জাপার ভরাডুবির নেপথ্যে... by বেলায়েত হোসাইন

উপজেলা নির্বাচনে সারা দেশে মাত্র একটি চেয়ারম্যান পদে জিতেছিলেন জাতীয় পার্টি সমর্থিত প্রার্থী। সদ্য অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনেও সেই সংখ্যাটিকে অতিক্রম করতে পারেনি দলটি। দলীয় প্রতীকে প্রথম এই স্থানীয় নির্বাচনে মাত্র একটি মেয়র পদ পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে দলটিকে। বেশির ভাগ পৌরসভাতেই জাপা প্রার্থীরা হরিয়েছেন তাদের জামানত। উত্তরাঞ্চলকে এরশাদের দুর্গ বলে চিহ্নিত করা হলেও সেখানেও জাপার মেয়র প্রার্থীদের ব্যাপক ভরাডুবি হয়েছে। রংপুরের বদরগঞ্জে জাপা প্রার্থী মো. লতিফুল খবির পেয়েছেন মাত্র ১৭১ ভোট। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম পৌরসভায় জাতীয় পার্টির আব্দুল হামিদ পেয়েছেন মাত্র ১৩৭ ভোট। শুধু উত্তরাঞ্চলই নয়, দেশের অন্যান্য পৌরসভায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীর ভোটের সংখ্যাও হাতেগোনা। এই বিপর্যয়ের জন্য দলের বিতর্কিত ভূমিকাকেই দায়ী করছেন মাঠপর্যায়ের কর্মীরা। তারা বলছেন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে এরশাদের নাটকীয় অবস্থানের কারণে মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে দলটি। এরপর বিরোধী দল হওয়ার পরও বিতর্কিত ভূমিকা অব্যাহত রয়েছে। জাপার এক কেন্দ্রীয় নেতার মতে, জনগণের হয়ে নয়, বরং সরকারের হয়েই সংসদে ভূমিকা রাখছে জাতীয় পার্টি। এসবই দলকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। আর এজন্যই দলের এই বিপর্যয়। এছাড়া মন্ত্রিসভায় থাকা না থাকা নিয়ে এরশাদ-রওশনের নাটক, দলের সাংগঠিনক দুর্বলতা ও দলীয় এমপিদের প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানকেও দুষছেন তারা। নেতাকর্মীরা বলছেন, স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে জাতীয় পার্টি। জাপার আলাদা কোনো সত্তা এখন আর নেই। জাতীয় মহিলা পার্টির সাধারণ সম্পাদক অনন্যা হোসেন মৌসুমী বলেন, জাপার এই ভরাডুবির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের বিনা ভোটের এমপিরা। তারা সরকারের দালালি করেন।
ওদিকে নির্বাচনের একদিন আগে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সমালোচনা করে এরশাদের দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতের কথা স্পষ্ট জানিয়েছেন তার স্ত্রী রওশন এরশাদ। এক সংবাদ সম্মেলনে বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, এরশাদ দলকে চাঙ্গা রাখার জন্যই এসব বক্তব্য দিয়ে থাকেন। দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, এই ধরনের মন্তব্য করে এরশাদকে জাতির সামনে ছোটই করেননি রওশন, বরং দলের দ্বন্দ্ব আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে এ বক্তব্য স্থানীয়ভাবে জাপা প্রার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলেও মন্তব্য করেন ওই নেতা।
দলীয় সূত্র বলছে, তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই এইচ এম এরশাদ ২৩৪টি পৌরসভায় প্রার্থী দেয়ার ঘোষণা দেন। শেষ পর্যন্ত ৯৩ পৌরসভায় প্রার্থী দেন তিনি। ৯৩ জনের মধ্যেও সবাই নির্বাচনের মাঠে ছিলেন না। মাত্র ৭৪ জন প্রার্থী লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তার বিপরীতে মাত্র ১টি পৌরসভায় জয় পায় দলটি। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী পৌরসভায় লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে ৩১৮০৫ ভোট পেয়ে জয়ী হন আব্দুর রহমান মিয়া। তবে তিনি দাবি করেন, দলের দাপটে নয়, বরং ব্যক্তিগত কর্মের কারণে তিনি জয়ী হয়েছেন। আব্দুর রহমান মিয়া মানবজমিনকে বলেন, আমি দীর্ঘদিন থেকে এ এলাকায় মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। মানুষ আমাকে ভালোবাসেন। এর আগেও মেয়র হয়েছি। ব্যক্তিগত কর্ম ও মানুষের ভালোবাসা নিয়েই দ্বিতীয়বার মেয়র হলাম।
এদিকে নির্বাচনের অনেকদিন আগ থেকেই দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু দেশের বাইরে ছিলেন। এমনকি নির্বাচনের দু’দিন আগে এরশাদও বিদেশ সফরে গিয়েছেন। নেতাকর্মীরা বলছেন, চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের অনুপস্থিতিতে দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পড়েন প্রার্থীরা। তাদের দায়সারা মনোভাব প্রার্থীদের মনোবল অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। এদিকে দলের কেন্দ্রীয় ফোরামের পক্ষ থেকে পুরো নির্বাচন সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন পার্টির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া। কেন এই ভরাডুবি জানতে চাইলে রেজাউল বলেন, বিপর্যয়ের কারণ আমরা এখনও বিশ্লেষণ করে দেখিনি। বিশ্লেষণের পরেই জানা যাবে মানুষ কেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী জিএম কাদের মানবজমিনকে বলেন, প্রথম কথা হলো জাতীয় পার্টি শুধু নামেই বিরোধী দল। এটা যেহেতু দলীয় প্রতীকে নির্বাচন, এখানে জাতীয় রাজনীতির প্রভাব থাকবে। সেক্ষেত্রে সরকার বিরোধীরা জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে মেনে নেবে না। তারা বিএনপিকেই বিরোধী দল হিসেবে মেনে নেবে। তারপরও এরশাদ সাহেবের সুনাম ও প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ইমেজে কিছু প্রার্থী হয়েছিল। তাদের আশা ছিল কিছু ভোট পাবে। এজন্যই দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ন্যাশনাল পারসপেক্টিভে, যেখানে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট নয়, সেখানে ভোট পাওয়া বা ভালো করার সম্ভাবনা কমই ছিল। তবে আমাদের দুর্বল প্রার্থীদের কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করা হলেও শক্তিশালী প্রার্থীদের নানাভাবে বাধার সম্মুখীন করা হয়েছে। তাছাড়া আমাদের দলের চেয়ারম্যান আগেই আশঙ্কা করেছিলেন, এটা কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। ফলাফল আগেই ঘোষণা হয়ে যাবে। জাতীয় পার্টির তরফ থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হয়, তাই করা হয়েছে। প্রার্থীদের জিতে আসতে হবে- এটা কেন্দ্রীয়ভাবেই সিরিয়াসলি নেয়া হয়নি বলে আমার ধারণা।

No comments

Powered by Blogger.