জরুরি সেবার গাড়ি টোলপ্লাজা পার হবে কীভাবে?

আমানুর রহমান রনি, চৌধুরী আকবর হোসেন ও এনায়েত করিম বিজয়, বাংলা ট্রিবিউনঃ বঙ্গবন্ধু সেতুর নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত হলেও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সেতুতে উঠতে দেওয়া হয়নি। টোলপ্লাজা জরুরি মনে করলেই কেবল ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সেতুতে উঠতে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী (বঙ্গবন্ধু সেতু) আহসানুল কবির পাভেল।
শনিবার (৮ জুন) সন্ধ্যায় তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ নম্বর থেকে তথ্য দেওয়া হলেও আমাদের কাছে আগুনের কোনও তথ্য ছিল না। তাই আমরা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি উঠতে দিইনি। তাছাড়া সেতুর নিরাপত্তার জন্যও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি উঠতে দেওয়া হয়নি।”
শুক্রবার (৭ জুন) বিকাল সোয়া ৩টার দিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর একটি চলন্ত বাসে আগুন লেগেছে, ‘৯৯৯’ নম্বর থেকে পাওয়া এমন খবরে ভূঞাপুর ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম ঘটনাস্থলে রওনা হয়। তবে সেতু কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসের ওই গাড়িটিকে সেতুতে উঠতে দেয়নি। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যাপক সমালোচনা হয়।
ফায়ার সার্ভিস একটি জরুরি সেবাদাতা সরকারি প্রতিষ্ঠান। সেখানে প্রশিক্ষিত মানুষ কাজ করেন। তারা কীভাবে সেতুর জন্য নিরাপত্তার হুমকি হয় জানতে চাইলে এর কোনও ব্যাখ্যা না দিয়ে প্রকৌশলী আহসানুল কবির পাভেল বলেন, ‘আগুনের খবরটি সত্য ছিল না। সেতুর ওপর-নিচে সিসি ক্যামেরা রয়েছে। আমরা সিসি ক্যামেরায় কোথাও সেতুর ওপরে কোনও বাসে আগুন দেখতে পাইনি। তাই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আমরা যেতে দিইনি। তাছাড়া, আমরা জরুরি মনে করিনি।’
ফায়ার সার্ভিসের জরুরি সেবার বিষয়টি টোলপ্লাজা নির্ধারণ করতে পারে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা জরুরি মনে করলে যেতে দিই। এর আগেও ইকোপার্কে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল, তখন ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি টোল-ফ্রি যেতে দেওয়া হয়েছে। সেদিন বাসের আগুনের তথ্য সঠিক ছিল না, তাই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে দেওয়া হয়নি।’
যেকোনও অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে সেখানে যাওয়ার পর ফিরে এসে একটি রিপোর্ট তৈরি করতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে। কিন্তু টোলপ্লাজা কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসকে ঘটনাস্থলেই যেতে দিলো না, এটা সরকারি কাজে বাধা কিনা জানতে চাইলে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘আমরা তাদের জানিয়েছি কোনও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি।’
ফায়ার সার্ভিস অভিযোগ করেছে, তাদের গাড়ি টোলপ্লাজায় প্রায়ই আটকে দেয়। এই অভিযোগ সত্য কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে আমরা নিজেরাই তাদের খবর দিয়ে থাকি। তাছাড়া আমাদের নিজেদেরও আগুন নির্বাপণের ব্যবস্থা রয়েছে।’ ফায়ার সার্ভিসের কোনও গাড়ি টোল-ফ্রি নয় বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা টোল না দেওয়ার জন্যই এই ঝামেলা করেছে। তারা টোল ছাড়া যেতে চেয়েছিল।’
আহসানুল কবির পাভেল আরও বলেন, ‘আগুন না লাগায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি টোল ছাড়া যেতে দেওয়া হয়নি। এ জন্য ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আমাদের টোলপ্লাজার লোকজনদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে। পরে তারা ইস্যু করলো যে আগুন নেভানো তাদের উদ্দেশ্য নয়, তাদের উদ্দেশ্য টোল ছাড়া সেতুতে যাবে। এই হলো বিষয়। ওই ঘটনার সময় তারা মোবাইল দিয়ে ভিডিও করে ফেসবুকে ভাইরাল করে।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সেতু হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ (কেপিআই) স্থাপনা। আমাদের নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম রয়েছে। আমরা যখন ব্যর্থ হই, তখন ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিই। আমরা তাদের ডাকিনি, তারা নিজেরাই এসেছিল। একটা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে তারা এসেছিল।’
জাতীয় জরুরি সেবা থেকে ফায়ার সার্ভিসকে বাসে অগ্নিকাণ্ডের যে তথ্য দেওয়া হয়েছিল তা সঠিক ছিল না বলে দাবি করেছেন টোলপ্লাজার কর্মকর্তারা।
ভূঞাপুর ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন মাস্টার ফেরদৌস মিয়া বলেন, “শুক্রবার বিকেল ২টা ৫৫ মিনিটে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ থেকে ফোন করে সেতুর ওপর উত্তরবঙ্গগামী শ্যামলী পরিবহনের একটি চলন্ত বাসে আগুন লাগার খবর দেওয়া হয়। এছাড়াও ‘৯৯৯’ থেকে এক ব্যক্তির ফোন নম্বর দেওয়া হয়। আমরা যোগাযোগ করলে তিনি আগুন লাগার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পরে তাৎক্ষণিক একটি টিম নিয়ে বের হয়ে সেতুর টোলপ্লাজার সামনে পৌঁছালে সেতু কর্তৃপক্ষ গাড়িটি আটকে দেয়। আগুন লাগার বিষয়টি জানালেও তারা গাড়িটি সেতুতে উঠতে দেয়নি। টোল ছাড়া টোলপ্লাজা অতিক্রম করা যাবে না, এমন কথা তারা জানিয়ে দেন।’
তিনি বলেন, ‘ওই সময় কয়েকজন পুলিশও টোলপ্লাজায় দাঁড়ানো ছিল। তারা জানান, রাষ্ট্রপতির গাড়ি ছাড়া আর কোনও গাড়ি টোল ছাড়া যেতে পারবে না। তারা একটি লিস্ট বের করে নিয়ে আসেন। ওই লিস্টে ফায়ার সার্ভিসের নাম নেই বলেও জানান। এ সময় সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা, সিকিউরিটি গার্ডসহ প্রায় ৮-১০ জন লোক আমাদের কর্মকর্তা ও কর্মীদের ওপর চড়াও হয়। পরে বিষয়টি ৯৯৯-এ জানালে তারা ফিরে যেতে বলেন। আমরা এরপর বিষয়টির আর খোঁজ নিতে পারিনি।’
ভূঞাপুর ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন মাস্টার আরও বলেন, ‘সেতু কর্তৃপক্ষও সরকারি কাজ করে, আমরাও সরকারি কাজ করি। তারা যদি যানমালের রক্ষা না করতে দেয় তাহলে তো আমাদের কিছু করার নেই। টোল দেওয়ার মতো আমাদের কোনও ফান্ড নেই। টোলের জন্য এর আগে বাংলাদেশের কোথাও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আটকানো হয়নি। এই প্রথম বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষ এই নজির সৃষ্টি করলো।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনা শোনার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আমরা গাড়ি নিয়ে বের হই। তখন আমাদের পকেটে টাকা আছে কিনা, সেই বিষয়টি খেয়াল রাখি না। যখন ওই ধরনের প্রিপারেশন এবং টোলপ্লাজাতেও সময় দিতে হবে, তখন কিন্তু আমাদের সময় অপচয় হবে। তখন দেখা যাবে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে গেছে।’
বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন দফতর থেকে ফোন করে অনেকে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বলেও তিনি জানান।
টাঙ্গাইল ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি টোল দিয়ে পারাপারের বিষয়ে আমাদের কোনও নির্দেশনা নেই। কোনও সেতুতে টোল দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পারাপার হয়েছে, এমন ঘটনা আমার জানা নেই। বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষ আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। বিষয়টি আমাদের দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। তারা বিষয়টি দেখবেন।’
বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোশারফ হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর গাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেনি। এটা ভুয়া তথ্য ছিল। এজন্য সেতু কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে দেয়নি।’

No comments

Powered by Blogger.