আইএসের প্রতিষ্ঠাতা ওবামা-হিলারি?

গলাবাজ ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের নামোল্লেখ করেছেন। বস্তুত এ আবিষ্কারের কৃতিত্ব তার একার। আর এতে মুগ্ধ হয়ে অন্যের স্বীকৃতি লাভের আশায়ই হয়তো তিনি একই অভিযোগ পৃথকভাবে তুললেন তিনবার, তিন অনুষ্ঠানে। উপরন্তু তিনি যেভাবে কথাগুলো বলেছেন, তাতে ভদ্রলোকের মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে অনেকের। মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিরা বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনা গায়ে মাখেন না সাধারণত। তবে মজার বিষয় হল, ট্রাম্প যতবারই এ ধরনের কথা বলেছেন আর যতবারই তার বক্তব্যগুলোকে ধোলাই করা হয়েছে, তার নির্বিকার উত্তর ছিল- আরে, ওসব তো আমি আক্ষরিক অর্থে বলিনি; ওগুলো আমার বিদ্রূপ বাণ। সমালোচনা থেকে আত্মরক্ষার এ এক কৌশল বটে! ট্রাম্পের অভিযোগ ভিত্তিহীন হলেও এক্ষেত্রে বাস্তবতা হল, যুক্তরাষ্ট্র আইএসের মতো জঙ্গিদের সহায়তা দিচ্ছে বলে সন্দেহ অনেকের। সেজন্য কিছু ক্ষেত্রে এমন বিভ্রান্তিও ছড়িয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রই বুঝি আইএসের চালক। অভিযোগটি অবশ্যই মিথ্যা। তবে সংশয়টি সৃষ্টির কারণ মূলত কয়েকটি পক্ষের সঙ্গে ওয়াশিংটনের মাখামাখি সম্পর্ক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অভিযোগ আছে, সিরিয়া ও ইরাকে জঙ্গিবাদে মদদ দিচ্ছে ওবামা প্রশাসন; তাও আবার এমন সব গ্রুপকে,
কাজেকর্মে যাদের নৃশংসতা এরই মধ্যে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে স্বপ্রতিশ্রুত ‘মধ্যপন্থা’কে। অভিযোগটির প্রধান ভিত্তি ওয়াশিংটন টাইমসের এই প্রতিবেদন : ‘২০১১ সালে লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে সিংহাসনচ্যুত করতে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক এক প্রতিরক্ষা কোম্পানি থেকে কিছু সশস্ত্র লিবীয় গোষ্ঠীকে অস্ত্র-গোলাবারুদের চালান পাঠানোর অনুমতি দেয় মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর; যদিও সে সময় দেশটির ওপর জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল।’ তাছাড়া জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের দাবি, ‘উইকিলিকসের ১৭০০ ই-মেইল প্রমাণ করে, বেনগাজির সিআইএ অপারেটরদের মাধ্যমে লিবিয়া থেকে সিরিয়ায় পাঠানো অস্ত্রের চালান বিষয়ে পূর্ণ সচেতন ছিলেন হিলারি এবং অস্ত্রগুলো আইএসের হাতে পড়া অস্বাভাবিক নয়।’ অথচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কংগ্রেসের সামনে তিনি অঙ্গীকারনামা দিয়েছেন এর উল্টোটা। এ অবস্থায় শপথপূর্বক মিথ্যা বলার অপরাধে হিলারিকে জেলে দেখতে চান সিনেটর র‌্যান্ড পল! এই গেল একদিক। অন্যদিকে প্রধান ইরাকি শহর বিশেষত মসুল থেকে আইএস দমনে ইরাকি সেনাবাহিনী ও ইরানপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোট বাঁধে ইউএস স্পেশ্যাল ফোর্স ও মেরিন। এদের মধ্যে অনেকেই মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ে আসছে ২০০২ সাল থেকে। আবার আমেরিকান বদান্যতায় ঠিক কৃতজ্ঞবোধ করেন না সব ইরাকি শিয়া।
যেমন- প্রভাবশালী শিয়া নেতা মুকতাদা আল সদরের সন্দেহ, কাজ শেষে আমরাই হয়তো তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হব। লক্ষণীয়, স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে তোলা সন্দেহজনক এসব সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই মার্কিন নিন্দার মূল কারণ। একই দৃষ্টান্ত মেলে মিসরেও। ওবামা ও হিলারি উভয়ে মিসরে হস্তক্ষেপ করেন সম্মিলিতভাবে; প্রথমে হোসনি মোবারকের সরকার উৎখাতে সহায়তা করে এবং পরে দেশ পরিচালনায় মুসলিম ব্রাদারহুডের মোহাম্মদ মুরসিকে আশীর্বাদ দিয়ে। কারও কারও ধারণা, ব্রাদারহুডের চুক্তি হয়েছিল ওয়াশিংটনের সঙ্গে; নইলে ৩০ মিলিয়ন জনসমর্থনের বাইরে গিয়ে এমন নির্লজ্জভাবে ব্রাদারহুডের পক্ষ নিত না তারা। লক্ষণীয়, বর্তমান প্রেসিডেন্ট আল সিসি’র সরকার ক্ষমতায় আসার পরপর এফ-১৬ ও অ্যাপাচি যুদ্ধবিমানের একটি চালান আটকে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। শোনা যায়, এমনকি মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যান পিটারসন জেলে গিয়ে মুরসিকে আশ্বাস দিয়ে আসেন, চিন্তা কর না! ব্রাদারহুডের প্রতি সহানুভূতিপরায়ণ একাধিক ব্যক্তি রয়েছে মার্কিন প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে (হিলারির ঘনিষ্ঠ সহযোগী হুমা আবেদীনের সঙ্গে ব্রাদারহুডের সম্পর্ক প্রায় কয়েক প্রজন্মের)। মুসলিম ব্রাদারহুডের সাবেক মুখপাত্র জিহাদ আল হাদ্দাদ ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের সাবেক কর্মী। প্রেসিডেন্টের গোপন নথি দেখার সুযোগ রয়েছে এমন একজন বলেছিলেন, ব্রাদারহুডকে ক্ষমতাসীন রাখাই ছিল ওবামার মিসর নীতি। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্র দফতরকে ব্রাদারহুডের সঙ্গে বেশি মাখামাখির জন্য তীব্র নিন্দা করেছেন কয়েকজন প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর। তাদের বক্তব্য, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসরের মতো একাধিক মিত্র দেশ দ্বারা চিহ্নিত একটি সন্ত্রাসী সংগঠনকে দেয়া যায় না লাল গালিচা অভ্যর্থনা।
মনে করিয়ে দিচ্ছি, সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা পেতে যেসব যোগ্যতার প্রয়োজন হয় সেগুলো মুসলিম ব্রাদারহুডের রয়েছে কিনা, না থাকলে কোন কোন যোগ্যতা নেই তা জানতে চেয়ে গত বছর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে বিল পাঠান সিনেটর টেড ক্রুজ। ওই বিলই আটকে দেয়া হয়েছে চলতি বছর মে’তে। একই রকম মাখামাখি সম্পর্ক যুক্তরাজ্যেরও রয়েছে কয়েকটা। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন একবার কমিশন গঠন করেন যুক্তরাজ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডের উৎপত্তি-বিকাশ, সংগঠনটির আদর্শ ও কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে। যদিও ওই কমিশন গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রাদারহুডের প্রকৃত পরিচয় উদ্ঘাটনে ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করা। প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়, ব্রিটেনে এক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনকে মদদ দিচ্ছে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং তাদের গোপন কর্মকাণ্ডগুলো ব্রিটিশ মূল্যবোধ এবং ব্রিটেনের স্বার্থ ও নিরাপত্তা পরিপন্থী। এর ভিত্তিতে ব্রাদারহুডকে যেন আবার নিষিদ্ধ করা না হয় সেজন্য নাকি ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকদের একরকম শাসানোই হয় যে, সংগঠন নিষিদ্ধ হলে চোরাগোপ্তা হামলা হবে। বলা বাহুল্য, তাতে ভালোই কর্ণপাত করেছিলেন ক্যামেরন। এখন ব্রিটিশ সরকার আলগা খাতির করতে তথা লন্ডনে আশ্রয় নিতে পরোক্ষভাবে মুসলিম ব্রাদারহুড কর্মী-সমর্থকদের উসকাচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার! এ ব্রিটেনই না কয়েকদিন আগে অভিবাসন ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে পৃথক হয়ে গেল; এরাই না মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থী নিতে অনিচ্ছুক; এরাই না এমনকি ইউরোপীয় অভিবাসীদেরও নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে ধীরে ধীরে! কীভাবে তারা ব্রাদারহুডকে বলতে পারল, ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই কর,
লন্ডনের দুয়ার তোমাদের জন্য খোলা! কয়েকটি কারণে এ আহ্বান আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়। সিনিয়র ব্রাদারহুড নেতারা এখনও মিসরের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিআইপি মর্যাদা পান। সেসব ছেড়ে ট্রলারে চড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর তারা পাড়ি দিতে যাবেন কোন দুঃখে? সাম্প্রতিক সময়ে যতগুলো দেশের বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে, প্রতিটি দেশকে সহায়তা ও সহানুভূতি জুগিয়েছে যুক্তরাজ্য। অথচ শারম আল শেখের ঘটনায় মিসর আপ্যায়িত হল ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দ্বারা। ওদিকে মিসরীয় মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাকর্মীদের নিয়ে দুঃখে কতিপয় ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকের প্রাণ যায় যায়। অবশ্যই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের লড়াই নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই আমার। এটাও পরিষ্কার যে, ওবামা বা হিলারি কেউই আইএস সৃষ্টির জন্য দায়ী নন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে যে, সে সম্পর্কগুলো হয়ে উঠেছে একেকটা জটিলতার গুদাম। সেখান থেকে সরল অথচ ভ্রান্ত অনুমান অস্বাভাবিক নয়। এতে সাময়িক অন্ধত্বও সৃষ্টি হতে পারে। সেজন্যই হয়তো ব্রিটিশ সরকার দেখছে না, লন্ডনে সর্বসমক্ষে সারাক্ষণ আইএসের কালো পতাকার ছায়া উড়ছে পতপত করে।
গালফ নিউজ থেকে ভাষান্তর : জায়েদ ইবনে আবুল ফজল
লিন্ডা এস হার্ড : ব্রিটিশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.