বৈচিত্র্যময়তার অনন্য বিন্যাস ‘ঊর্মিমুখর’

মানুষ যা পায়, তা নিয়ে সে কখনোই সন্তুষ্ট থাকে না। তাই সে নিজেকে প্রতিনিয়ত অতিক্রম করতে চায়। মানুষ নিজেকে নিয়ে আত্মতৃপ্ত নয়, তার বড় প্রমাণ হলো শিল্প। কথাগুলো অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর। সত্যিই শিল্পী তার শিল্প নিয়ে নিমগ্ন থাকেন নিরন্তর। আর সেই চর্চা তাকে নিয়ে যায় পরিবর্তন আর পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে উৎকর্ষতার চূড়ায়। কিন্তু একজন শিল্পীর কাছে তার প্রথম শিল্পকর্মের প্রদর্শনী আবেদন একেবারেই অন্যরকম। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে হয় একজন শিল্পীর একক প্রদর্শনী সেই শিল্পীর জীবনে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিষয়।  বৈচিত্র্যময়তার অনন্য বিন্যাসের সমাহার খুঁজে পাওয়া যায় ‘ঊর্মিমুখর’ প্রদর্শনীতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস থেকে ইলাস্ট্রেশনে গ্র্যাজুয়েট তমা সাহার রঙের নানা মাধ্যম ফুটিয়ে তুলেছেন তিরিশের অধিক ছবিতে। শিল্পীর আঁকা একেকটি ক্যানভাস যেন কথা বলে একেকটি গল্পের; একেকটি মাধ্যমের। একেকটি ছবি যেন কথা বলে এককটি প্রস্ফুটিত শিল্পের। শিল্পীর আঁকা আন্দামান সিরিজের তিনটি ছবি তিনরকম প্রকাশ। বিলয় আন্দামান, বুদ্ধা আন্দামান আর মিস্ট্রি অব আন্দামান। আন্দামানের ত্রিমাত্রিক প্রকাশ এই ছবিগুলো। অন্যদিকে পেন্সিলে স্কেচে করা স্টিল লাইফের অনন্য প্রকাশ দেখা যায় কম্পোজিশন, ল্যাজিনেস বা ইনানিমেটেড লাইফ-এ। যেখানে যান্ত্রিক জীবন আর চলমান জীবনের নানা মাত্রিক প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। দেব দেবীর মুখ আমাদের কাছে অতি পরিচিত। কিন্তু শিল্পী তমা সাহা সেই পরিচিত মুখগুলোকেই শিল্পীর চোখে নিয়ে এসেছেন ভিন্নতা। তার প্রকাশ আমরা দেখি এনচান্টিং শঙ্করী-১, এনচান্টিং শঙ্করী-২, লর্ড গজানন-১, লর্ড গজানন-২-তে। ফ্রয়েডিয় মনস্তত্ত্বে আমরা স্বপ্নের নানা ব্যাখ্যার কথা জেনেছি। কিন্তু একজন শিল্পী তার রং তুলির মাধ্যমে স্বপ্নের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়েছেন। শিল্পী তার ড্রিম অব ডল-১, ড্রিম অব ডল-২, ড্রিম অব ডল-৩, ড্রিম অব ডল-৪-এ স্বপ্নের ভিন্নতা নিয়ে হাজির হয়েছেন। আবার মিশ্র মাধ্যমের আলগেই-১২, আলগেই-২, আলগেই-৩, আলগেই-৪ কথা বলে জীবনের নানা বৈচিত্র্যময়তার।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে তমা সাহার প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী ‘ঊর্মিমুখর’-এর সাতদিনের আযোজনের সূচনা লগ্ন যেন প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর হয়ে উঠেছিল শিল্পবোদ্ধাদের উপস্থিতিতে। 
প্রদর্শনীতে প্রধান অতিথি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, আমরা সাধারণ মানুষ যা দেখি শুধু সেটাই কল্পনা করি, তার বাইরে করতে পারি না। কিন্তু যারা শিল্পী, তারা পৃথিবীর বাইরের কোনো পরাবস্তু নিয়ে কল্পনা করে শিল্পের মাধ্যমে তা উপস্থাপন করতে পারে। তমার সেন্টলেস ব্লু ক্লিটোরিয়া-২ তেমনই একটি ছবি। শিল্পের নিরলস সাধনা না থাকলে সেটা সম্ভব না। আর পেইন্টিং হচ্ছে সকল সুন্দরের প্রতিফলিত রূপ। চিত্রশিল্পী তমা সাহা তেমনই একজন শিল্পী, যিনি তার নিজস্ব কল্পনা দিয়ে প্রকৃতির সকল সুন্দরের প্রতিচ্ছবি দেখাতে পারেন।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি শিশু-সাহিত্যিক, সংগঠক আলী ইমাম বলেন, যন্ত্রণা না থাকলে সে শিল্প পরিণত হয় না। বিপর্যস্ত অবস্থায় একজন শিল্পী তার শ্রেষ্ঠ শিল্পকাজ তৈরি করতে পারেন। তমা সাহার আঁকা ছবির ভূয়সী প্রশংসা করে তাকে কিঞ্চিৎ যন্ত্রণাদগ্ধ হবার কথাও জানান তিনি।
নিজের প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী নিয়ে তমা সাহা বলেন, শিল্প মানেই তো আনন্দ অথবা যা মানুষকে আনন্দ দেয় সেটাই তো শিল্প। আর একজন শিল্পীর জীবন তখনই ‘শিল্পীত’ হয় যখন তার শিল্পকর্ম সবার সঙ্গে উপভোগ্য হয়। আমার যত আনন্দ আর বিস্ময়, সেটা সবার সঙ্গে উপভোগ করার জন্যই ‘ঊর্মিমুখর’।
উদ্বোধনী আয়োজনে আরো উপস্থিত ছিলেন, কার্ডিয়াক সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর কবির, মীর মামুনসহ চিত্রশিল্প বোদ্ধারা। তমা সাহার একক চিত্র প্রদর্শনী ‘ঊর্মিমুখর’ চলবে ১০ই অক্টোবর পর্যন্ত। প্রদর্শনী বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.