ডোনাল্ড ট্রাম্প ও আজকের আমেরিকা by হাসান ফেরদৌস

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হেন নাম নেই যে নামে ডাকা হয়নি। কেউ তাঁকে বলেছেন ফ্যাসিস্ট, কেউ বলেছেন হিটলার। উন্মাদ নামেও তাঁকে ডাকা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা ও জর্জ বুশ উভয়েই ট্রাম্পকে কষে গাল দিয়েছেন, কারণ তাঁর বক্তব্য ‘মার্কিন মূল্যবোধবিরোধী’। মার্কিন সিনেটে রিপাবলিকান দলের নেতা সিনেটর মিচ ম্যাককনেল কিঞ্চিৎ রুষ্ট হয়ে বলেছেন, না না এসব কথা বলা ঠিক নয়। আমরা যুদ্ধের ভেতর রয়েছি, এখন দেশের মানুষকে বিভক্ত করা ঠিক নয়। কংগ্রেসের রিপাবলিকান স্পিকার পল রায়ান বলেছেন, ট্রাম্প যা বলেছেন, সেসব আমাদের দলের নীতির বিরুদ্ধে যায়।
মজার ব্যাপার হলো, লোকে ট্রাম্পকে যত গালি দেয়, তাঁর জনপ্রিয়তা তত বাড়ে। কেউ যদি ভেবে থাকে লোকটা পাগল, তাহলে তারা ভুল করবে। ট্রাম্প অতি ঘাগু লোক, তিনি জানেন এ দেশের মানুষের কাছে কী চলবে, কী চলবে না। মুখে যত ভালো ভালো কথা বলা হোক না কেন, আমেরিকার একদল মানুষ ট্রাম্পকে মাথায় তুলে নাচছে, কারণ যে কথা তারা বিশ্বাস করে, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে সাহস পায় না, ট্রাম্প সেই কাজটিই করেছেন। যেমন দক্ষিণপন্থী ভাষ্যকার লরা ইংগ্রাম বলেছেন, যে যা-ই বলুক, এই লোক আমেরিকার মানুষের ‘পালস’ জানে।
ট্রাম্প প্রস্তাব করেছেন, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে আমেরিকার চলতি যুদ্ধ মিটে না যাওয়া পর্যন্ত এ দেশে কোনো মুসলমানকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। মুসলমান মাত্রই সন্ত্রাসী—এই সন্দেহ থেকে ট্রাম্প আমেরিকার সব মুসলমানের নাম তালিকাভুক্ত করতে বলেছেন। মসজিদগুলো সন্ত্রাসীদের আখড়া, অতএব তাদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে, দরকার পড়লে বন্ধ করে দিতে হবে। তাঁর এই বক্তব্য ‘মার্কিন মূল্যবোধের পরিপন্থী এবং শাসনতন্ত্রে স্বীকৃত অধিকারের লঙ্ঘন’, এমন কথা বলাতে ট্রাম্প গলার স্বর বিন্দুমাত্র না উঁচিয়ে জবাব দিয়েছেন, কেন, ঠিক সেই কাজ তো প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট করেছিলেন, পার্ল হারবারে জাপানি আক্রমণের পর এ দেশের সব জাপানিকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ঢুকিয়েছিলেন। কই, তাঁকে তো কেউ হিটলার বলে গাল দেয় না? সেটা যুদ্ধের সময় ছিল, এখনো তো একটা যুদ্ধের ভেতরে আমরা।
কথাটা একদম ফেলে দেওয়ার মতো নয়। রুজভেল্ট ১৯৪২ সালে এক নির্বাহী ঘোষণায় আমেরিকার সোয়া লাখ জাপানি নাগরিককে যার যার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পাহারা দেওয়া ক্যাম্পে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তকে আমেরিকার ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ১৯৮৮ সালে মার্কিন কংগ্রেস এক সিদ্ধান্তে আটককৃত প্রত্যেক জাপানির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায় এবং তাদের প্রত্যেকের জন্য ২০ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ মঞ্জুর করে।
একসময় যে ভুল হয়েছিল, এত দিন পর আবার সেই ভুলেরই কেন পুনরাবৃত্তি করতে হবে?
একটা কথা এখানে আমাদের মাথায় রাখা দরকার। ট্রাম্প নামক এই আপদের আবির্ভাব ঠিক আকস্মিকভাবে হয়নি। একদম শূন্য থেকেও ট্রাম্প তাঁর মুসলমান ও অভিবাসীবিরোধী বক্তব্য দেননি। এক দশক ধরে এ দেশের রিপাবলিকান পার্টি খুব পরিকল্পিতভাবে অতি দক্ষিণপন্থী মনোভাব লালন করেছে। আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টের হোয়াইট হাউসে প্রবেশ ও আমেরিকার জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়াতেই তারা নিজেদের ‘বেইস’ সামলাতে এ পথে এগিয়েছে। মার্কিন জনসংখ্যায় হিস্পানিকদের অংশ ক্রমেই বাড়ছে, এতটা বাড়ছে যে ২০৪০ সালের মধ্যে আমেরিকার অধিকাংশ মানুষ হবে অ-শ্বেতাঙ্গ। এ কথার অর্থ, যে দেশটা এত দিন তাদের বলে রাজত্ব করেছে সাদা মানুষ, ক্ষমতার চাবির গোছা তাদের হাত থেকে পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সে কারণে এ দেশের সাদা মানুষদের যত রাগ কালো ও বাদামিদের ওপর। বারাক ওবামা সেসব মানুষের একজন, তাঁর ওপর রাগের সেটাই বড় কারণ।
রিপাবলিকানদের ওবামাবিরোধী ও অভিবাসনবিরোধী এই অবস্থান কাজে লেগেছে, আমেরিকার নির্বাচনী ফলাফল থেকেই তা বোঝা যায়। গত এক দশকে এক প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়া আমেরিকার কংগ্রেসের উভয় পরিষদ রিপাবলিকানদের দখলে চলে এসেছে। দেশের রাজ্য পর্যায়ে গভর্নর ও আইন পরিষদ, উভয় ক্ষেত্রেই রিপাবলিকানদের একচ্ছত্র আধিপত্য। বিচার বিভাগেও এখন রক্ষণশীলদের প্রাধান্য।
যারা হোয়াইট হাউসে একজন ডেমোক্র্যাট পরপর দুবার নির্বাচিত হওয়ায় দেশটাকে উদারনৈতিক ভাবে, তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে আনে না। আমেরিকার রাজনৈতিক মানচিত্র এমন অদ্ভুত যে কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসীদের অধিকাংশই আটলান্টিকের পূর্ব পাড়ে ও প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম তীরঘেঁষা শহরপ্রধান রাজ্যগুলোতে বাস করে। ফলে গুটি কয়েক ছাড়া আমেরিকার অধিকাংশ রাজ্যেই ‘লাল’ রিপাবলিকানদের আধিপত্য। কোনো কোনো রাজ্য অভিবাসীদের আগমনের ফলে লাল থেকে পাটকেলে রং ধরতে শুরু করেছে, তবে তার ফল পেতে আরও আট-দশ বছর অপেক্ষা করতে হবে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে এই লাল-নীল বিভক্তির বড় কোনো পরিবর্তন হবে না, এ কথা আগাম বলে দেওয়া যায়। তবে মোট ভোটের হিসাবে একা ‘লাল’ ভোটে প্রেসিডেন্ট হওয়া কঠিন, ফলে অনেকেই ধরে নিয়েছে ওবামার মতো আরও একজন ডেমোক্র্যাট এবারও প্রেসিডেন্ট হবেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে শুরু করে চলতি রিপাবলিকান নেতৃত্বের সব বাঘা বাঘা প্রতিনিধি আমেরিকার এই জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের কথা জানেন। শুধু সাদা মানুষের ভোটে হোয়াইট হাউস দখলে আনা যাবে না, এ কথাও তাঁরা জানেন। তা সত্ত্বেও শুধু সাদা মানুষদের খুশি করা যায়, এমন নীতি তাঁরা অনুসরণ করে চলেছেন, যার মূলে রয়েছে সব রকম অশ্বেতাঙ্গদের ব্যাপারে ভীতি। এই অশ্বেতাঙ্গদের তালিকায় যেমন আফ্রিকান-আমেরিকান আছে, তেমনি আছে মেক্সিকান ও অন্যান্য বহিরাগত। এর সঙ্গে এখন যোগ করুন মুসলমানদের। অনুমান করি, রিপাবলিকান দল হিসাব করে দেখেছে, ভীতিভিত্তিক যে বর্ণ বিভাজন, তা যদি শ্বেতাঙ্গ মনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে যে ‘শ্বেত ঐক্য’ গড়ে উঠবে, শুধু তা দিয়েই হয়তো কোনো রিপাবলিকান প্রার্থী হোয়াইট হাউস ছিনিয়ে নেবেন।
আমি যে একদম গালগপ্প করছি না, তা বোঝার জন্য পাঁড় বর্ণবাদী ভাষ্যকার অ্যান কুলটার একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি। ট্রাম্প মুসলমানদের নিষিদ্ধ করার যে প্রস্তাব করেছেন, তাকে সোল্লাসে সমর্থন করে কুলটার লিখেছেন, শুধু মুসলিম কেন, এর সঙ্গে তাবৎ ‘ইমিগ্রান্ট’দের যোগ করুন, তাতে খেলা জমবে ভালো। (‘অ্যাড ইন এভরি আদার কাইন্ড অব ইমিগ্রান্ট অ্যান্ড ইটস পারফেক্ট!)।
মনে রাখা ভালো, ট্রাম্প শুধু মুসলমানবিরোধী নন, তিনি কালো ও অশ্বেতাঙ্গ সব অভিবাসীকে একই তালিকাভুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে নিজের ক্রুসেড ঘোষণা করেছেন। নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম পর্যায়ে তাঁর আক্রমণের এক নম্বর লক্ষ্যবস্তু ছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। এই লোকটা বিদেশি, তাঁর জন্ম বিদেশে, ধর্মেও কিনি খ্রিষ্টান নন—এমন কথা বলে তিনি প্রথম শ্বেতাঙ্গদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর মেক্সিকানসহ দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা সব অভিবাসীকে তিনি এক কথায় ধর্ষক ও মাদক চোরাচালানকারী বলে রায় দিয়ে বসেন। আর তারপর টার্গেট করেন মুসলমানদের।
তাঁর কথা যে শ্বেতপ্রধান রিপাবলিকান সমর্থকদের মনে ধরেছে, সাম্প্রতিক জনমত জরিপ থেকেই তার প্রমাণ মিলেছে। এবিসি টেলিভিশন এবং নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সর্বশেষ জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, এই দলের ৪২ শতাংশ মানুষ ট্রাম্পের মুসলিমবিরোধী ও অভিবাসীবিরোধী অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন এমন রিপাবলিকান সদস্য মাত্র ৩২ শতাংশ। যাঁরা সরাসরি ট্রাম্পকে সমর্থন দিতে অনিচ্ছুক, তাঁদের অধিকাংশ বলছেন, ট্রাম্পের বক্তব্য অস্বস্তিকর, কিন্তু এ কথা তো ঠিক যে তিনি সত্যি কথাই বলেছেন। ট্রাম্প গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আমাদের নজর দিতে বাধ্য করেছেন, এমন কথা ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরাও কবুল করেছেন (যেমন সিনেটর টেড ক্রুজ)।
এই জনমত জরিপের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, সারা দুনিয়া ট্রাম্পকে ছি ছি করলে কী হবে, তিনি নিজে ঠিক ধরতে পেরেছেন যে তাঁর প্রস্তাবের ফলে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর লড়াইয়ে তিনি পিছু হটার বদলে সামনেই এগোবেন।
ট্রাম্প আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন, এ কথা কেউ ভাবেন না। কিন্তু এই অতি চতুর ক্যাসিনো ব্যবসায়ী যে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে পারেন, সেই সম্ভাবনা যে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত একটা ব্যাপার, এ কথা এই দলের নেতারাই মানতে শুরু করেছেন। এটি দলের জন্য ভয়াবহ হবে, এ কথাও তাঁরা মানেন, কিন্তু কেউই সে কথা মুখ ফুটে বলছেন না। ট্রাম্প নিজে বলেছেন, কোনো কারণে দলের কর্তাব্যক্তিদের ষড়যন্ত্রে তিনি যদি দলের মনোনয়ন না পান, তাহলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কথা তিনি বাতিল করতে পারেন না। সে ভয় থেকেই দলের সব কর্তা এখন বলছেন, রিপাবলিকান কনভেনশনে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন, তাঁকেই তাঁরা সমর্থন জানাবেন।
সত্যি যদি তাই ঘটে, অর্থাৎ ট্রাম্প রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন, তাহলে সে কথার অর্থ দাঁড়াবে এই যে একুশ শতকের শুরুতে এসে আমেরিকা এমন একজন লোককে তার প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবে, যিনি হবেন হিটলার ও মুসোলিনির যোগ্য উত্তরসূরি।
এই লজ্জা কী দিয়ে ঢাকবে আমেরিকা?
গত বুধবার আমেরিকার দাসপ্রথা অবসানের ১৫০তম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রকারান্তরে সে কথাই তুলেছিলেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, আমাদের প্রত্যেকের মুক্তি ও স্বাধীনতা একে ওপরের মুক্তি ও স্বাধীনতার ওপর নির্ভরশীল—আমাদের গাত্রবর্ণ, জন্মস্থান বা ধর্ম যা-ই হোক না কেন। ভয় ও ঘৃণাকে জয় করতে দিলে আমেরিকা তার নিজের ইতিহাস ও মূল্যবোধই বিসর্জন দেবে।
ভয় হয়, আমেরিকা হয়তো সে পথেই এগোচ্ছে।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.