তুরস্ককে গুরুত্ব দিতে হবে

তুরস্কের পশ্চিম অংশে অবস্থিত ইস্তাম্বুল ইউরোপের বৃহৎ মহানগরগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি যখন কনস্ট্যান্টিনোপল নামে পরিচিত ছিল, তখন রোমান ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। ১৪৫৩ সালে দ্বিতীয় মেহমেদ এই শহরটি দখল করে নতুন নামকরণ করার পর এটি ৫০০ বছর অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। বসফোরাস প্রণালির পশ্চিম পাশে অবস্থিত এই শহরটি ইউরোপ ও এশিয়াকে বিভক্ত করেছে। ইতিহাসের সব কালপর্বেই এটি পূর্ব ও পশ্চিমের ভূরাজনৈতিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করেছে। ইস্তাম্বুল খুব সম্ভবত এই ভূমিকা পালন করে যাবে খ্রিষ্টান পশ্চিমের সঙ্গে বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে। আজকের তুরস্ক অটোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়ে উঠেছে। দেশটির রাজনৈতিক জীবন প্রায়ই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ থাকে, যেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষার মধ্যে বিরোধ আছে। তুরস্কের যেমন সফলতা আছে, তেমনি ব্যর্থতাও আছে। তা সত্ত্বেও দুই শতক ধরে সংস্কারকামীরা দেশটির আধুনিকায়নের জন্য ইউরোপের দ্বারস্থ হয়েছেন। তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য, যিনি ১৯২০ ও ৩০-এর দশকে দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ করার জন্য কিছু সংস্কার করেছিলেন, যার জন্য তাঁকে কর্তৃত্বপরায়ণ হতে হয়েছিল। কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠার এই বিষয়টি দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ক্ষেত্রেও খাটে।
এরদোয়ান ১৩ বছর ধরে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশ্বদরবারে প্রবল ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এরদোয়ান ও তাঁর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) প্রথম দশকে এমন কিছু অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কার করেছে, যা মানুষের হৃদয়ে ছাপ ফেলেছে। তুরস্ক ইতিমধ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কাস্টমস ইউনিয়নের সদস্য, তাঁর সরকারের সংস্কার কর্মসূচি তাঁকে ওই সদস্যপদ পেতে সহায়তা করেছে। এর ফলে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার কাছাকাছি চলে গেছে। তাই দেশটি গণতান্ত্রিক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে আরও আগ্রহী হয়েছে। মানুষের আশার পালে হাওয়া লেগেছিল, দেশটি হয়তো শেষমেশ সামরিক একনায়কতন্ত্রের খপ্পর থেকে মুক্ত হতে চলেছে। তবে গত কয়েক বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। দেশটির ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির আলোচনা প্রায় থমকে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু সদস্যদেশের বৈরিতার কারণে এমনটি হয়েছে। এদের সবার উদ্দেশ্য এক নয়, কিন্তু এতে অনেক তুর্কি নাগরিকই বিচ্ছিন্ন বোধ করছে; তারা মনে করছে সেই ইউরোপই তাদের পরিত্যাগ করল, যে ইউরোপ তাদের একসময় অনুপ্রাণিত করেছিল। ফলে অনেক তুর্কিই যে এখন অনুপ্রেরণার জন্য অন্যত্র যাচ্ছে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এ ছাড়া সম্প্রতি তুরস্কে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির অনেক অবনতি হয়েছে। তা ছাড়া, ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে তুর্কি সমাজে মারাত্মক মেরুকরণ ঘটছে। দীর্ঘ যুদ্ধবিরতির পর কুর্দিরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
ওদিকে ইসলামিক স্টেট ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারায় একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে। এত কিছু সত্ত্বেও যে তারা ৩০ লাখ অভিবাসীকে আশ্রয় দিয়েছে, তাতে বোঝা যায়, দেশটির ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা রয়েছে। আবার ২০১৩ সাল থেকে একেপির সঙ্গে গুলেনবাদীদের নীরব গৃহযুদ্ধ চলছে, যার আংশিক নেতৃত্বে আছেন মার্কিনপ্রবাসী ধর্মনেতা ফেতুল্লা গুলেন। অথচ একেপি ও গুলেনবাদীরা একসময় জোট বেঁধে কামালের ‘গভীর রাষ্ট্রের’ উপাদান দূর করার চেষ্টা করেছেন। অভিযোগ আছে, কামাল আতাতুর্ক ধর্মনিরপেক্ষ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য গণতন্ত্রবিরোধী ও জাতীয়তাবাদীদের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে ঢুকিয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তাঁরা তুরস্কের জ্যেষ্ঠ জেনারেলদের লোকদেখানো বিচার করেছিলেন। অনেকেই মনে করেন, এ কারণেই তুরস্ক গোল্লায় যেতে বসেছে। এরপর গুলেনবাদীরা পুলিশ, বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীতে ঢুকেছে বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। ফলে সরকার ধীরে ধীরে কর্তৃত্বপরায়ণ হয়েছে। আর জুলাইয়ের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই নীরব গৃহযুদ্ধ সরব হয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন, গুলেনবাদীরা এই অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও গুলেন সে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অভ্যুত্থান সফল হলে তুরস্কে এক দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেত, যার কূলকিনারা দেখা যেত না। গণতন্ত্রের সব আশা নির্বাপিত হতো। এই অভ্যুত্থানচেষ্টার একটি ভালো দিক হলো, বহু বছরের বিভাজনের পর তুরস্কের গণতন্ত্রকামী শক্তিগুলো একত্র হতে পেরেছে। পশ্চিম এ সময় তুরস্কের পাশে দাঁড়ায়নি,
ব্যাপারটা বিস্ময়কর। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিনের তুরস্কের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য ভালো হবে না। তুরস্ক যে এখন গুলেনবাদীদের ক্ষমতা থেকে সরাতে চাইছে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। অন্য কোনো রাষ্ট্রও ভেতর থেকে বিদ্রোহের সম্মুখীন হলে একই কাজ করত। এখন সেখানে অন্যায় হচ্ছে তা ঠিক, কিন্তু আমাদের উচিত, নিজেদের শাসকের আসনে বসিয়ে ব্যাপারটা চিন্তা করা। তবে তুরস্কের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা কাউন্সিল অব ইউরোপ সেক্রেটারি জেনারেলের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, ‘কাউন্সিলের সদস্যপদের বিধান অনুসারে আমরা আইনের শাসন বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর অস্থির পরিস্থিতির অবসান হলে কাউন্সিল যেকোনো সময় ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে পারে।’ তুরস্ক এক ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছে। কিন্তু দেশটি কোথায় যাচ্ছে, তা বলার সময় এখনো আসেনি। মেরুকরণ ও কর্তৃত্ববাদের ধারা যদি চলতে থাকে, তাহলে দেশটির ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতি অভিন্ন অঙ্গীকার নিয়ে যদি জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে, তাহলে তুরস্কের রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নতি হবে। ইউরোপের সঙ্গে একত্র হওয়ার নতুন আশা তৈরি হবে। তুরস্কের ব্যাপারে পশ্চিমের মনোভাবের গুরুত্ব আছে। পশ্চিমা কূটনীতিকদের জোর তৎপরতা শুরু করতে হবে, যাতে এমন ফলাফল বের করে আনা যায়, যার গণতান্ত্রিক মূল্য আছে, যা পশ্চিমা ও তুর্কি স্বার্থ একইভাবে রক্ষা করতে পারে। গণতান্ত্রিক ও আধুনিক তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের সংস্কার ও আধুনিকতার সূত্রপাত করতে পারে। কিন্তু বিচ্ছিন্ন ও কর্তৃত্বপরায়ণ তুরস্ক ইউরোপের পূর্ব সীমান্তে গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
কার্ল বিল্ড: সুইডেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.