খুলনায় গ্রেপ্তারে নাজেহাল বিএনপি by রোকনুজ্জামান পিয়াস

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযানে নাজেহাল বিএনপি। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে নিয়মিত অভিযান চলছে মহানগরী ও এর আশপাশের এলাকায়। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তীব্রতা বাড়ছে অভিযানের। এসব অভিযানের বেশির ভাগই চালানো হচ্ছে রাতের বেলা। প্রতিরাতেই এক বা একাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হচ্ছেন। বাদ যাচ্ছেন না নির্বাচনী এজেন্টও। ইতিমধ্যে গত এক সপ্তাহে বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট গ্রেপ্তার হয়েছেন। সন্ধ্যা নেমে আসলেই তাই আতঙ্ক দেখা দেয় দলীয় নেতাকর্মী, মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক এবং নির্বাচনী এজেন্টদের মাঝে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিনের বেলায় প্রচারণায় ব্যস্ত থাকলেও গ্রেপ্তার এড়াতে রাতে আত্মগোপনে থাকছেন নেতাকর্মীরা। এই গ্রেপ্তার অভিযানের বিরুদ্ধে বরাবরই অভিযোগ করে আসছে খুলনা বিএনপিসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। বলছেন, গত একমাসে তাদের প্রায় আড়াই শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এরমধ্যে গত ৪-৫ দিনেই গ্রেপ্তার হয়েছেন শতাধিক নেতাকর্মী। পাশাপাশি বাড়িঘরে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগও করছেন তারা। এ ব্যাপারে প্রতিদিনই নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার মিলছে না। এ বিষয়ে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার ইউনুচ আলী বলেন, আমরা ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা পুলিশ কমিশনারকে জানিয়ে দিয়েছি। আমরা বলেছি, ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ছাড়া যেন কাউকে গ্রেপ্তার করা না হয়। অহেতুক হয়রানি করার জন্য যেন কাউকে আটক করা না হয়। এভাবে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের যেন ছেড়ে দেয়া হয়। এখন আমরা দেখব পুলিশ কি ভূমিকা পালন করে। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. হুমায়ুন কবীর দাবি করেছেন, যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা মাদকসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। তিনি বলেন, হয়রানি করার জন্য পুলিশ কাউকে আটক করছে না।
সূত্র জানিয়েছে, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হয়। তবে, সে সময় অভিযান খুব বেশি জোরদার ছিল না। এরপর মনোনয়নপত্র দাখিলের পর গ্রেপ্তার অভিযান কিছুটা জোরদার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মনোনয়ন প্রত্যাহার, প্রতীক বরাদ্দ ও আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর পর অভিযানে আরো গতি আসে। আর নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে বর্তমানে প্রতিদিনই গ্রেপ্তার হচ্ছেন নেতাকর্মীরা। বিএনপি এই গ্রেপ্তারকে গণগ্রেপ্তার বলে আখ্যায়িত করছে। শুধু মহানগরই নয়, জেলা থেকে যেসব নেতাকর্মী শহরে এসে ধানের শীষের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে, নিজ নিজ থানা ও গোয়েন্দা পুলিশ তাদেরকেও গ্রেপ্তার করেছে।
২২শে এপ্রিল থেকে উল্লেখযোগ্য যেসব নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের একটি তালিকা এই প্রতিবেদকের কাছে এসেছে। তবে, মহানগর বিএনপি বলছে, এই তালিকার বাইরেও তাদের অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর পক্ষে প্রচারণার দায়ে অনেক অরাজনৈতিক ব্যক্তিকেও হুমকি-ধামকি ও মামলা-হামলার ভয় দেখানো হচ্ছে বলে তারা দাবি করেছেন।
২২শে এপ্রিল গ্রেপ্তার হন খুলনা মহানগর বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ পারভেজ বাবু। ৩০শে এপ্রিল প্রচারণায় অংশ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে নগরীর গল্লামারী থেকে ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হন বাগেরহাট জেলা যুবদল সভাপতি মেহবুবুল হক কিশোর। ২রা মে রাতে নিজ বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার হন মহানগর বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও সোনাডাঙ্গা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মুরাদ। একই রাতে গ্রেপ্তার হন মহানগর যুবদলের সভাপতি মাহবুব হাসান পিয়ারু, সোনাডাঙ্গা থানা বিএনপি নেতা মো. অহেদুজ্জামান, দৌলতপুর থানা বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মিঠু, দৌলতপুর থানা যুবদল নেতা মো. ফারুক, সদর থানা শ্রমিক দল নেতা আবু তালেব, সদর থানা শ্রমিক দল নেতা ফারুক হোসেন, সদর থানা শ্রমিক দল নেতা গাউস হোসেন, লবনচরা থানা বিএনপি নেতা নাসির হোসেন, খালিশপুর থানার ১০নং ওয়ার্ড বাস্তুহারা ইউনিট বিএনপি নেতা গোলাম মোস্তফা ভূট্টো, খালিশপুর থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সান্টু, খালিশপুর থানা যুবদল নেতা শুকুর আলী, খালিশপুর থানা বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম, খালিশপুর থানা যুবদল নেতা সুমন। ৮ই মে রাতে গ্রেপ্তার হন মহানগর বিএনপির সহ-ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক একরামুল কবির মিল্টন, সোনাডাঙ্গা থানার ২০নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন টারজান, সদর থানার ৩০নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আলম হাওলাদার, দৌলতপুর থানা শ্রমিক দল নেতা লোকমান হোসেন।
৯ই মে দুপুরে গোয়েন্দা পুলিশ নিজ বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে মহানগর বিএনপির সহ-শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আবদুল আজিজ সুমনকে। একইদিন রাতে খালিশপুর থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন মহানগর যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদুর রহমান রিপন, খালিশপুর থানার ১০নং ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জোহা জিহাদ, খালিশপুর থানার ৯নং ওয়ার্ডের বাস্তহারা ইউনিট বিএনপি নেতা ও মেয়র প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ইকবাল হোসেন, সদর থানার ২৯নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা কামরুল বিশ্বাস, সদর থানার ৩০নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা শুকুর আলী।
৩১নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর হোসেন, খানজাহান আলী থানার ২নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা আলী আকবর, মুন্না ও শহিদুল ইসলাম, দৌলতপুর থানার ৩নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা মো. ডালিম ও মো. মাসুদ। বৃহস্পতিবার দিনের বেলা গ্রেপ্তার হন সদর থানার ৩০নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম খোকন, ২৯নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মাহাদী হাসান সুমন, ২২নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা সাহারুজ্জামান মুকুল, সোনাডাঙ্গা থানার ২৬নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা সাজ্জাদ আলী, সদর থানার ২৭নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা গোলাম মোস্তফা মোস্তফা, ৩০নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা শাহ আলম, ২৮নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা তানভীরুল আযম, সোনাডাঙ্গা থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম সাগর, ২৫নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা মোহাম্মদ আরিফ, ২৬নং ওয়ার্ড ছাত্রদল কর্মী শাকিল, ২০নং ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আবু ওয়ারা, ১৮নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা রিয়াজুল কবির, দৌলতপুর থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক জাহিদ হাসান খসরু, দৌলতপুর থানা যুবদল নেতা এসএম জসিম, খালিশপুর থানা ছাত্রদল নেতা মামুন পাটোয়ারী, ১৪নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা তৈয়ব আলী, ১০নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মোহাম্মদ আবদুল হাই কালু। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়ার কারণে রূপসা থানা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেলা বিএনপির ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক সাইফুল হাসান রবি, নৈহাটি ৫নং ওয়ার্ড বিএনপি সাধারণ সম্পাদক মুজিবর রহমান ঝলু, নৈহাটি ১নং ওয়ার্ড বিএনপি সহ-সভাপতি শামসুদ্দোহা জহর, নৈহাটি ইউনিয়ন ছাত্রদল সভাপতি মো. ইবাদুল, মাহবুবুল আলম মনা, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোস্তফা উল বারী লাভলু, জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা তুহিন, আইচগাতি ইউনিয়ন বিএনপি কর্মী আবদুর রহমান, নৈহাটি ইউনিয়ন বিএনপি কর্মী ফরহাদ, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা জাহাঙ্গীর আহমেদ, বিএনপি নেতা আবদুল আজিজ, জাবুসা ওয়ার্ড বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক জিয়া সরদার। দিঘলিয়া থানায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, ইউপি সদস্য ও থানা বিএনপির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আলী মিন্টু, ইউপি সদস্য ও বারাকপুর ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক কামাল হোসেন বিশ্বাস, ইউপি মেম্বার ও সাবেক যুবদল নেতা মো. জাকির শিকদার। ডুমুরিয়া থানায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, মাগুরঘোনা ইউপি বিএনপি সহ-সভাপতি সরদার আব্দুল মালেক, ইউপি সদস্য ও জেলা বিএনপির স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক বিএম হাবিবুর রহমান হবি, আটলিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবদুস সালাম মহলদার, ইউপি সদস্য ও শোভনা ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আবদুল কাদের, সাবেক ইউপি সদস্য ও শোভনা ইউপির যুবদলের সাবেক সভাপতি শেখ আবদুর রশিদ, বিএনপি নেতা মহসিন।
দাকোপ থানায় গ্রেপ্তার হয়েছেন চালনা পৌর বিএনপির সভাপতি শেখ আবদুল মান্নান, থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক পাপ্পু সাহা, ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি ননী গোপাল। বটিয়াঘাটা থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন, জলমা ইউপি বিএনপির যুুগ্ম সম্পাদক বাদশা।
পাইকগাছায় থানায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, ৬নং ওয়ার্ড কপিলমুনি বিএনপি সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হালিম, ৪নং ওয়ার্ড হরিঢালী ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি সাইফুল ইসলাম শফি, ১নং ওয়ার্ড রাঢ়ুলী ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি পীর আলী, ৪নং ওয়ার্ড হরিঢালী ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মো. নূর ইসলাম। কয়রা থানা পুলশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন থানা ছাত্রদল যুগ্ম আহ্বায়ক সম্পাদক মো. লিটন প্রমুখ।
খুলনা মহানগর বিএনপির অভিযোগ এর বাইরে আরো অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়ার কারণে। এ ব্যাপারে জেলা বিএনপি সভাপতি ও বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর নির্বাচন সমন্বয়ক শফিকুল ইসলাম মনা বলেন, গ্রেপ্তারের ভয়ে আমাদের অনেক নেতাকর্মী মাঠে নামতে পারছে না। এমনকি নির্বাচনী এজেন্টরাও ভয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। তিনি বলেন, গত একমাসে খুলনার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় আড়াইশ’ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আর গত ৪-৫ দিনেই গ্রেপ্তার হয়েছেন শতাধিক নেতাকর্মী। মনা বলেন, প্রতিরাতেই থানা পুলিশ ও সাদা পোশাকের পুলিশ নেতাকর্মীদের বাড়িতে হানা দিচ্ছে। অনেক সময় তাদের না পেয়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে, পরিবারের সদস্যদের নানারকম হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। জেলা বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, এ ব্যাপারে আমরা প্রতিদিনই নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিচ্ছি, কিন্তু ফলাফল শূন্য।

No comments

Powered by Blogger.