিজস্ব প্রক্রিয়া নির্ধারণের দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। তারা কেবল ‘মেরিট’ থাকলেই আপিল শুনানিতে রাজি হতে পারে, এমন ক্ষমতাও তাদের দেয়া হয়েছে। এর মানে হলো, সংস্থাটি ‘মেরিট’ আছে বলে মনে না করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আপিলই করতে পারবেন না। অথচ আসামের ট্রাইব্যুনালগুলোতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করা কিংবা প্রকাশ্যে পক্ষপাতিত্ব করার অনেক অভিযোগ এসেছে। এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশের ফলে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল আরো বেশি শক্তি পেয়ে খামখেয়ালিভাবে তাদের কাজ করতে পারে।
আসামের এনআরসি প্রক্রিয়ায় সংবিধানের সবচেয়ে বড় লঙ্ঘন ঘটেছে এ নিয়ে যে কেন্দ্রীয় সরকার এখন পর্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেনি যে যাদেরকে চূড়ান্তভাবে বিদেশী বলে ঘোষণা করা হবে, তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে। এসব লোকের ভাগ্যের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে এখন পর্যন্ত বাধ্য করতে পারেনি পার্লামেন্ট বা সুপ্রিম কোর্ট।
ভারত সরকার যাদের বিদেশী হিসেবে ঘোষণা করবে, তাদেরকে বাংলাদেশের গ্রহণ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, তারা বাংলাদেশী নয়। বর্তমানে হাজার হাজার লোক আটক কেন্দ্রে বন্দী অবস্থায় রয়েছে। আসাম সরকার জানিয়েছে, তারা তিন হাজার বিদেশীর জন্য আটক কেন্দ্র নির্মাণ করছে। কিন্তু ভারতের বিচার ব্যবস্থা যদি আসামের লাখ লাখ লোককে অনাগরিক ঘোষণা করে, তবে কী হবে?
আর ভারতের বাকি অংশেও যদি এনআরসি বাস্তবায়ন করা হয়, তবে আরো লাখ লাখ লোকের নাম আসবে। তাদের আটক রাখার জন্য ভারত সরকার কি বিশাল বিশাল আটক কেন্দ্র নির্মাণ করবে? করা হলে কত দিনের জন্য করা হবে? নারী, পুরুষ ও শিশুরা সারা জীবনের জন্য আটক থাকবে? নাকি তাদের আটক কেন্দ্রের বাইরেই রাখা হবে সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে? তাদের চাকরি করার, সম্পত্তি লাভের, সরকারি সেবা পাওয়ার অধিকার থাকবে না? এমনকি আরএসএস যাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানাতে চায়, এসব লোকের অবস্থা তাদের চেয়েও খারাপ হবে?
তারা হবে অনাগরিক, চিহ্নিত লোক, ব্যাপকভাবে বাদ পড়া ও ঘৃণিত। এটা কি এমন নির্দেশিকা, যা ভারতকে আবার টুকরা করে ফেলতে পারে?
লেখক : মানবাধিকারকর্মী ও লেখক

No comments

Powered by Blogger.