২৫ বছর কারাবাসের পর খালাস পেলেন বাবুল

যে অপরােধর অভিযোগে িতনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, সেই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর কারাদণ্ড। অথচ তাঁকে কারাগারেই থাকতে হলো ২৫ বছর। অবশেষে গতকাল বুধবার ঢাকার একটি আদালত তাঁকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। তাঁর নাম মো. বাবুল। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ডাকাতির মামলায় ১৯৯২ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। খালাস আদেশের পর বাবুল প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯২ সালে ডেমরা থেকে সিআইডি তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তখন তিনি ছিেলন কিশোর। এরপর থেকে বারবারই পুলিশ, আইনজীবী ও আদালতকে বলেছেন, তিনি নির্দোষ। তাঁর কথা কেউ শোনেননি। বাবুল যখন তাঁর জীবনের কাহিনি শোনাচ্ছিলেন, তখন তাঁর চোখ ভিজে যাচ্ছিল পানিতে। গতকাল বুধবার বাবুলসহ পাঁচজনকে খালাস দিয়েছেন ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান। মামলার নথিতে দেখা গেছে, ১৯৯২ সালের ২১ আগস্ট রাত সাড়ে আটটার দিকে গুলিস্তান থেকে কুমিল্লাগামী একটি বাস ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সানারপাড়ে পৌঁছালে তিন সদস্যের অজ্ঞাত ডাকাতদল বাসে ডাকাতি করে। যাত্রীদের কাছ থেকে নয় হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় তারা। এ ঘটনায় ওই বাসের কর্মচারী নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন। তদন্ত করে ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর বাবুলসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন ডেমরা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আশরাফ আলী সিকদার। আদালত অভিযোগপত্রটি আমলে নিয়ে বাবুলসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালের ৪ জুলাই বিচারকাজ শুরু করেন। বিচার শুরুর ২৪ বছরে মামলার ১১ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র চারজন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। তবে মামলার বাদী নজরুল কিংবা তদন্ত কর্মকর্তা আশরাফ কখনো আদালতে হাজির হননি। আদালত বাবুলের খালাসের রায়ে বলেছেন, ‘মামলার বাদী, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ডকারী বিচারকসহ অন্য সাক্ষীদের আদালতে হাজির করানোর জন্য আদেশের কপি পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো পক্ষই মামলার বাদী, তদন্ত কর্মকর্তা ও জবানবন্দি রেকর্ডকারী বিচারককে আদালতে হাজির করানোর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।’ বাবুলসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি বলে আদালত তাঁর রায়ে উল্লেখ করেছেন। বাবুল তাঁকে গ্রেপ্তারের কাহিনি তুলে ধরে বলেন, মা-বাবার সঙ্গে তিনি থাকতেন ডেমরার দোলাইরপাড় (এখন যাত্রাবাড়ী থানার মধ্যে) এলাকায়।
সেদিন তিনি ফতুল্লায় যাচ্ছিলেন বন্ধুর কাছে। ডেমরা সেতুর ওপর ট্যাক্সির ভেতরে ছিলেন। হঠাৎ পুলিশ তাঁকে ধরে। পরে রিমান্ডেও নেয়। গ্রেপ্তারের পর প্রথম প্রথম মা-বাবা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে কারাগারে আসতেন। এরপর থেকে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তাঁরা। বাবুলের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের বাহারনগর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আনোয়ার হোসেন। মা নিলুফা বেগম। তাঁরা সাত ভাই ও দুই বোন। বাবুলের ভাষ্য, তাঁর বাবা বিমানবাহিনীতে চাকরি করতেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান বাবা। ১৯৯৫ সালে মারা যান মা। এরপর থেকে আর কোনো দিন ভাই কিংবা বোনকে দেখেননি তিনি। বাবুল ঘুরেফিরে তাঁর মা-বাবার গল্পই বলছিলেন। বিনা বিচারে বাবুলের ২৫ বছর কারাগারে থাকার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত বছর ধরে একজন আসামি জেলে আছেন, এটা কি কারও নজরে পড়ল না? ২৫ বছর জেলে থাকার জন্য যে কর্তব্যে অবহেলা হয়েছে, তার জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই তদন্ত হওয়া উচিত। রাষ্ট্রের কর্তব্য হবে বাবুলের প্রতিটি নষ্ট বছরের জন্য অন্তত ২ লাখ টাকা করে অবিলম্বে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া।’ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও বাবুলের এই ঘটনাকে চরম অন্যায় বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবুলের প্রতি যে অন্যায় হয়েছে, এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। এ ছাড়া বাবুলকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থাও করা উচিত।’

No comments

Powered by Blogger.