কী বার্তা বয়ে আনল পৌর নির্বাচন? by মিজানুর রহমান খান

পৌর নির্বাচন সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষকদের কাজ বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ে যদি সত্যিকারের জনমতের প্রতিফলন ঘটে, বিএনপির অভিযোগ যদি ভিত্তিহীন হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াবে এই ফলাফলকে বাংলাদেশের সমাজ রূপান্তরের একটি বড় সূচক হিসেবে গণ্য করা যাবে কি না? কারণ, আমরা ১৯৯১ সাল থেকে যে ধারণা পোষণ করে আসছি, সেটা আর বজায় থাকবে না। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা এতকাল বিশ্বাস করে আসছেন যে বাংলাদেশের রাজনীতি বিভক্ত। এটা কেবলই মতাদর্শগত নয়। ভোটের রাজনীতিতেও এর প্রতিফলন ঘটে আসছে। মনে করা হয়ে থাকে, দুই প্রধান দলের মধ্যে ভোটের অঙ্কটা মোটামুটি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে ওঠা–নামা করে থাকে। এই অঙ্কটা অবশ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ধরে অনুমান করা হয়।
আমাদের বোঝা দরকার আওয়ামী লীগের বিজয় ও বিএনপির ভরাডুবি ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু তার স্বরূপটা কী। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩ আসন পেয়েছিল। ২০০৮ সালে তারা মাত্র ২৯ আসন পেলেও ভোটের ব্যবধানে তারা কিন্তু অতটা পিছিয়ে ছিল না। যদি আমরা ধরে নিই যে নৌকা ও ধানের শীষের মধ্যে সাত বছর পরে প্রথম লড়াই হয়েছে; আর জনগণ সেই ঐতিহ্য মেনে ভোট দিয়েছেন, তাহলে কি একটা বিরাট সামাজিক পরিবর্তন ঘটে গেছে না অন্য কিছু হয়েছে! কারণ, বিএনপির ভরাডুবি কেবল মেয়র পদের সংখ্যা হারানোর মধ্যেই সীমিত নয়, তারা অধিকাংশ স্থানে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেও ভোটের ব্যবধানও অনেক বেশি।
এক-এগারোর সুনামিতে বিধ্বস্ত ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১১ সালেও বিএনপি পৌর নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল, যদিও সেই নির্বাচন কাগজে–কলমে অদলীয় ছিল। ২৩৬টি পৌরসভার মধ্যে বিএনপির সমর্থকেরা ৯২টি আর আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা ৮৮টি পৌরসভায় জয়ী হয়েছিলেন। আর এখন তা উল্টে দাঁড়াল ১৭৮ বনাম ২২। তখন অধিকাংশ পৌরসভায় নির্বাচন হয়েছিল তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ।
তখন বলা হয়েছিল যে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতার খেসারত দিয়েছিল। আর বিএনপি ২০০৮ সালের শোচনীয় পরাজয়ের দুই বছরের পরে তৃণমূলে নিজকে শক্তিশালী করে তুলতে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। প্রশ্ন হলো এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অঙ্কটা মাত্র চার বছরের ব্যবধানে উল্টে যেতে পারল? এটা কি বাস্তবসম্মত?
আমরা ফলাফল মূল্যায়নের সূচক হিসেবে যেগুলো বিবেচনায় নিতে পারি, তার সবটাই জাতীয় পর্যায়ের, কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনের ফ্যাক্টরগুলো কীভাবে কতটা কাজ করেছে সেটাও বিবেচ্য। চার বছর আগেও বিএনপির বিরুদ্ধে জঙ্গি ও জামায়াতপ্রীতি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে শিথিল মনোভাব দেখিয়ে চলার অভিযোগ ছিল। এই সময়ে নতুন যুক্ত হয়েছে হিংসাত্মক অবরোধ। বিএনপি একটি হৃদয়হীন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। কিন্তু এরপরও সমাজে যারা বহুকাল ধরে বিএনপির সঙ্গে লেপ্টে থেকেছে, তাদের পাইকারি হারে বিএনপি ত্যাগ করতে দেখিনি। সমাজের বিভিন্ন স্তরে দুই দলের মেরুকরণ ও বিভাজন যেখানে যেভাবে ছিল, সেভাবে অটুট রয়েছে বলে ধারণা করি। বিএনপি বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে অভিযোগ করে আসছে যে তাদের নেতা-কর্মীরা ব্যাপকভাবে হয়রানির সম্মুখীন। বহু স্থানে বিএনপির প্রার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এবং তাঁরা যে একটি ভঙ্গুর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, দুর্বলতর সাংগঠনিক শক্তি এবং প্রতিকূলতার মধ্যে নির্বাচন করেছেন, সে বিষয়েও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসা হলো স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে বিএনপির এই ভূমিধস পরাজয় বাংলাদেশ রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্য কী বার্তা বয়ে আনবে? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্যে সফল হওয়া ও ব্যাপক উন্নয়ন সাধনই কি সরকারি দলের এই ভূমিধস বিজয় নিশ্চিত করেছে? ক্ষমতাসীন দল কি তবে এই নির্বাচনকে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের
সম্ভাব্য ফলাফল হিসেবে দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হতে পারে?
আমরা কি সত্যিই ধরে নেব, ভোটারদের মনোভাবে বিরাট পরিবর্তন এসেছে? আমরা কি সত্যিই ইসির প্রতি আস্থা রাখতে পারি? এই নির্বাচন আগের স্থানীয় সরকারের নির্বাচন, বিশেষ করে ২০১১-এর পৌর নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি বিরোধপূর্ণ ও মলিন হওয়া সত্ত্বেও এর ফলাফলের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল থাকব? এতকাল আমরা জানতাম যে দুই বড় দলের যারা ভোটব্যাংক হিসেবে কাজ করে, তারা সংখ্যায় একেবারে কম নয়। তারা রোদে-বৃষ্টিতে দলের সঙ্গেই থাকে। নেতা-কর্মীরা হরেক রকম কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত হন, কিন্তু দলের টিকিট তাঁদের উতরে দেয়। তাই বিএনপি-জামায়াত জোটের বিগত অপশাসন ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপর্যস্ত হওয়ার দুই বছরের মাথায় তারা বৃহত্তম পৌরশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছিল। তখনো বিএনপির তেমন সাংগঠনিক শক্তি ছিল না। আমরা স্মরণ করতে পারি যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনেও বিএনপি এভাবে বিপর্যস্ত হয়নি। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে বিএনপি কতটা ভালো করেছে, সেই পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিলেন।
২০১১ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। তবে তখন এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনটা করেছিল। ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমরা নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি বজায় রাখার স্বার্থে ২৩৬টি পৌরসভা নির্বাচনকে চার পর্বে ভাগ করে ভোট গ্রহণ করেছিলাম। আমরাও নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলাম। কিন্তু নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন নজরদারিতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়েছিলাম। তাঁরা রিপোর্ট পাঠাতেন, ডিসিরাও রিপোর্ট দিতেন। দুইয়ের মধ্যে অমিল হলে আমাদের কর্মীদের ভাষ্য মেনে নিতাম।’ কিন্তু এবার ইসিকে আপাদমস্তক শিথিল আচরণ করতে দেখা গেছে। একটি আধা বিচারিক সংস্থা হিসেবে প্রিন্সিপাল অব ন্যাচারাল জাস্টিস অনুসরণ থেকে তারা অনেক দূরে ছিল।
তবে সন্দেহের অবকাশ কম যে ২০১১ ও ২০১৫ সালের দুটি নির্বাচন প্রমাণ করেছে যে দলীয় শৃঙ্খলায় বিরাট ধস নেমেছে। বিদ্রোহী প্রার্থীরা এবারও তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়েছেন। যদিও ‘বিদ্রোহ দমনেই’ আওয়ামী লীগ প্রধানত দলীয় প্রতীকে নির্বাচন প্রথা চালু করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। কারণ ক্ষমতাসীন দলের ১৭ জন বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এঁদের ঠেকাতে ও ‘দলীয় শৃঙ্খলা’ রক্ষায় এরপর কি আমরা ৭০ অনুচ্ছেদের মতো বিধান পাব? নাকি এক-এগারোতে হুদা কমিশনের পরামর্শে অধ্যাদেশ দিয়ে চালু করা এবং পরে সংসদ দ্বারা পরিত্যক্ত সেই বিধানটি ফিরিয়ে আনতে হবে, যেখানে দলের তৃণমূলের ভোটে প্রার্থী মনোনয়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল?
নির্বাচন সম্পর্কে বিএনপির অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে বা না নিয়েও আমরা লক্ষ করি যে নির্বাচনী অনিয়মের বিরুদ্ধে কোথাও জোরালো কণ্ঠ শুনিনি। এর অন্যতম কারণ হতে পারে আমজনতা কার স্বার্থে লড়বে? কিসের জন্য ঝুঁকি নেবে? মোটা দাগে প্রার্থীদের একটি বড় অংশ অজনপ্রিয় বা কম জনপ্রিয়। সুতরাং তাদের দুঃখে জনগণের মন কাঁদে না। বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের একটি বিপুল অংশ মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়ে আগে থেকেই কোণঠাসা, যা ২০১১ সালে ছিল না। তদুপরি বিএনপির কারচুপির অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলেও তার দলীয় স্বার্থ রক্ষায় মানুষ রাস্তায় নামবে না।
অবশ্য মানুষের ভোটাধিকার যেখানেই খর্ব হয়েছে, সেখানকার মানুষ অসুখী হয়ে থাকবে। তারা এটা ভুলবে না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.