শিক্ষাব্যবস্থা নালন্দা থেকে কতটা এগোলো?

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ অব্দে প্রাচীন ভারতবর্ষের মাটিতে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের পর বৌদ্ধ ধর্মদর্শন ও বৌদ্ধ মতবাদের জন্ম হয়। গৌতম বুদ্ধ ধর্ম প্রচারের পর বিহারগুলোকেই নির্ধারণ করেছিলেন বিদ্যা ও জ্ঞানচর্চার প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে। শুধু ধ্যান-সমাধি কিংবা অধ্যাত্মচর্চা নয়, মানববিদ্যার সব গুণাবলি অর্জনের জন্য তিনি এ বিহার বা সংঘারামকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ওইসব বিহার বা সংঘারামেই পালিভাষা, ধর্মীয় শিক্ষা এবং ধর্মদর্শনসহ নানাবিধ শাস্ত্র ও বিদ্যাচর্চা করা হতো। গুরুর সান্নিধ্যে থেকেই এ পাঠ গ্রহণ করা হতো। ক্রমান্বয়ে ওইসব বিহার, সংঘারাম ও মঠ-মন্দিরগুলো এক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়রূপে পরিগণিত হয়, যার মধ্যে নালন্দা অন্যতম। বৌদ্ধ বিদ্যাচর্চা ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে প্রাচীন নালন্দার প্রভাব অতুলনীয়। বৌদ্ধ বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞানচর্চার খ্যাতিতে এ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সে সময়ের একটি সেরা শিক্ষাকেন্দ্র। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় আবার মুখর হয়ে উঠেছে ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত সেই প্রাচীন নালন্দা। প্রায় ৮০০ বছর আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রাচীন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে এ ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম আবার চালু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির নতুন যাত্রা বর্তমান ভারত সরকার ও পূর্ব এশিয়া সম্মেলনভুক্ত (ইএএস) ১৮টি দেশের একটি মহৎ উদ্যোগের ফসল। ২০১৩ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ব্রুনাই সফরকালে অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ ইএএসভুক্ত ৭টি দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন।
এছাড়া ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামেরও বড় ভূমিকা ছিল এ বিষয়ে। তিনি চেয়েছিলেন তার জীবদ্দশায় প্রাচীন এ বিশ্ববিদ্যালয় যেন আবার নতুনভাবে জ্ঞান বিতরণে জেগে ওঠে। ভারতের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিচালনা পর্ষদের পুনঃপ্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন। নালন্দা শুধু প্রাচীন ভারতবর্ষের নয়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিদ্বৎসমাজকে অভিভূত করেছে তার শিক্ষা পাঠক্রম ও জ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে। এজন্যই এখনও এ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের পণ্ডিত ও বিদ্বৎসমাজকে প্রাচীন শিক্ষাপদ্ধতি ও ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন শাখার শাস্ত্রশিক্ষা ও ধর্মদর্শনকে প্রাধান্য দেয়া হলেও জ্ঞানমুখী অন্যান্য বিষয়কে সমান মর্যাদা দিয়েছে। তাই সেখানে পড়ানো হতো বৈদিক, ব্রাহ্মণ্য ও তৎকালীন ব্যবহারিক বিষয়গুলো। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং নালন্দার পাঠক্রমের কথা বলতে গিয়ে পাঁচটি বিদ্যার কথা উল্লেখ করেছেন : ক. শব্দবিদ্যা (ব্যাকরণ ও দর্শন), খ. চিকিৎসাবিদ্যা (ভেষজ ও আয়ুর্বেদ), গ. হেতুবিদ্যা (যুক্তি ও তর্কশাস্ত্র), ঘ. শিল্পবিদ্যা (শিল্পকলা ও চারুকলা), ঙ. অধ্যাÍবিদ্যা (ধ্যান-সমাধিস্থ বিদ্যা ও অধিবিদ্যা)। এছাড়াও সেখানে পড়ানো হতো বেদ, সংখ্যাদর্শন, অর্থশাস্ত্র ও অথর্ববিদ্যা। পরবর্তীকালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও ১৮টি বিদ্যাশিক্ষার প্রবর্তন হয়েছিল। এর মধ্যে বেদ, উপনিষদ ও অর্থশাস্ত্র তো ছিলই, আরও যুক্ত হয় পুরাণ, দর্শন, স্মৃতি, ধনুর বেদ, গান্ধর্ব বেদ, তর্কশাস্ত্র, হেতুবিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, গজশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র, ন্যায়শাস্ত্র, ব্যাকরণশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত, চিত্রাংকন ইত্যাদি।
পরবর্তী সময়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয় অভিধর্মকোষ ও জাতকমালা। এর আরও পরে, বিশেষ করে পাল শাসনামলে প্রাচীন নালন্দায় মহাযান বৌদ্ধধর্মের তন্ত্রযান, মন্ত্রযান, বজ যানসহ সে সময়কার বৌদ্ধধর্মের জ্ঞানচর্চার নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন জনপদের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে এশীয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, প্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি ইউরোপ থেকেও শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের জন্য নালন্দায় এসেছেন। উল্লেখ্য, এ বিদ্যাপীঠে যে ব্যাকরণ শিক্ষা দেয়া হতো তা ছিল অতি উচ্চমার্গীয়। যেমন- এখানে পাণিনির সূত্র, উপনিষদ সূত্র, ধাতুপাঠ, অষ্টধাতু, বেদ্বৃত্তি, কচ্চায়ন, বুত্তোদয়সহ নানা ব্যাকরণের পাঠদান করা হতো। প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতিতে গুরু-শিষ্য নিকটবর্তী শিক্ষা প্রচলন ছিল। গুরু ছিলেন শিষ্যদের অভিভাবক, বন্ধু, পথপ্রদর্শক এবং চিন্তা ও দার্শনিক তত্ত্বের সমাধানকর্তা। গুরুগৃহে ধর্মগ্রন্থ ও বুদ্ধবাণীর চর্চা হতো। তাই প্রাকবৌদ্ধ যুগে এবং বুদ্ধ সমকালীন কিংবা এর পরবর্তী সময়ে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল গুরুগৃহ অথবা বিহার, মঠ ও আশ্রমভিত্তিক। শুধু বৌদ্ধ শিক্ষাপদ্ধতি নয়, বৈদিক শিক্ষাপদ্ধতিও ছিল সেরকম। এ শিক্ষা পদ্ধতিতে নৈতিক, আদর্শিক ও অন্তর্মুখী শিক্ষার উৎকর্ষকেই প্রাধান্য দেয়া হতো। ওই শিক্ষাব্যবস্থাতেই, বিশেষ করে বৌদ্ধধর্মের শিক্ষাপদ্ধতিতে উঁচু-নিচু, জাতপাত এবং ধর্ম ও বর্ণ বৈষম্যের প্রথা বিলুপ্ত হয়েছিল। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত ছিল বিহারের নালন্দা নগরে। মাটি খুঁড়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের নথিভুক্ত প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যে পাঠাগারটি ছিল সেটি বিশ্বের সেরা ১১টি প্রাচীন পাঠাগারের অন্যতম। পাঠাগারটি সে সময়ের জগদ্বিখ্যাত জ্ঞানী ব্যক্তিদের পদচারণায় মুখর হয়ে থাকত।
বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে ছিল ‘পুস্তক সংগ্রহশালা’। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে পুস্তক ও পাণ্ডুলিপির সংখ্যা ছিল কয়েক লাখ। পাণ্ডুলিপি ও পুস্তকবিন্যাস এমনভাবে সজ্জিত ছিল যাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চার বিঘ্ন না ঘটে। পাণ্ডুলিপিগুলো পাথরের তাকের ওপর সুসজ্জিত ছিল। পাণ্ডুলিপিসহ গ্রন্থাগারের নানা দায়িত্বে ছিলেন বিভিন্ন বিভাগের পণ্ডিত শিক্ষকরা, যাতে শিক্ষার্থীরা সহজে তাদের গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপিগুলো শনাক্ত করতে পারে। নালন্দায় তিন ধরনের পাণ্ডুলিপি ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়। যেমন- নেপালের অষ্টসহসি কা প্রজ্ঞাপারমিতা, বুডলিয়ান লাইব্রেরিতে রক্ষিত একই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি, রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত একই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির অনুলিপি। এখানে চামড়া ও তালপত্রের নানা লিপির পাণ্ডুলিপিও ছিল। এমনকি পণ্ডিতদের হস্তলিপির পাণ্ডুলিপিও ছিল। সে সময় পণ্ডিতদের মৃত্যু হলে তাদের হস্তলিপি ও পাণ্ডুলিপিগুলো ওই লাইব্রেরিতেই দান করে দেয়া হতো। হিউয়েন সাং তার ভ্রমণ বিবরণীতে নালন্দায় সাতটি বিহার ও আটটি হলের কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিহারগুলো ছিল বহুতলবিশিষ্ট এবং বিভিন্ন সারিবদ্ধ কক্ষে সুবিন্যস্ত। পরিব্রাজক ইৎসিং বলেছেন, তিনি তার ভ্রমণকালে সেখানে ৩০০টি আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট দেখেছেন। চারতলাবিশিষ্ট সাতটি ছাত্রাবাসও ছিল, যেখানে ভিক্ষু-শ্রমণসহ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল ২ হাজারের বেশি। ৪২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয় ১১৯৭ সাল পর্যন্ত উপমহাদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বৌদ্ধধর্মচর্চার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত রাজাদের সময়ে এ মহাবিহারের প্রতিষ্ঠা হয়। গুপ্তযুগের পাঁচজন রাজা নালন্দায় পাঁচটি বিহার নির্মাণ করেন। হিউয়েন সাং নালন্দার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গুপ্তযুগের প্রথম রাজা শক্রাদিত্যের নাম উল্লেখ করেছেন। সে সময় আটটি শিক্ষায়তন নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত এ মহাবিহার গড়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা সেখানে সহজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেত না। প্রথমে দ্বার পণ্ডিতের কাছে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে তবেই ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেত। শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করতে হতো। এমনকি তাদের পোশাক-পরিচ্ছদসহ বাহ্যিক আচার-আচরণও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হতো। প্রকৃত শিক্ষার্থী বাছাইয়ের এ পদ্ধতি বর্তমান সময়েও প্রয়োগ করা উচিত।
আজকাল এসব রীতি ও নিয়ম কানুন মানা হয় না বলেই শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাঝে নৈতিক অবক্ষয় দেখা যায়। সে সময়ে ২০ বছরের নিচে কোনো শিক্ষার্থীকে নালন্দায় পড়াশোনার সুযোগ দেয়া হতো না। এতে প্রমাণ হয়, স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরাই এখানে ভর্তির সুযোগ পেত। এমনকি রাজপরিবারের সন্তানও যোগ্যতার অভাবে প্রত্যাখ্যান হতো। এখানে ছাত্রত্ব লাভ করা অতি গৌরবের বিষয় ছিল। শিক্ষার ব্যাপারে ছাত্রদের স্বাধীনতা ছিল। বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক ও আলোচনা হতো যুক্তিতর্কের মাধ্যমে। এর মধ্য দিয়ে ছাত্রদের জ্ঞান ও বিদ্যার গভীরতা নির্ণয় করা হতো। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থীর জীবন যাতে পরিপূর্ণ জ্ঞান, যুক্তি-তর্ক, নিয়মানুবর্তিতা ও সময়জ্ঞানে আদর্শিকভাবে গড়ে ওঠে, সেটাই ছিল নালন্দার শিক্ষাপদ্ধতির অন্যতম লক্ষ্য। বর্তমানে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে কঠোর নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষাপদ্ধতি দেখা যায়, তা প্রাচীন নালন্দার শিক্ষাপদ্ধতিরই আধুনিক রূপ। শিক্ষা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিদ্যা ও শাস্ত্রচর্চায় নালন্দা ছিল ভারতীয় জ্ঞানভাণ্ডারের এক মহান বিদ্যাপীঠ, যার আলোকরশ্মি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে আধ্যাত্মিক শিক্ষার পাশাপাশি বৌদ্ধশাস্ত্র ও ধর্মদর্শন, পালি, প্রাকৃত, সংস্কৃতসহ চারু ও কারুকলা, শরীরতত্ত্ব, গণিত, জোতির্বিদ্যা, রাজনীতি ও সমরনীতি চর্চায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সারা বিশ্বে অগ্রগামী ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষদিকে অর্থাৎ ১১৯৭ সালে তুর্কি বিজেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ভারতবর্ষে অভিযানের সময় এ বিশ্ববিদ্যালয়কে যুদ্ধশিবির মনে করে ধ্বংস করে দেন। কিংবদন্তি আছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঠাগার পুড়ে শেষ হতে প্রায় এক মাস সময় লেগেছিল। বহুদূর থেকে এ আগুন চোখে পড়ত বলে বিভিন্ন প্রামাণ্য পুস্তকে উল্লেখ আছে। উল্লেখ্য, এ বিশ্ববিদ্যালয় যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তখন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড, ইতালির বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয় সবেমাত্র যাত্রা শুরু করে।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
skbaruadu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.