দেশ এগোচ্ছে, কিন্তু রাজনীতিটাই আছে পিছিয়ে by সোহরাব হাসান

এক দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশ নিয়ে তিনটি আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইআরআই (ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট) বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি জনমত জরিপ প্রকাশ করে। পরদিন বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রকাশ করে দুর্নীতির ধারণাসূচক বা সিপিআই-২০১৫ (করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স) প্রতিবেদন। এতে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় আমাদের অবস্থান ১৩তম। অন্যদিকে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়, তা মোটেই সুখকর নয়। এতে বলা হয়, গত বছর মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর প্রচণ্ড আঘাত আসে। সেক্যুলার ব্লগার ও বিদেশি ত্রাণকর্মীদের নিশানা বানায় কট্টরপন্থীরা। আর গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কর্মীদের ওপর জবরদস্তির পাশাপাশি আদালত অবমাননার অভিযোগ বা অস্পষ্ট আইনের আওতায় তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করে সরকার।
তিনটি প্রতিবেদনের ধরন ভিন্ন হলেও একটি অভিন্ন সূত্র আছে—গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। এই তিনের মধ্যে আইআরআইয়ের জরিপটি এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে এটি দেশের রাজনীতির হিসাবনিকাশ অনেকটাই বদলে দিয়েছে। আইআরআইয়ের জরিপের শিরোনাম: ‘অপটিমিজম গ্রোয়িং ফর বাংলাদেশস ইকোনমিক ফিউচার’। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য আশা বাড়ছে। ভোট দেওয়ার বয়স হয়েছে, এমন ২ হাজার ৫৫০ জনের মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। আইআরআই গত তিন বছরে বাংলাদেশ নিয়ে যে চারটি জরিপ করেছে, তার ধারাবাহিকতা নিয়ে যেকোনো নাগরিক প্রশ্ন তুলতে পারেন। ২০১৪ সালের পর নেওয়া জরিপ যেমন সরকারের সব কাজকে নাকচ করে দিয়েছিল, তেমনি এবারে বলা যায় সব কাজকেই ‘অনুমোদন’ দিয়েছে। এতে বিরোধী মহল বেজার হলেও সরকারি মহল উৎসাহিত হবে। গত সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে আইআরআইয়ের জরিপ নিয়ে আড়াই ঘণ্টা আলোচনা হয়।
জরিপে দেখা যায় যে ৬২ শতাংশ মানুষ মনে করে বাংলাদেশ সঠিক পথেই চলছে। এর কারণ হিসেবে তারা অধিক উন্নয়ন, ভালো অর্থনীতি, জোরদার নিরাপত্তা, শিক্ষা ও আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নের কথা বলেছেন। জুন ২০১৩ ও ৬ জুন ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৩ ও ৩৫ শতাংশ। কিন্তু যে তথ্যটি ক্ষমতাসীনদের অস্বস্তির কারণ সেটি হলো এখনো ৬৮ শতাংশ মানুষ চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। পক্ষান্তরে মাত্র ২৩ শতাংশ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন। গত জরিপে ৬৭ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে এবং ২২ শতাংশ মানুষ বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন।
জরিপে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। প্রথম চমকপ্রদ তথ্যটি হলো, জরিপে অংশগ্রহণকারীরা যেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে অনুমোদন করেন, তার অগ্রভাগে রয়েছে সেনাবাহিনী (৮৬ শতাংশ), গণমাধ্যম (৮৩ শতাংশ), নাগরিক সমাজ (৮০ শতাংশ)। আর শেষের দিকে রয়েছে জাতীয় সংসদ (২১ শতাংশ), বিরোধী দল (৪১ শতাংশ), পুলিশ (৪৩ শতাংশ)। মাঝামাঝি অবস্থানে আছে আদালত (৭৩ শতাংশ), উপজেলা (৭৪ শতাংশ), প্রধানমন্ত্রী (৬৭ শতাংশ)। প্রধানমন্ত্রী সূচক ৬৭ হলেও সরকারের সূচক এক ধাপ নিচে ৬৬ শতাংশ। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে শিক্ষার উন্নয়ন ৭৩ শতাংশ, স্বাস্থ্যসেবা ৭৩ শতাংশ, অবকাঠামো নির্মাণ ৭৩ শতাংশ, নারী-পুরুষের সমতা রক্ষা ৭২ শতাংশ মানুষ সমর্থন জানিয়েছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, দেশের প্রধান সমস্যা কী? জবাবে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, দুর্নীতি। এরপর অবকাঠামো ১৭ শতাংশ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব এসেছে ৩ নম্বরে, মাত্র ১৩ শতাংশ।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে পছন্দ করার কথা বলেছেন ৬০ শতাংশ মানুষ আর বিএনপিকে ৪২ শতাংশ। বিএনপিকে অপছন্দ করেছেন ৪৬ শতাংশ আওয়ামী লীগকে ২৯ শতাংশ। জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী—দুটো দলকেই অপছন্দ করেছেন ৬০ শতাংশ মানুষ। আওয়ামী লীগের শিক্ষা কর্মসূচিকে যথাযথ মনে করেন ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা, আর বিএনপির শিক্ষা কর্মসূচিকে সমর্থন করেন ২৭ শতাংশ। অবকাঠামো উন্নয়নে আওয়ামী লীগের পক্ষে ৫৩ শতাংশ, বিএনপির পক্ষে ২৩ শতাংশ; স্বাস্থ্যসেবায় আওয়ামী লীগের পক্ষে ৪১ শতাংশ, বিএনপির পক্ষে ২৩ শতাংশ মানুষ; অর্থনৈতিক নীতিতে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছেন ৪৪ শতাংশ, বিএনপিকে ২৮ শতাংশ মানুষ। রাজনৈতিক স্থিতি আনতে আওয়ামী লীগের পক্ষে ৪১ শতাংশ, বিএনপির পক্ষে ২৫ শতাংশ; শক্তিশালী নেতৃত্ব অর্জনে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৫৪ শতাংশের সমর্থন, বিএনপি ২২ শতাংশ। তবে ২৪ শতাংশ বলেছেন কোনো দলের প্রতি তাঁদের আস্থা নেই। তরুণ নেতৃত্ব গঠনে আওয়ামী লীগের সূচক ৫১, বিএনপির ২৩; নারীর ক্ষমতায়নে আওয়ামী লীগ ৪৯ ও বিএনপি ২৪; গরিববান্ধব কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ ৪২ শতাংশ ও বিএনপি ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিটি সূচকেই আওয়ামী লীগ এগিয়ে আছে।
এ ছাড়া জরিপে একটি প্রশ্ন ছিল পরিবার মৌলিক চাহিদা (চাল, দুধ, ডিম, মাছ, ডাল ইত্যাদি) পূরণে সক্ষম হচ্ছে কি না? এ প্রশ্নে জবাবে ৪৮ শতাংশ হ্যাঁ বলেছেন। সক্ষম নয় জানিয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে ছিল ২১ শতাংশ।
গণতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ বলেছেন ৫৯ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে ছিল ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ জরিপ থেকে আমরা এই সিদ্ধান্ত টানতে পারি না যে গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেছে। যাঁরা কম গণতন্ত্র দিয়ে বেশি উন্নয়নের কথা ভাবছেন, তাঁরা যে জনগণের মনের ভাষা পড়তে অপারগ, সেই সত্যটিই বেরিয়ে এসেছে এই জরিপে। মানুষ গণতন্ত্র ও উন্নয়ন দুটোই চায়। এতে বলা হয়, ২০১৪ সালের জুনের করা জরিপে ৬৮ শতাংশ মানুষ গণতন্ত্রকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন। এবার তা কমে ৫১ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। গত জরিপে উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন ২৭ শতাংশ, এবার ৪৫ শতাংশ উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আবার ৮৮ শতাংশ মনে করেন গণতন্ত্রে সমস্যা থাকলেও অন্য যেকোনো ধরনের সরকারের চেয়ে এটা উত্তম।
জরিপের ফলাফল বলছে, প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ মনে করেন বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব ভালো বা মোটামুটি ভালো। এর মধ্যে ৭২ শতাংশ মানুষ আশা করছেন, আগামী বছর তাঁদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে। জরিপে আরও দেখা গেছে, সরকারের পদক্ষেপগুলো ৭২ শতাংশ মানুষ সমর্থন করছেন। গত জুনের চেয়ে এটা ৬ শতাংশ বেশি।
কিন্তু জরিপে যে দুটি বিষয়ে অসংগতি মনে হয়েছে তা হলো, কোন সূত্র থেকে খবর পান এই প্রশ্নের জবাবে ৮১ শতাংশ বলেছেন টিভি, মুখে মুখে শুনে খবর পান ১৩ শতাংশ। এর বিপরীতে সংবাদপত্র থেকে মাত্র ২ শতাংশ, সামাজিক গণমাধ্যম থেকে ২ শতাংশ, বেতার মাধ্যম থেকে ২ শতাংশ ও অনলাইন থেকে ১ শতাংশের খবর পাওয়া অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়। অন্যদিকে জরিপে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও সুষ্ঠু বলে মনে করেন ৫৯ শতাংশ মানুষ। আবার সেই নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা না রেখে ৬৮ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে পেতে চাইছে। বিষয়টি স্ববিরোধী।
রাজনৈতিক দলগুলো এ জরিপকে বিচার করবে নিজের লাভালাভের ভিত্তিতে। যদি তারা মনে করে জরিপটি তাদের বিপক্ষে গেছে, তাহলে এর মধ্যে ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজবে। আর যদি পক্ষে যায়, সেটি জোরেশোরে প্রচার করবে। যেমন টিআইএর প্রতিবেদনের সমালোচনা করে সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা বলেছেন, ‘ওরা আমাদের ভালো দেখতে পারে না বলেই খুঁত ধরে।’ আবার বিএনপির নেতারা টিআইয়ের প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘দুর্নীতিতে এক ধাপ নিচে নেমেছে। গুম-খুন জরিপ হলে বাংলাদেশ প্রথম হতো।’ কিন্তু তাঁরা হয়তো ভুলে গেছেন যে বিএনপি সরকারের আমলেই টিআইএর সূচকে বাংলাদেশ পর পর চারবার দুর্নীতিতে প্রথম হয়েছিল। তার আগে আওয়ামী লীগ আমলেও আমরা একবার এই ‘শিরোপা’ পেয়েছিলাম।
আইআরআইয়ের সাম্প্রতিক জরিপ বিরোধী দলকে হতাশ করবে সন্দেহ নেই। কিন্তু সরকারি দলেরও খুব উৎসাহিত হওয়ার কারণ দেখি না। তারা যদি জরিপের অর্থনৈতিক অংশকে স্বাগত জানায় তাহলে রাজনৈতিক অংশকে নাকচ করে দিতে পারে না। একই জরিপ থেকেই দুটো ধারণা এসেছে। ক্ষমতাসীনদের দাবি, তারা দেশের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করছেন। মানুষ অনেক ভালো আছে। তারা আরেকটু বেশি ভালো থাকত, যদি রাজনীতিটা সুস্থধারায় চলত; যদি পাঁচ বছর পরপর আমরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারতাম। সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টারা মানুষ ভালো আছে বলে যে অভয়বাণী আওড়াচ্ছেন, তাও কিন্তু নিষ্ফল রোদনে পরিণত হতে বাধ্য, যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টেকসই না হয়। মধ্য আয়ের স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশে তো ‘নিম্নমানের’ নির্বাচন হতে পারে না। যে জাতি তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিতে উন্নীত হতে পারে, সেই জাতি একটি ভালো নির্বাচন কেন করতে পারবে না?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান গত বৃহস্পতিবার এক সেমিনারে বলেছেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন, নাগরিক ও মৌলিক স্বাধীনতা এবং জবাবদিহি—এই চারটি সূচকের ভিত্তিতে গণতন্ত্রের অগ্রগতি সম্ভব।’ এই চার সূচকের প্রথম ও প্রধান শর্তই
হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও বলেছেন, ‘মানবিক প্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নতি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।’
সেই যুক্ত সম্পর্ককে বিযুক্ত করলে দেশের প্রভূত উন্নতি সত্ত্বেও রাজনৈতিক ‘সুনামির’ সমূহ আশঙ্কা আছে। কেবল আইআরআইয়ের জরিপ নয়, দেশি–বিদেশি সব পরিসংখ্যানই বলছে, বাংলাদেশ এগোচ্ছে। মানুষ খেয়ে–পরে ভালো আছে। কিন্তু দেশ পরিচালনা করে যে রাজনীতি, সেটাই আছে পিছিয়ে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.