কেন এই পরাজয়? by পিন্টু আনোয়ার

আরেকটি ফাইনাল। আরেকটি শেষ বলের বেদনা। ফিরে এলো নিদাহাস ট্রফি এবং ২০১২ ও ২০১৬’র এশিয়া কাপের স্মৃতি। দুবাইয়ে এবারের এশিয়া কাপের ফাইনালে অন্যরকম এক বাংলাদেশকেই দেখতে পেয়েছে ক্রিকেট বিশ্ব। ফাইনাল খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টাইগারদের লড়াকু ও আত্মবিশ্বাসী ক্রিকেট চোখে পড়েছে সবারই। কিন্তু ম্যাচ শেষে হার দেখলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের হারের কারণ কী? ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আম্পায়ারের বাজে আউটের সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের হারের প্রধান কারণ মনে করেন অনেকেই। এই আউট নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা থেকে শুরু করে শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরও।
বাতিল করা হয়েছে বাজে আউট দেয়া আম্পায়ার রড টাকারের ফেসবুক আইডি। ডিটি টাইগার্স সোশ্যাল মিডিয়া সিকিউরিটি টিম-এর ফেসবুক পেজে জানানো হয় এ তথ্য।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিতর্কিত সিদ্ধান্তে আমরা ক্রিকেটে হেরে গেলাম। আর ফাইনাল শেষে লিটনের আউট প্রসঙ্গে মাশরাফি বলেন, এটা তো আসলে বলা কঠিন। আমাদের কাছে একসময় মনে হচ্ছিল আউট না। কিন্তু থার্ড আম্পায়ারই ভালো বলতে পারবেন, কারণ সিদ্ধান্তটা তো উনারই ছিল। এটা নিয়ে হয়তো পরে আলোচনা হবে। ফাইনালে বাংলাদেশের বড় পুঁজি সংগ্রহের সম্ভাবনাটা ছিল স্পষ্ট। ফাইনালে ৮৮ বলে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ওপেনার লিটন দাস। আর ব্যক্তিগত ১২১ রানে ভারতীয় স্পিনার কুলদীপ যাদবের দেয়া গুগলি সামনে এগিয়ে এসে মারতে চাইলেও বলে ব্যাট লাগাতে পারেননি। বল গ্লাভসে ভরে যখন ভারতীয় উইকেটরক্ষক মহেন্দ্র সিং ধোনি স্টাম্প ভাঙলেন, ওই মুহূর্তে লিটনের পেছনের পা পড়লো পপিং ক্রিজে। সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেয়া হয় টিভি আম্পায়ার রড টাকারের হাতে। টিভিতে বিভিন্ন পাশ থেকে লিটনের পা দেখা গেছে লাইনে।
এসব ক্ষেত্রে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত সাধারণত ব্যাটসম্যানের পক্ষে যায়। কিন্তু এবার গেল ফিল্ডিং দলের পক্ষে। এনিয়ে আইসিসিকে একহাত নিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তরাও। তানিব ইমতিয়াজ নামের এক সমর্থক টুইটারে লিটনের স্টাম্পিং হওয়ার মুহূর্তের ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘আমরা এই পাশ থেকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি সেঞ্চুরি করা লিটন দাসের পা লাইনের পেছনে আছে। কিন্তু আম্পায়ার তাকে আউট দিলেন। কারণ তিনি জানেন যদি এই ম্যাচে তাকে আউট না দেয়া হয় তাহলে এটাই তার আম্পায়ারিংয়ে শেষ ম্যাচ।’ আরেক ক্রিকেট সমর্থক রক্তিম পাটোয়ারী লিখেছেন, ‘আইসিসি= ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল? নাকি আইসিসি= ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল?’ আবেদীন তমাল লিখেছেন, ‘আইসিসির নতুন নিয়ম, যে কোনো সংশয়ের সুবিধা পাবে ভারত।’ সুমন চন্দ্র দেবনাথের টুইট, ‘আজকের ম্যাচে ইনি থার্ড আম্পায়ার। তার সিদ্ধান্ত বাজে ছিল। ভারতের হয়ে কাজ করেছেন তিনি। বাংলাদেশ খেলোয়াড় লিটন দাসের আউট সঠিক ছিল না। আইসিসি ও থার্ড আম্পায়ারকে ধিক্কার।’
বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে সাধারণত প্রশংসা শোনা যায় না বীরেন্দর সেওয়াগ, রমিজ রাজাদের কণ্ঠে। তবে ফাইনাল শেষে বাংলাদেশের প্রতি টুপি খোলা (হ্যাটস অফ) সম্মান জানান তারাই। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সফরে আসার পর থেকেই এ দেশে অজনপ্রিয় এক ব্যক্তি বীরেন্দর  সেওয়াগ। তখন তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ সাধারণ মানের দল। সুযোগ পেলে এখনো বাংলাদেশের কড়া সমালোচনা করতে ছাড়েন না ভারতীয় এই সাবেক ওপেনার। কিন্তু এশিয়া কাপের ফাইনালের পর সেওয়াগ টুইট করেছেন ‘বাংলাদেশ, এত কাছে তবু কত দূরে। এশিয়া কাপ জেতার জন্য ভারতকে অভিনন্দন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু খেলোয়াড় ছাড়াও এমন উজ্জীবিত লড়াই উপহার দেয়ায় বাংলাদেশের প্রতি টুপি খোলা সম্মান জানাচ্ছি। আর পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার রমিজ রাজার চোখে মাশরাফি বিন মুর্তজা এশিয়া কাপের সেরা অধিনায়ক।
ভারতের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে বাংলাদেশ
লিটন দাসের বিতর্কিত আউট নিয়ে কোনো আলোচনা নেই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে। তবে ফাইনাল শেষে বাংলাদেশের নৈপুণ্যের প্রশংসা করতে বাধ্য তারা। গতকাল ভারতীয় বাংলা সংবাদমাধ্যম এবেলা’র প্রতিবেদনের শুরুটা ছিল এমন- ‘স্বল্প রানের পুঁজি নিয়েও লড়াই করা যায়। লড়াই করা যায় যদি প্রধান অস্ত্র হয় মনোবল। সেই অস্ত্রেই শুক্রবার ভারতকে ধাক্কা দিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে শেষরক্ষা হলো না। রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে শেষ বলে জয় ছিনিয়ে নিলো ভারত। তিন উইকেটে জিতে ফের এশিয়া সেরা ভারত। তবে বাংলাদেশের লড়াইয়ের প্রশংসা প্রাপ্য।’ আর অপর বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনের শুরুটা হলো- ‘এক সময় ১২০-০। সেখান থেকে ২২২ রানে অল আউট! এ যেমন বাংলাদেশের একটা দিক, তেমনই ২২২ রান তুলেও ভারতের সাত উইকেট ফেলে দিয়ে শেষ বল পর্যন্ত জেতার লড়াইয়ে থাকা। এটা বাংলাদেশের আর এক দিক।
শুক্রবার দুবাইয়ে এশিয়া কাপে যে বাংলাদেশকে দেখলো ক্রিকেটবিশ্ব, তা এক নতুন বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের মতো বিশ্বকাপজয়ী দল যখন ক্রমশ ব্যর্থতার অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে, তখন বাংলাদেশের এই উত্থান এশিয়ার ক্রিকেটের পক্ষে অবশ্যই ভালো খবর। আনন্দবাজার পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক সম্বরণ বন্দোপাধ্যায় তার প্রতিবেদনে আরো লিখেছেন- শুক্রবারের এই এশিয়া কাপ ফাইনাল নিশ্চয়ই ক্রিকেট দুনিয়ার কাছে এই বার্তা দিলো যে, ভারত  কোনো পরিস্থিতিতেই হার না মানা দল। সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেটাররা এটাও বুঝলেন যে,  কোনো প্রতিপক্ষকেই কম গুরুত্ব দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কয়েক মাস আগে শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফির ফাইনালেও এই বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই শেষ ওভারে ভারতকে যেভাবে শেষ বলে উদ্ধার করেছিলেন দীনেশ কার্তিক, শুক্রবার সেভাবেই শেষ বলে ভারতকে জেতালেন কেদার যাদব। এই দুই ঘটনায় এটাই বোঝা যায়, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশ কিন্তু ক্রমশ ভারতের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে দিয়েছে।
সমানে সমানে টক্কর দেয়াটা এখন তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। শুধু অভিজ্ঞতার অভাবে এই চাপ কাটিয়ে জিততে পারছে না তারা, এই যা। অভিজ্ঞতার অভাবেই হয়তো সেটা হচ্ছে। এই সমস্যাটা কাটিয়ে উঠতে তাদের খুব বেশি সময় লাগবে না বোধহয়। যেভাবে ভারতকে এ দিন শুরু থেকেই চাপে ফেলে দেন মাশরাফি বিন মুর্তজারা, তারপরে এ কথা স্বীকার করতেই হচ্ছে। ১৭ ওভারের মধ্যেই শিখর ধাওয়ন, আম্বাতি রায়ডু ও রোহিত শর্মাকে ফিরিয়ে মুর্তজারা যে চাপটা তৈরি করেছিলেন, ৩০ ওভারের পরে দীনেশ কার্তিক ও মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে ফিরিয়ে তা আরো বাড়িয়ে তোলেন। যা শেষ বল পর্যন্ত  রেখেছিলেন তারা। ওপেনাররা ছাড়া বাংলাদেশের অন্য ব্যাটসম্যানরা ব্যর্থ হলেও ওদের বোলারদের নিখুঁত স্টাম্প টু স্টাম্প বোলিং আর অনবদ্য ফিল্ডিংই ওদের জয়ের দোরগোড়ায় নিয়ে চলে এসেছিল। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবই ওদের শেষ বলে জয় পেতে দেয়নি।

No comments

Powered by Blogger.