ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি আইএসপন্থী!

সম্প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রতিষ্ঠাতা। ট্রাম্পের ভাষায়- তারা উভয়ই অসৎ ও নির্বোধ। কিন্তু ট্রাম্পের এমন বিদ্রূপাত্মক অভিযোগ এটাই স্পষ্ট করে যে, যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেউ আইএসকে সাহায্য করে থাকেন, তাহলে তিনি একমাত্র ট্রাম্প। রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতিসংক্রান্ত এক ভাষণে আইএস বধে একটি বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনা প্রকাশ পেয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অকার্যকর আরও যেসব মন্তব্য করেছেন তিনি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের আগে মুসলিম দেশের অভিবাসীদের তাদের মতাদর্শগত পরীক্ষা দিতে হবে, মুসলিম অভিবাসীদের তার ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিনেই বের করে দেয়া হবে ইত্যাদি। ট্রাম্পের দাবি, তিনি একজন বাস্তববাদী এবং মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন। ট্রাম্পের মূল ‘বাস্তবসম্মত’ পদ্ধতি হল, সিরিয়ায় ওবামা প্রশাসনের চেয়ে বেশি সামরিক বাহিনীর প্রয়োগ। ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, তার এ প্রক্রিয়া আইএসকে ধুলায় ধূসরিত করবে। বস্তুতপক্ষে, এ ধরনের একটি সামরিক হস্তক্ষেপ জ্বলন্ত আগুনের ওপর গ্যাসোলিন ঢেলে দেয়ার শামিল।
অবশ্যই এটা বোঝার ক্ষমতা নেই ট্রাম্পের। যদিও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, মার্কিন জেনারেলদের চেয়ে আইএস সম্পর্কে বেশিই জানেন ট্রাম্প। বর্তমান জটিল গতিবিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতা, সাম্প্রদায়িকতার দাবানল এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে প্রসারিত মধ্যপ্রাচ্যের প্রক্সি যুদ্ধের ব্যাপারে নিতান্তই অন্যমনস্ক ট্রাম্প। এমনকি হিলারি ও ওবামাকে নিয়ে এমন মন্তব্য করায় এ ধারণাটি স্পষ্ট যে, আইএস কোথা থেকে বা কেমন করে উত্থান হয়েছে- এ ব্যাপারে সম্যক জ্ঞানও ট্রাম্পের নেই। সত্য হল, ‘ইসলামের ভেতরেই সংঘাতে’র কারণে আইএসের জন্ম, ইসলাম ও পশ্চিমার মধ্যে দ্বন্দ্বে নয়। এটা বলারও অপেক্ষা রাখে না, পশ্চিমা- বিশেষ করে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি আইএসের উত্থানে প্রধান ভূমিকা রাখেনি। ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর ইরাক আক্রমণ দেশটির সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে দিয়েছে, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি করেছে, এমনকি একটি সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে দেশটিকে। এর ফলেই জঙ্গিগোষ্ঠী উত্থানের সুযোগ পেয়েছে। প্রথমে ইরাকে আল কায়দা, এখন আইএস এবং পরে ইরাকের সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে আল কায়দার সীমানা বিস্তৃত হয়েছে। ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের শিয়া সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে জনরোষের কারণে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে সিরিয়ায়ও। আরব বসন্তে অনুপ্রাণিত হয়ে অধিক স্বাধীনতা ও সুন্নি শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠার অনিশ্চিত প্রত্যাশায় তিউনিসিয়া, মিসর, সিরিয়ার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে; কিন্তু আসাদ সরকার ইরানের অকৃত্রিম সমর্থনে শক্তিশালী বিদ্রোহী সেনাদের সঙ্গে সংঘাত চলমান রাখে। সিরিয়া জড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধে, এতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয় এবং সাম্প্রদায়িক বিভক্তি আরও বেড়ে যায়। সুন্নিপন্থী জঙ্গিরা স্থানীয় এলাকার বেপরোয়া ও রগচটা যুবকদের নিয়োগ দিয়ে সংঘাতের সম্প্রসারণ আরও ত্বরান্বিত করেছে।
এই শিয়া-সুন্নি বিভাজনের কারণে আইএসের নিয়োগদাতা এবং নেতারা ইসলামের রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। এমনকি ইসলামের মতাদর্শ ও ধর্মীয় শত্রু, বিশেষ করে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মৌলবাদী ইসলাম ও পশ্চিমাদের মধ্যে একটি স্নায়ুযুদ্ধ-শৈলী মতাদর্শগত সংগ্রামের নিরিখে সৃষ্ট, এ জন্য শুধু ‘বাইনারি’ আখ্যান দ্বারা এ জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না ট্রাম্প। বরং তিনি বারবার এটাই উচ্চারণ করে যাবেন যে, আইএস নিয়োগকর্তারা বিভিন্ন হামলাকে সমর্থন করছে। সত্য হল, সাধারণ মুসলমানরা যারা মনেপ্রাণে আইএসের ধ্বংসাত্মক মতাদর্শকে প্রত্যাখ্যান করেন, তারা ইসলামোফোবিয়াকে উসকে দেয়া ট্রাম্পের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের নিন্দা জানাচ্ছেন। কিন্তু আইএসের স্বনিয়োগকৃত আমীর আবুবকর আল বাগদাদী ও তার সহযোগীদের কানে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় বাজানো সুর পৌঁছেছে। এটা খুবই খারাপ হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে আইএসের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে, আর ট্রাম্প জঙ্গি সংগঠনগুলোকে শক্তির মাত্রায় বৃহত্তর ক্ষমতাধর হিসেবে গড়ে তোলার মন্ত্র পাঠ করছে। আদতে ট্রাম্পের অবদানে এটাই সাব্যস্ত হচ্ছে যে, আইএস আসলে যা তার থেকে বেশি শক্তিসম্পন্ন মনে করছে নিজেদের এবং এতে জঙ্গি নিয়োগকর্তারা আনন্দে বগল বাজাচ্ছে। সম্প্রতি সিরিয়ায় দূরপাল্লার বিমান হামলার জন্য রাশিয়াকে বিমানঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে ইরান। এ জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ­াদিমির পুতিনের সঙ্গে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বন্ধে মতৈক্যে পৌঁছানোর পথে পাহাড়সম বাধা উপলব্ধি করছেন ওবামা। আইএসকে পরাস্ত করতে আসাদের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন ট্রাম্প। আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে বাইরের হস্তক্ষেপে সিরীয় বা সুন্নি মুসলিমরা আরও ক্ষিপ্ত। এ সুযোগে আইএসের নিয়োগকর্তারা তাদের সক্ষমতাকে আরও উর্বর করতে পারছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের মূল শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে (রাশিয়া, ইরান, চীন- যারা সিরিয়ার সেনাদের প্রশিক্ষণ দেয়) সখ্য গড়তে পারত, তবে আইএসের বিরুদ্ধে এ সমরসখ্যে যুদ্ধরত দেশগুলোর পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে পারত। তবে মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে ‘মার্কিন সম্পর্ক’ আরও জোরালো হতো। ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর বিশ্বের যুবাদের প্রত্যাশা পূরণে যুক্তরাষ্ট্রের এটাই সঠিক সময়। মধ্যপ্রাচ্যের উদ্বেলিত আগুন নেভাতে, আবারও ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানের সংস্কার এবং জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনে যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কূটনৈতিক ও সামাজিক বিনিয়োগে অংশীদার করা প্রয়োজন। মধ্যপ্রাচ্যে আরও একটি বেপরোয়া মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রবক্তা হতে পারেন ট্রাম্প।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে ভাষান্তর : সালমান রিয়াজ
ফাওয়াজ এ জার্গিস : লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.