এডিবির পূর্বাভাস চলতি বছর প্রবৃদ্ধি হবে ৮ শতাংশ

চলতি অর্থবছরে (২০১৮-১৯) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবি মনে করে, ব্যাপক ভোগ চাহিদা ও সরকারি বিনিয়োগের কারণে এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। এ ছাড়া রপ্তানি ‘পারফরম্যান্স’ প্রবৃদ্ধিতে বাড়তি অবদান রাখছে। এর পাশাপাশি শিল্প খাতের সমপ্রসারণ প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
গতকাল এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক ২০১৯ প্রকাশ করেছে এডিবি। প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে আগারগাঁওয়ের এডিবি ঢাকা কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে পূর্বাভাস দেন এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ। আর মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিনিয়র অর্থনীতিবিদ সুন চান হং।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ।
তিনি বলেন, এশিয়ার অনেকগুলো উন্নয়নশীল দেশের চাইতে বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে আছে। তিনি বলেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে দ্রুতগামী। এ কারণে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে হলে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিমানবন্দর, সড়কের বড় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ধরে রাখতে আগামীতে শিল্পের ভিত্তি বাড়াতে হবে। ব্যক্তি খাতের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে হবে। করের ভিত্তি বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি খাতের চাহিদা মেটাতে মানব সম্পদের উন্নয়ন করতে হবে।
এর আগে গত ১৯শে মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছিলেন, চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.১৩ শতাংশ ছাড়াবে। আর এর প্রায় দুই সপ্তাহ পর এডিবি তার আউটলুক প্রকাশ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের কথা জানাল।
গত বছর এডিবি বলেছিল এবার প্রবৃদ্ধির হার হতে পারে ৭.৫ শতাংশ। সেই অবস্থান থেকে এডিবি সরে আসছে কেন জানতে চাইলে মনমোহন প্রকাশ বলেন, তাদের আগের হিসাব ছিল তিন মাসের তথ্যের ভিত্তিতে। এখন নয় মাসের তথ্যে দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি বদলে গেছে। তাছাড়া চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দ্বন্দ্বের কারণেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ কিছু পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। ফলে এ বিষয়টিও প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে বলে তিনি মনে করেন। মনমোহন বলেন, বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কম হলেও বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকবে।
প্রতিবেদনে এডিবি জানায়, ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসের পেছনে যেসব বিষয় কাজ করেছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবেশ শান্ত থাকা; রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ভালো প্রবৃদ্ধি, কর আদায়ে জোর দেয়া, বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি ও স্বাভাবিক আবহাওয়া বিরাজমান। এছাড়া অবকাঠামো খাতে সরকারের ধারাবাহিকভাবে চলা উন্নয়নে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। একই সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ৫.৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে জানানো হয়।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও বলেছে এডিবি। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংক খাতের আইনকানুন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন; করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্তে আরো সতর্কতা অবলম্বন; রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের একীভূত করা। উন্নতি ধরে রাখতে আগামীতে বিদ্যমান ব্যাংক আইনের কঠোর প্রয়োগ চেয়েছে এডিবি।
প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে এডিবি ঢাকা অফিসের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ সন চ্যাং হং বলেন, ১৯৭৪ সালের পর বাংলাদেশের জন্য এটা বড় অর্জন। ২০১৮ সালে ৭.৯ এবং ২০১৭ সালে ৭.৩ প্রবৃদ্ধি অর্জন দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ আরো উন্নত করা ও রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনা গেলে জিডিপি আরো বাড়বে। একই সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ৫.৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে জানানো হয়। কৃষি ফলন বৃদ্ধি, বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও তেলের দাম কম হওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ধরা হয়েছে ৩.৮ শতাংশ, শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হবে ১২.৫ ভাগ। তবে যানবাহন, শিক্ষা, আর্থিক খাত ও স্বাস্থ্য খাতের ধীরগতির কারণে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি ততটা এগুবে না। যা থাকতে পারে ৬.৪ শতাংশের আশেপাশে। এডিবির মতে, রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়াবে ১৪ শতাংশে। মূলত পোশাক খাতে রপ্তানির ওপর ভর করেই এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হবে।
সংস্থাটির মতে, গেল অর্থবছরে, দেশে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি হলেও ১০ শতাংশের মধ্যেই থাকবে। মূলত খাদ্যপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কম থাকায় ২০১৯-২০ অর্থবছরেও দেশে আমদানির পরিমাণ কমবে। এডিবি জানায়, চলতি অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয় বাড়বে ১১ শতাংশ হারে। তবে এর পরের অর্থবছরে তা একই ধারায় না থেকে নেমে আসবে ১০ শতাংশের ঘরে।
টেকসই উন্নয়নের এ ধারায় বেশকিছু চ্যালেঞ্জও দেখছে উন্নয়ন সহযোগী এ সংস্থা। এর মধ্যে আছে, ব্যাংক খাতে বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ ও দুর্বল শাসন ব্যবস্থা। বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ব্যাংকিং খাতের অব্যবস্থাপনা আগামীতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করে এডিবি। এ ছাড়া বিনিয়োগের তুলনায় লাভের হার কম। এখানে সুশাসন ব্যবস্থাও দুর্বল। এর ফলে বাড়ছে মূলধন ঘাটতির প্রবণতা। ব্যাংকিং খাতে পরিচালনায় ও আইনি কাঠামোয় বড় ধরনের অদক্ষতা রয়েছে বলেও মনে করে এডিবি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতায় নেয়া আগের অনেক উদ্যোগ সফল হয়নি। ব্যাংক আইন সংশোধন, ব্যাংকে বিশেষ নিরীক্ষা ও ঋণের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গাইড লাইনে কিছুটা সফলতা এসেছে। উন্নতি ধরে রাখতে আগামীতে বিদ্যমান ব্যাংক আইনের কঠোর প্রয়োগ চেয়েছে এডিবি। তা ছাড়া করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ঋণের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা যাচাই করা, সরকারি ব্যাংকে একীভূতকরণের মতো উদ্যোগ বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে এডিবি। জাতীয় পর্যায়ে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলারও পরামর্শ দিয়েছে এডিবি।

No comments

Powered by Blogger.