২৮ বছরে বিদেশে ৭ লাখ নারী শ্রমিক: জীবন বদলায় না কপাল পোড়ে

নিয়তি বদলাতে চেয়েছিল ওরা। নিজের এবং পরিবারের। কারো কারো যে জীবন বদলায়নি তা নয়। তবে বেশির ভাগেরই কপাল পুড়েছে। নাম আলাদা। কিন্তু কাহিনীগুলো একই। অনেকে শিকার হয়েছেন যৌন নিপীড়নের। দিনের পর দিন ধর্ষিত হয়েছেন তারা।
শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়াদের তালিকাও দীর্ঘ। পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেয়া হয়েছে কারো। কারো শরীরে ঢেলে দেয়া হয়েছে গরম পানি ও তেল। মানসিক নির্যাতন একেবারে মামুলি ব্যাপার। দেশে ফিরেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন কেউ কেউ। তাদের অনেকের বাড়িতে ফেরার মতো পরিস্থিতি থাকে না। কারো সংসার ভাঙছে। কেউ কেউ লোকলজ্জার ভয়ে ঘরের বাইরে বের হন না।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে চলতি বছরের প্রথম আট মাসে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন দেড় হাজার নারীকর্মী। একই সংস্থার জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত গত ২৮ বছরে বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিক গেছে ৭ লাখ ৬৩ হাজার ৫২ জন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত যাওয়া-আসা করে মোট ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩শ’ ৬৭ জন নারী।
সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, ইতালি, হংকং, সাইপ্রাস, ব্রুনাই ও মরিশাসসহ বিভিন্ন দেশে গেছেন এসব শ্রমিক। এরমধ্যে আড়াই লাখই গেছেন সৌদি আরবে। এ ছাড়া জর্ডানে এক লাখ ৩৩ হাজার, আরব আমিরাতে এক লাখ ২৭ হাজার, লেবাননে এক লাখ চার হাজার, ওমানে ৬৯ হাজার, কাতারে ২৭ হাজার এবং মরিশাসে ১৬ হাজার নারী গেছেন। জর্ডান ও লেবাননে পোশাক কারখানায় কাজ করতে যাওয়া অধিকাংশ নারী শ্রমিক ভালো অবস্থায় আছেন, এমন তথ্য নানাভাবেই মিলছে। এর বাইরে অন্য দেশগুলোয় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া অনেকেই ভালো নেই। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সৌদি আরবে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালে অভিবাসী নারীর সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯২৫ জন, যা মোট অভিবাসনের ১৩ শতাংশ এবং এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ১৯৯১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত অভিবাসন প্রত্যাশী নারী শ্রমিককে অভিবাসনে যেতে বাধা দেয়া হলেও ২০০৩ এবং ২০০৬ সালে তা কিছুটা শিথিল করা হয়। ২০০৪ সালের পর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নারী শ্রমিকের অভিবাসন হার ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় মোট অভিবাসনের ১৯ শতাংশে। তবে ২০১৬ সালে অভিবাসী নারী শ্রমিকের সংখ্যা নেমে আসে ১৬ শতাংশে এবং ২০১৭ সালে ১৩ শতাংশে।
বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের ৩রা মে ৩৫ জন, ১২ই মে ২৭ জন, ১৯শে মে ৬৬ জন, ২৩শে মে ২১ জন, ২৭শে মে ৪০ জন এবং ৩রা জুন ২৯ জন, ১৮ই জুন ১৬ জন এবং ১৯শে জুন ২৭ জন, ২৬শে জুন ২২ জন, ১০ই জুলাই ৪২ জন, ২১শে জুলাই ৩৪ জন, ২৮শে জুলাই ৪২ জন, ৩রা আগস্ট ২৮ জন, ১৪ই সেপ্টেম্বর ৬৫ জন, ১৯শে সেপ্টেম্বর ৪২ জন, ২৩শে সেপ্টেম্বর ৪২ জন নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। তবে এর বাইরেও আরো নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়।
ব্র্যাকের জরিপে বলা হয়, প্রায় দশ বছর আগে সৌদি আরব প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। ততোদিনে জর্ডান, লেবাননসহ আরো কিছু জায়গায় গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া বাংলাদেশি মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হয়। সাত বছর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরব যখন বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী চাইলো তখন বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি জানানো হয়। ওই সময় বলা হয়, সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া ইন্দোনেশীয়, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের কারণে ওই দেশগুলো যখন তাদের নারীদের সৌদি আরবে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে ঠিক তখনই বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে দেশটি। তখন নারীদের বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি একেবারে বন্ধ না হলেও কিছুটা গতি হারায়। এভাবে কাটলো আরো চার বছর। তারা বারবার চাপ দিতে থাকে বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী দিতে হবে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সৌদি আরবের শ্রম মন্ত্রণালয়ে উপমন্ত্রী আহমেদ আল ফাহাদের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে। তাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। ১২০০ রিয়াল থেকে ১৫০০ রিয়াল বেতনের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত ৮০০ রিয়ালেই (১৬ হাজার ৮০০ টাকা) গৃহকর্মী পাঠাতে রাজি হয় বাংলাদেশ।
মানবাধিকারকর্মীরা সে সময় বারবার সতর্ক করলেও কেউ কথা শোনেনি। মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সারা দেশে দালালরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ২০১৫ সালে ২১ হাজার নারী শ্রমিক পাঠানো হয়। ২০১৬ সালে ৬৮ হাজার। আগে ২৯টি তালিকাভুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সি পুরুষ কর্মী পাঠাতো। নারীকর্মী পাঠানোর অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা ২০১৫ সালে রাতারাতি বেড়ে ৫৫৯টি হয়। প্রতিটি রিক্রুটিং এজেন্সিকে এখন নারীকর্মী পাঠাতে হয়।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, বিদেশে যাওয়া অনেক নারীই ভালো আছেন সেটা সত্য। আবার অনেক নারী যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন সেটা কী করে অস্বীকার করা যায়। আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তো সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায় না। সৌদি আরবে যদি একটা মেয়েও নির্যাতিত হয়ে কাঁদে সেই কান্না কী পুরো বাংলাদেশের নয়? মেয়েদের বিদেশে পাঠানোর বিপক্ষে আমরা বলছি না। কিংবা তাদের বিদেশ যাওয়ার ভিসা বন্ধ করার পক্ষেও বলছি না। তাতে বরং নারীদের পাচার হওয়ার ঝুঁকিটা বেড়ে যায়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের দারিদ্রতা। বিদেশ ফেরত নারীরা সাধারণত ৪ ধরনের অভিযোগ করে থাকেন। খাবার সংকট, শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন ও বেতন পান না। এক্ষেত্রে বিদেশে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। একইসঙ্গে গৃহকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়াটাও জরুরি। নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসা নারীদের ব্র্যাকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার বা তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত তারা যেনো কোনো প্রকার বিপদে না পড়ে। দ্বিতীয়ত বিপদ পরবর্তী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। দেশেই তাদের কাজের ব্যবস্থা করা। একইসঙ্গে নারীদের বিদেশ পাঠাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। আমাদের মেয়েরা বিদেশে কাজ করতে যাক, তবে সেটা গৃহকর্মী না হয়ে অন্যকিছু হলে ভালো হয়। বিশেষ করে পোশাক খাত বা অন্য কোনো কাজে। তারপরেও সরকার যদি পাঠাতে চায় তাহলে তাদের পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি যারা নির্যাতন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। অন্তত একটি মামলা হলেও হোক। দূতাবাসগুলোতে জনবল দেয়া হোক। নিয়মিত তারা নজরদারি করুক।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় ৮০ লাখ লোক বিদেশে আছেন। যার মধ্যে কয়েক লাখ হচ্ছেন নারী শ্রমিক। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী নির্যাতন বন্ধে সরকারের উদ্দেশ্যে বলতে চাই নারী গৃহকর্মীদের বিদেশ পাঠানোর আগে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের ওপর যে নির্যাতন করা হচ্ছে তা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। অতএব সরকারকে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, আমাদের দেশের নারীদের অনেকেই জানে না যে, প্রতিদিন অনেক নারী অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে আসছে। এ বিষয়ে নারীরা সচেতন না। শহরাঞ্চলে যারা পত্রপত্রিকা পড়েন তারা ছাড়া পুরো বিষয়টি আর কেউই জানেন না যে, চাকরির নামে নারীরা এরকম মর্মান্তিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান বলেন, আমি মনে করি নারী গৃহকর্মীদের সৌদিতে পাঠানো একেবারে বন্ধ করে দেয়া উচিত। নারী শ্রমিকদের নির্যাতনের বিষয়টা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সেক্রেটারি জেনারেল শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, আমাদের দেশ থেকে মাসে প্রায় ১১ হাজার নারীকর্মী বিদেশে যান। সেই হিসেবে প্রত্যেক দিন সাড়ে ৪শ’ থেকে ৬শ’ নারীকর্মীর ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স হয়। যার ৯০ ভাগই সৌদি আরব যায়। এত নির্যাতনের পরেও নারীকর্মীরা কেনো সৌদি যেতে আগ্রহী বা যায়। এখানে কোথাও একটা গোলমাল রয়েছে। কর্মী বিদেশ থেকে দেশে ফেরত আসবে- এটাই নিয়ম। কিন্তু কেনো বা কি কারণে ফেরত আসছে নির্যাতিত হয়ে নাকি স্বেচ্ছায় সেটা চিহ্নিত করতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের দেশে গবেষণা হওয়া জরুরি। এদের মধ্যে কেউ শারীরিক অসুস্থতার কারণে, কেউ ভিসাগত জটিলতার কারণে, মানসিক কারণে এবং কেউ কেউ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসছেন। আমাদের পয়েন্ট আউট করতে হবে কারা কি ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তারা কীভাবে বিদেশে গেছেন। কোন মালিক বা কোম্পানির কাছে গেছেন এগুলো চিহ্নিত করতে হবে।
এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক প্রশাসন জহিরুল ইসলাম বলেন, সরকারি খরচে বর্তমানে প্রায় ৬ লাখ নারীকর্মী বিদেশে আছেন। এক্ষেত্রে কিছু নারী নির্যাতনের শিকার হলেও সব নারীই যে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরেন- এটা ঠিক না। দূতাবাসে কথা বলে জেনেছি তাদের মধ্যে এক ধরনের হোম সিকনেস কাজ করে। ভিন্ন ও নতুন পরিবেশে গিয়ে অনেকেই মানিয়ে নিতে পারেন না। পক্ষান্তরে নিয়োগকর্তা বা মালিক যেমন সার্ভিস প্রত্যাশা করেন তেমনটা হয়তো পান না। এটা হতে পারে তার ভাষাগত সমস্যা ও সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবে। এক্ষেত্রে আমাদের অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনা যে দায়ী নয়, সেটাও বলা যাবে না। আমাদের ব্যবস্থাপনাকে আরো বেশি শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি কর্মীদের প্রশিক্ষিত করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.