খালেদার রাজনীতি by সাজেদুল হক

জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর অনেকটা বাধ্য হয়েই রাজনীতিতে এসেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। তার ভাষায়- ‘রাজনীতি আমি বুঝতাম না।’ ৩রা জানুয়ারি ১৯৮২। রাজনীতিতে অভিষেক হয় বেগম জিয়ার। এরই মধ্যে বিএনপির ভেতরে ষড়যন্ত্রের ডালপালা মেলতে থাকে। বাইরে থেকে কলকাঠি নাড়তে থাকেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রথম বিএনপি ভাঙেন জিয়া সরকারের সাবেক মন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরী ও এম এ মতিন। বিএনপি ভাঙার আরও কয়েকটি প্রচেষ্টাও দেখা যায়। তবে বিচারপতি সাত্তার বেগম জিয়াকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান করতে সমর্থ হওয়ায় সাত্তারের নেতৃত্বাধীন কমিটি মূলধারার বিএনপি হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৮৪ সালের ১লা এপ্রিল বেগম খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১০ই মে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। শুরু হয় বিএনপি এবং বেগম জিয়ার নতুন অধ্যায়।
এই নতুন পথচলায় বেগম জিয়ার ওপর বারবার ঝড়-ঝাপটা এসেছে। কঠোর অনমনীয়তায় তিনি তা মোকাবিলা করেছেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে থেকে বিএনপিকে ক্রমশ তিনি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে পরিণত করেন। দলের ভেতর ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে নেন কঠোর পদক্ষেপ। আর এরশাদের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে থাকেন অনড়। এই ভূমিকা তার জন্য নিয়ে আসে আপসহীন নেত্রীর অভিধা। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ছিল খালেদা জিয়া এবং বিএনপির জন্য টার্নিং পয়েন্ট। ওই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিস্ময়ের জন্ম দেয় বিএনপি। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের শক্ত অবস্থানের কারণে কেউ কেউ আগেই বিএনপির জয়ের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদের শাসনামলকে অনেকেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করেন। সংসদও কার্যকর ছিল তখন। দিনের পর দিন প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়েছে। শেষদিকে অবশ্য পরিস্থিতি বদলে যায়। অকার্যকর হয়ে পড়ে সংসদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে বিরোধীরা। ১৫ই ফেব্রুয়ারির গায়েবি ভোটের কলঙ্ক গায়ে মাখেন খালেদা জিয়া। অবশ্য পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচন দেন সহসাই। ক্ষমতায় যেতে না পারলেও ওই নির্বাচনেও বিএনপি ভালো করেছিল। একশ’র উপরে আসনে জয়ী হয়। ২০০১ সালে এলো আবারও ভূমিধস বিজয়। শুরুটা ভালোই হয়েছিল। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান। কিন্তু পরে সরকারের বিরুদ্ধে উঠতে থাকে দুর্নীতির নানা অভিযোগ। মানুষও তার অনেক কিছু বিশ্বাস করতে শুরু করে। পুরো আন্তর্জাতিক শক্তি দূরে সরে যেতে থাকে বিএনপি থেকে। বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। ওয়ান-ইলেভেন সবকিছু উলটপালট করে দেয়। খালেদা জিয়ার কাছের মানুষরা করেন বিশ্বাসঘাতকতা। সেই ধাক্কা বিএনপি আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বিএনপিরও অনেকে মনে করেন, এখনও বাংলাদেশ চলছে ওয়ান-ইলেভেনের এক্সটেনশনে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেয়ার ইচ্ছা ছিল না খালেদা জিয়ার। নানামুখী চাপে ওই নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য হন তিনি। জামায়াতও চাপ প্রয়োগ করে বিএনপির ওপর। ভোটে যা হওয়ার তাই হয়েছে।
বিপর্যয় আর কাটাতে পারেনি বিএনপি। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবনের দুর্দশাও কাটেনি আজও। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা যান নির্বাসিত অবস্থাতেই। বড় ছেলে তারেক রহমান এখনও দেশের বাইরে। ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনে বিএনপির না যাওয়া সঠিক না ভুল ছিল তা নিয়ে এখনও নানা আলোচনা। কেউ বলেন ভুল। কেউ বলেন সঠিক। অনেক পর্যবেক্ষকই বলে আসছিলেন, কংগ্রেস জমানায় খালেদা জিয়ার ভারত সফরের পর দেশটি তার বাংলাদেশ নীতিতে পরিবর্তন আনছিল। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের সময় খালেদা জিয়া তার সঙ্গে দেখা না করায় বিএনপিকে পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। এ যুক্তির বিরুদ্ধে বিএনপিতেও তেমন কোনো শক্ত মত ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস জমানার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ দিচ্ছেন ভিন্ন সাক্ষ্য। তিনি তার আত্মজীবনী ‘দ্য আদার সাইড অব মাউন্টেইন’-এ লিখেছেন, এ বৈঠক বাতিলের আগেই বাংলাদেশ নীতি প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত। সালমান খুরশিদ লিখেছেন, বিএনপি এবং বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের খুবই উষ্ণতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। খালেদা জিয়া ভারত সফরের সময় প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছিল। সবকিছু চমৎকারভাবেই এগুচ্ছিল। কিন্তু পুরো বিষয়টিই ভেস্তে যায় শাহবাগ আন্দোলনের ফলে। সালমান খুরশিদ শাহবাগ আন্দোলন কথাটি ব্যবহার করেননি। তবে তার বয়ানে বুঝা যায়, তিনি শাহবাগ আন্দোলনের কথাই বুঝিয়েছেন। তার ভাষায়, সরকার সমর্থক যুব শক্তি এবং জামায়াতের কট্টরপন্থিরা রাজপথে মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়। আর তখনই ভারতকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে পর্যবেক্ষকরা এক বাক্যেই স্বীকার করেন, আওয়ামী লীগ শিবির যেসব রাজনৈতিক চাল দিয়েছে তার শক্ত কোনো জবাব বিএনপি জোট দিতে পারেনি। ঢাকার রাজপথে কোনো আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি। সরকারের কঠোর অবস্থান, নেতাদের অনেকের বিক্রি হয়ে যাওয়া এক্ষেত্রে নিয়ামক শক্তির ভূমিকা পালন করেছে। এমনও চাউর আছে, খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসে কী আলোচনা হয় তা মুহূর্তের মধ্যেই নির্ধারিত স্থানে চলে যায়। যে কারণে বিএনপির কোনো অ্যাকশন প্ল্যানই শেষ পর্যন্ত কাজে লাগেনি। প্রতিদ্বন্দ্বী শিবির আগেভাগে পরিকল্পনা জেনে যাওয়ায় আন্দোলন ক্ষেত্রে বিএনপিকে বারবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিতে হয়েছে।  অনেকের বিরুদ্ধেই খালেদা জিয়া ব্যবস্থা নিতে চেয়েছেন। সিদ্ধান্তও হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আর তা কার্যকর করতে পারেননি। দুর্বল সংগঠন, সিদ্ধান্তহীনতা আর সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে না পারা ভুগিয়েছে খালেদা জিয়াকে। তার চেয়েও বেশি ভোগাচ্ছে জাতীয়তাবাদী শিবিরকে। সর্বশেষ কমিটি গঠন নিয়েও অনিশ্চয়তার দোলাচলে ভুগছেন খালেদা জিয়া। কাউন্সিলের দেড় মাস পরও স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করতে পারেনি বিএনপি। দীর্ঘ সময় ভারপ্রাপ্ত থাকার পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির মহাসচিব হয়েছেন। কিন্তু তার মহাসচিব হওয়ার খবর ঘোষণা করেছেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ। যা বিএনপির ভেতর অনেকের মধ্যেই হতাশার জন্ম দিয়েছে। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এখন অনেকটা মহাসচিবের প্যারালাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বলেও কোনো কোনো রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন। দল যখন বিপর্যয়ে, হাজার হাজার নেতাকর্মী যখন হামলা-মামলার শিকার তখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির এক শ্রেণির নেতার বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। বেশকিছু ক্ষেত্রে এর সত্যতাও মিলেছে। কিন্তু বিএনপির হাইকমান্ড এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ব্যবস্থা নিবে বলেও কেউ আশা করেন না। আওয়ামী লীগের ফুলটাইম রাজনীতির বিপরীতে বিএনপির পার্ট-টাইম রাজনীতির কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। চলমান বিপর্যয় থেকে খালেদা জিয়া বের হতে পারেন কি-না তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.