ইসরাইলকে রক্ষার জন্য ট্রাম্পের 'শতাব্দির সেরা চুক্তি' পরিকল্পনায় যা আছে: পর্ব-দুই

গত পর্বের আলোচনায় আমরা 'শতাব্দীর সেরা চুক্তি' নামক মার্কিন পরিকল্পনার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত দেশগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরব।
দখলদার ইসরাইল, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্দান ও মিশর মার্কিন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রধান সহযোগী। 'শতাব্দীর সেরা চুক্তি' নামক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল ভূমিকায় রয়েছে আমেরিকা। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বায়তুল মোকাদ্দাসকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া, ফিলিস্তিন শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও বায়তুল মোকাদ্দাস নিয়ে বিতর্কের পুরোপুরি অবসান ঘটানো এবং ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা দুই রাষ্ট্র গঠন আমেরিকার প্রধান উদ্দেশ্য। চলতি বছর ড্যাভোসে অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, "মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসে স্থানান্তরের অর্থ হচ্ছে ওই শহরের ভাগ্য নির্ধারণের বিষয়ে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরাইলের আলোচনার আর কোনো সুযোগ নেই।"
বলা হচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইহুদি জামাতা ও উপদেষ্টা জেরাড কুশনার, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত জেইসন গ্রিনবালাত এবং ইসরাইলে আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রেডম্যান 'শতাব্দীর সেরা চুক্তি' নামক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছেন। জেরাড কুশনার ও জেইসন গ্রিনবালাত বেশ কয়েকটি আরব দেশ বিশেষ করে জর্দান সফরে গিয়ে সেদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে 'শতাব্দীর সেরা চুক্তি' নামক পরিকল্পনার বিষয়ে কথাবার্তা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে তারা হুমকি ও প্রলোভন দেখানোর কৌশল অবলম্বন করেছেন। ইসরাইলে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রেডম্যান মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি সম্প্রসারণকামী পরিকল্পনার বড় সমর্থক। এ কারণে ইসরাইল দ্রুত ইহুদি উপশহর নির্মাণ অব্যাহত রাখা এবং আরো ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখল করে চলেছে। কাতারের দৈনিক আল আরাবি আল জাদিদের সাংবাদিক সালেহ আল নাআমি লিখেছেন, ইসরাইলের সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রেডম্যান জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ও বায়তুল মোকাদ্দাসে ইসরাইলি আগ্রাসন রোধে কোনো পদক্ষেপতো নেয়নি এমনকি ইহুদি উপশহর নির্মাণ বন্ধের জন্য যারা দাবি জানাচ্ছে তিনি তাদেরও সমালোচনা করছেন।
'শতাব্দীর সেরা চুক্তি' নামক পরিকল্পনার আওতায় পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা, ইরান ও শিয়া মুসলমানদের প্রভাব বিস্তারকে বিপদ হিসেবে তুলে ধরা, আরব দেশগুলোর দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগকে আমেরিকার স্বার্থে কাজে লাগানো এবং এ দেশগুলোকে ইরানের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্দেশ্য। এ কারণেই দেখা গেছে, সৌদি আরব, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তড়িঘড়ি করে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পদক্ষেপ নিয়েছে। মিশর ও জর্দান বহু দশক আগেই ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি সই করেছে। আমেরিকা সবসময়ই মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও শিয়া মুসলমানদের প্রভাব বিস্তারের বিপদের বিষয়টিকে প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। বর্তমানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও সৌদি যুবরাজ সালমান ঐক্যবদ্ধ হয়ে কথিত ওই বিপদের বিষয়টিকে জোরেসরে প্রচার করছেন।
ইরান ও শিয়া বিরোধী প্রচারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সৌদি আরব, ইসরাইল ও আমেরিকা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে জর্দান, মিশর ও ফিলিস্তিনকেও ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছে।  সম্প্রতি জর্দানে ইসরাইল বিরোধী যে বিক্ষোভ হয়েছে তা থামানোর জন্য সৌদি আরব ও সংযুক্ত আমিরাত জর্দান সরকারকে বিপুল অর্থ সহায়তা দিয়েছে। গাজায় অবকাঠামো পুনর্গঠন ও জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের মানুষের জীবন মান উন্নয়নের জন্য অর্থ সহায়তার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া, মিশরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থ সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এভাবে আর্থিক সহায়তার বিনিময়ে ইরানের বিরুদ্ধে এই তিন দেশকে নিজেদের পক্ষে রাখার চিন্তাভাবনা রয়েছে ট্রাম্পের 'শতাব্দীর সেরা চুক্তি' নামক পরিকল্পনায়।  
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের 'শতাব্দীর সেরা চুক্তি' নামক পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য দখলদার ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করা। কারণ পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাসকে পুরোপুরি ইহুদিকরণ, বায়তুল মোকাদ্দাসকে রাজধানী করে ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টি, ইহুদি উপশহর নির্মাণের জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করা এবং তথাকথিত শান্তি আলোচনা থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস ও শরণার্থী ইস্যুটি পুরোপুরি বাদ দেয়ার কথা বলা হয়েছে 'শতাব্দীর সেরা চুক্তি' পরিকল্পনায়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সৌদি যুবরাজ সালমান হচ্ছেন ইসরাইলের প্রধান সহযোগী। ইসরাইল সৌদি আরবকে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু বলে মনে করে। এ কারণে ইসরাইলও সৌদি আরবে যুবরাজ সালমানের সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। এ সংস্কারের ফলে একদিকে সৌদি আরবে ধর্মীয় মূল্যবোধ ম্লান হয়ে পড়ছে অন্যদিকে দেশটির জনগণ পাশ্চাত্য স্টাইলে জীবন যাপন শুরু করেছে। নিঃসন্দেহে, সৌদি আরবের এই পরিবর্তন ইসরাইলের স্বার্থের অনুকূলে। এ ছাড়া, সৌদি রাজা সালমান বিন আব্দুল আজিজ ও তার পুত্র যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ইরান ও এ অঞ্চলের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে যা ইসরাইলের স্বার্থের অনুকূলে।
এভাবে দখলদার ইসরাইল ও সৌদি আরবের মধ্যে গড়ে উঠেছে অনানুষ্ঠানিক জোট। এদিকে, ব্যাপক প্রতিবাদ সত্বেও আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন নিয়ে ইসরাইল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে অবৈধভাবে ইহুদি বসতি নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ইহুদি বসতি নির্মাণের অর্থ হচ্ছে আরো অধিক সংখ্যক ইহুদিদের এখানে এনে জড়ো করা এবং এই ভূখণ্ডের মূল মালিক অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদেরকে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করা। তাই উপশহর নির্মাণের বিষয়টি 'শতাব্দীর সেরা চুক্তি' পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
ইসরাইলকে নতুন নতুন আইন তৈরির সুযোগ করে দেয়াও 'শতাব্দীর সেরা চুক্তি' পরিকল্পনার আরেকটি উদ্দেশ্য। এরই অংশ হিসেবে দখলদার ইসরাইলের সংসদ 'নেসেট' গত ১৯ জুলাই গোটা অধিকৃত ফিলিস্তিনকে ইহুদি জাতির রাষ্ট্র বলে ঘোষণা দিয়ে এ ঘোষণাকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেছে। প্রস্তাবের পক্ষে ৬২টি ভোট ও বিপক্ষে ৫৫ টি ভোট পড়ে এবং দু জন ভোট দানে বিরত ছিল। এ আইন অনুমোদনের ফলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড কেবল ইহুদিদের ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ছাড়াও হিব্রু ভাষাই হবে একমাত্র রাষ্ট্র-ভাষা। চরম বর্ণবাদী বা ইহুদিবাদী এ আইনের কারণে ফিলিস্তিনিদের কোনো নাগরিক ও মানবিক-অধিকার থাকবে না। এ আইনের ফলে একদিকে বায়তুল মোকাদ্দাসকে রাজধানী করে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন অন্যদিকে নতুন নতুন ইহুদি উপশহর নির্মাণের কাজ তরান্বিত হবে।
ইন্টারনেট ভিত্তিক বার্তা সংস্থা মিডিলইস্ট আই এক প্রতিবেদনে ইসরাইলি সংসদে পাশ হওয়া এ আইনকে অধিকৃত ভূখণ্ডে বর্ণবাদের বাস্তবায়ন হিসেবে অভিহিত করেছে যার লক্ষ ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব ও পরিচিতিকে ধ্বংস করে ফেলা। ইসরাইলের এ আইনে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন অভিযান চালানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.