দ্য প্যাট্রিয়ট ও রবার্ট মুগাবে by মোহাম্মদ আবুল হোসেন

‘দাজ আই এন্টারড অ্যান্ড দাজ আই গো’ ইংলিশ সাহিত্যিক রবার্ট ব্রাউনের ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’ কবিতার এই লাইনটি সম্ভবত রবার্ট মুগাবের মতো শাসকদের জন্যই প্রযোজ্য। এসব রাজনীতিক ক্ষমতায় আসেন ফুলের মালা নিয়ে। বিদায় নেন ‘শহরবাসীর কঙ্কর নিক্ষেপের’ মধ্য দিয়ে, অবহেলা, অনাদর আর ঘৃণার মধ্য দিয়ে। দেশপ্রেমিকের স্বরূপ উন্মোচনে কালজয়ী এই কবিতাটি লিখেছেন রবার্ট ব্রাউনিং। রবার্ট মুগাবের মতো একজন বিপ্লবী, রাষ্ট্রনায়ক যখন ক্ষমতায় আসেন তখন তার পথে বিছানো থাকে ফুল। প্রজাদের হৃদয় নিংড়ানো থাকে ভালোবাসা।
তারা দলবেঁধে নেমে পড়েন রাজপথে তাদের নেতাকে স্বাগত জানাতে। বিনিময়ে তারা কি চান? দেশবাসী যেমন তাকে ভালোবাসা দেন, বিনিময়ে তেমনটাই ফেরত চান তারা। কিন্তু ক্ষমতার তখতে বসে যদি শাসকের চেহারা পাল্টে যায়, তিনি ক্ষমতাকে নিজস্ব সম্পত্তি বলে ভেবে বসেন, তাহলেই পরিস্থিতি উল্টে যেতে শুরু করে। যারা তাকে সম্মান দিয়েছিল, শ্রদ্ধা জানিয়েছিল, ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছিল- তারাই সময়ে দূরে সরে যান। রাষ্ট্রনায়ক নিঃসঙ্গ পড়ে থাকেন। তখন তার ভুল ধরা পড়ে। রাষ্ট্রনায়ক তখন ‘বৃষ্টির ভিতর হাঁটতে থাকেন’। প্রতীকী অর্থে এখানে কবি রবার্ট ব্রাউনিং রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদাহানী অর্থে ব্যবহার করেছেন। একদা তিনি ছিলেন পরিষ্কার, নির্ভেজাল মানুষ। কিন্তু দুর্নীতি, অবিচার, অন্যায়, ক্ষমতার লোভ তার সেই নির্ভেজাল ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে রাষ্ট্রনায়ক অনুভব করতে থাকেন প্রথমবারের মতো ‘পশ্চাতে নিয়ে হাত বেঁধে রাখা হয়েছে। এতে কেটে যাচ্ছে হাতের কব্জি’। তিনি তখন বুঝতে পারেন ‘সেই জনগণই তখন ভুলের জন্য আমার দিকে পাথর ছুড়ে মারছে’। কিন্তু রাষ্ট্রনায়ক নিজে মনে করতে থাকেন তিনিই সঠিক। একদিন সৃষ্টিকর্তা সঠিক বিচার করবেন। তার ঠাঁই হবে স্বর্গে। কিন্তু পৃথিবীর মানুষের চোখে তিনি অপরাধী হয়ে থাকেন। যেমনটা সময়ের চাকার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গিয়েছে মুগাবের জন্য। তিনি ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে নিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন মনাঙ্গাগাওয়াকে বরখাস্ত করেছিলেন। রাজনীতিতে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই নিজের ৪১ বছরের ছোট স্ত্রী গ্রেসি মুগাবের। তবে তার অভিজ্ঞতা একটি আছে বৈকি। জিম্বাবুয়ের মানুষ যখন দুর্বিপাকে, অভাবে নিমজ্জিত তখন তিনি বিমানে করে বিদেশে গিয়েছেন শপিং করতে। এজন্য তাকে নাম দেয়া হয়েছে ‘গুচি গ্রেসি’। তাকেই ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে বসনোর ছক এঁকেছিলেন মুগাবে। কিন্তু এতে হস্তক্ষেপ করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। তারা ক্ষমতা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। আফ্রিকান ইউনিয়ন একে সামরিক অভ্যুত্থান বললেও সেনাবাহিনী তাতে দ্বিমত পোষণ করে। তারা জানিয়ে দেয়, তারা ক্ষমতা দখলের জন্য সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়নি। তারা শুধু দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চায়। তাই তাদের এ হস্তক্ষেপ কোনো অর্থেই সামরিক অভ্যুত্থান নয়। এমনকি নিজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে রবার্ট মুগাবের ক্ষমতাসীন দল জানু-পিএফ। তারা তাকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে বিক্ষোভ করে রাজধানী হারারের রাজপথে। কিন্তু তাতেও কর্ণপাত করেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্টে তার বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব আনা হয়। এমন পরিস্থিতিতে পদত্যাগে বাধ্য হন রবার্ট মুগাবে। তার অধ্যায় বন্ধ হয়ে যায়। নতুন অধ্যায় শুরু হয় এমারসন মনাঙ্গাগাওয়ার। দীর্ঘ ৩৭ বছর দেশ শাসন করে যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন মুগাবে তিনি নিজের কৃতকর্মের কারণে সেই জনপ্রিয়তাকে পরিণত করেছেন জনশত্রুতায়। তিনি দেশবাসীর অনুভূতির বিরুদ্ধে গিয়েছেন। ফলে তাকে নেয়া হচ্ছে রবার্ট ব্রাউনিংয়ের প্রতীকী অর্থের সেই ‘ফাঁসি কাষ্ঠের’ দিকে। তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন সেদিকে। আর জনতা মঙ্গলবার রাতভর হারারের, বেলাওয়েসহ সব শহরে সে দৃশ্যে উল্লাস করছে। এটা মুগাবের জন্য সেই জনতার কঙ্কর নিক্ষেপের মতো বলে বিবেচনা করা যায়। মুগাবে মঙ্গলবার রাতে যখন হারারের রাস্তায় তাকিয়েছেন তিনি দেখেছেন ভিন্ন দৃশ্য। যাদের বলে বলীয়ান হয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, তারাই এখন তাকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে দিচ্ছে। এর চেয়ে কঠিন বাস্তবতা আর কি হতে পারে একজন রাষ্ট্রনায়কের ভাগ্যে!

No comments

Powered by Blogger.