রুবাইয়া ও নাঈমার জঙ্গি হওয়ার গল্প by বিল্লাল হোসেন রবিন

নারায়ণগঞ্জের একটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামিসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের (জেমবি) দুই নারী সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। বুধবার রাতে রাজধানী ঢাকার আরামবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-১১ এর একটি টিম তাদের গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- রুবাইয়া বিনতে নুর উদ্দিন ওরফে হুরের রাণী ওরফে লাবিবা (২০)। সে ময়মনসিংহের সদর থানার কাচি ঝুলি হামিদ উদ্দিন রোডের বাসিন্দা। এবং নাঈমা আক্তার ওরফে হিমালয়ের কন্যা (২৫)। সে একই জেলার ফুলবাড়িয়া থানার শ্রীপুরের বাসিন্দা। তাদের কাছ থেকে উগ্রবাদী বই ও লিফলেট উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে রুবাইয়া বিনতে নুর নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার একটি মামলার (নম্বর-৪৮ তারিখ ১৮/৪/১৮) এজাহারভুক্ত আসামি। রুবাইয়া স্কুলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপাড়া করে মাদরাসায় ভর্তি হয় এবং নাঈমা পদার্থ বিজ্ঞানে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের আদমজীতে র‌্যাব-১১ এর সদর দপ্তরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে র‌্যাব-১১ এর ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর আশিক বিল্লাহ এ তথ্য জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, র‌্যাব-১১ এর সিনিয়র এএসপি মো. আলেপ উদ্দিনসহ র‌্যাব-১১ এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ। র‌্যাব-১১’র ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর আশিক বিল্লাহ আরো জানান, গ্রেপ্তারকৃত রুবাইয়া বিনতে নুর উদ্দিন ওরফে হুরের রাণী ওরফে লাবিবা ২০১১ সালে ময়মনসিংহের একটি গার্লস স্কুল হতে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে। এরপর ২০১২ সাল হতে মাদরাসায় লেখাপড়া শুরু করে। বর্তমানে সে ময়মনসিংহের সদর থানার কাচি ঝুলিতে স্থানীয় একটি বালিকা মাদরাসায় অধ্যয়নরত। সে মূলত ইন্টারনেটের মাধ্যমে উগ্রবাদিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়। ২০১৬ সালে ইন্টারনেটে সামাদ ওরফে আব্দুল্লা ওরফে জাকির নামক জনৈক এক জেএমবি সদস্যের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে সে জেএমবির নারী শাখায় অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে র‌্যাব-১১ কর্তৃক চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল গ্রেপ্তারকৃত নারী জঙ্গি সদস্য মিতুসহ বেশ কয়েকজন সক্রিয় নারী জঙ্গি সদস্যদের সঙ্গে তার পরিচয় ও সখ্য গড়ে ওঠে। র‌্যাব জানায়, রুবাইয়া জেএমবিতে অন্তর্ভুক্তির পর জেএমবির নারী শাখার দাওয়াতী ও প্রচার কার্যক্রম চালাত। সে ও তার মা ফিরোজা বেগম, গ্রেপ্তারকৃত নাঈমাসহ তার নিকট আত্মীয়, প্রতিবেশী সহপাঠী ও বন্ধুদের জেএমবি এর দাওয়াত দেয়। তন্মধ্যে সে তার মা ফিরোজা, নাঈমাসহ বেশ কয়েকজনকে জেএমবিতে অন্তর্ভুক্তি করায়। তবে রুবাইয়ার বাবা, নানা-নানী ও বেশ কয়েকজন নিকট আত্মীয় জেএমবির দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয় দেখালে রুবাইয়া তাদেরকে এড়িয়ে চলতে থাকে। পরে সে ও তার মা কঠোর গোপনীয়তার মাধ্যমে নিজেদেরকে জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখে।
র‌্যাব আরো জানায়, রুবাইয়াকে ইতিপূর্বে জঙ্গি সামাদ ওরফে আব্দুল্লাহ ওরফে জাকির হিজরত করার প্রস্তাব দিলে তাকে তার মা স্বাচ্ছন্দ্যে অনুমতি দেয়। ফলে তার মায়ের অনুমতিক্রমে জঙ্গি জাকিরকে বিয়ে করে হিজরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে ওই জঙ্গি জাকিরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে হিজরতে যাওয়ার বিষয় বিলম্বিত হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের জুলাই-আগস্টে জঙ্গি শরফুল আওয়াল (৩১/১২/২০১৭ তে গ্রেপ্তার হয়) রুবাইয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। রুবাইয়ার মা ও রুবাইয়া শরফুলের পূর্বে গ্রেপ্তারের রেকর্ড দেখে খাঁটি মুজাহিদ হিসেবে বিবেচনা করে তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়। কিন্তু এর মধ্যে জঙ্গি শরফুল আওয়াল আবারও গ্রেপ্তার হলে সে পরিকল্পনাও ভেস্তে যায়। কিছুদিন পর পুনরায় জেএমবি সদস্য সামাদ ওরফে আব্দুল্লাহ ওরফে জাকিরের সঙ্গে রুবাইয়ার যোগাযোগ হয়। ফলে মা ও মেয়ের পূর্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী, রুবাইয়া হিজরতের উদ্দেশ্যে চলতি বছরের ১৬ই মার্চ গৃহত্যাগ করে। তবে রুবাইয়া হিজরতের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগের বিষয়টি তার মা অবগত থাকলেও তার বাবা বিষয়টি জানতেন না।
র‌্যাব আরো জানায়, রুবাইয়া বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সে এবং জঙ্গি সামাদ ও বেশ কয়েক জঙ্গি সদস্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত অভিযান ও নজরদারি এড়াতে দেশ ত্যাগের পরিকল্পনা করে। এবং জঙ্গি সামাদ কৌশলে রুবাইয়াকে ভুয়া নাম ঠিকানায় একটি পাসপোর্ট করিয়ে দেয়। দেশ ত্যাগের উদ্দেশ্যে তারা বিদেশে অবস্থানরত জঙ্গি সদস্য নুর ইসলাম ওরফে ভানু প্রতাপ সিং ওরফে সাইফ আল ইসলামের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখত। দেশ ত্যাগের উদ্দেশ্যে তারা বেশ কয়েকদিন খুলনা, যশোর, বেনাপোলে অবস্থান করার পর তারা বুঝতে পারে যশোর দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। ফলে তারা দেশের ভেতর  কয়েকদিন গা-ঢাকা দেয়ার পরিকল্পনা করে। অপরদিকে গ্রেপ্তারকৃত নাঈমা আক্তার ওরফে হিমালয়ের কন্যা ময়মনসিংহের একটি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। সে তার এক বান্ধবীর সাহচার্যে এসে ধর্মীয় বিষয়ের প্রতি আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এরপর জসীম উদ্দিন রাহমানীর কিছু লেকচার ও অন্যান্য উগ্রবাদ সংক্রান্ত বই পড়ে ধর্মীয় উগ্রবাদিতায় আকৃষ্ট হয়। পরে সে রুবাইয়ার দাওয়াতের মাধ্যমে জেএমবির নারী শাখায় অন্তর্ভুক্ত হয়। নাঈমা ইন্টারনেট ও ফেসবুকে প্রচুর ধর্মীয় উগ্রবাদিতা বিষয়ে লেখালেখি ও স্ট্যাটাস দিত। সে তাদের কলেজের ছাত্রী হোস্টেলে অবস্থানরত ছাত্রীদের উগ্রবাদিতায় দাওয়াত দিত এবং উক্ত হোস্টেলে সে ও রুবাইয়াসহ কয়েকজন নারী জঙ্গি মিলে মাঝে মধ্যে গোপন বৈঠক করত। গোপন বৈঠকে তারা অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিত। তাদের পরিকল্পনা ছিল নারী সদস্য দ্বারা কিভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর হামলা পরিচালনা করা যায়। এর মধ্যে রুবাইয়া হিজরতে চলে গেলে তার উগ্রবাদিতায় সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানাজানি ও জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার এড়াতে নাঈমা আত্মগোপনের পরিকল্পনা করে। এবং গোপনে সে বিভিন্ন মাধ্যমে রুবাইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর কৌশলের ব্যাপারে তথ্য বিনিময় করত বলে র‌্যাব জানতে পারে। এদিকে প্রেসব্রিফিং শেষে র‌্যাব-১১ এর বিদায়ী সিও লে. কর্নেল কামরুল হাসান গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিয়ম করেন। এ সময় তিনি র‌্যাব-১১ তে তার দুই বছর দায়িত্ব পালনকালে র‌্যাবের জঙ্গিদমন কর্মকাণ্ডসহ নানা প্রশংসনীয় কর্মকাণ্ড ও অর্জনগুলো তুলে ধরেন এবং গণমাধ্যমকর্মীদের সহযোগিতার জন্য কতৃজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

No comments

Powered by Blogger.