বাজারের কোনো অদৃশ্য হাত নেই

বহুদিন ধরে মূলধারার অর্থনীতির অন্তর্নিহিত পূর্বানুমান হচ্ছে, অর্থনীতিতে এক অদৃশ্য হাত খুব মসৃণভাবে তার জাদু দেখিয়ে যাচ্ছে। সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি হলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়, আবার উল্টোটা হলে দাম কমে যায়। আর এর মধ্য দিয়ে বাজার স্থিতিশীল হয়। নিশ্চিতভাবে অনেক পর্যবেক্ষকই বুঝতে পেরেছেন, সত্যটা ঠিক এর বিপরীত। মানে হলো, পণ্যের মূল্য, মজুরি ও বিশেষ করে সুদের হার কখনো কখনো খুব ধীরগতিতে পরিবর্তিত হয়, যেটা কখনো কখনো বাজারকে পরিষ্কার হতে দেয় না। শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে এর মাজেজা হলো, বেকার শ্রমিকদের দীর্ঘদিন কাজ খুঁজতে হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রের অন্যদের কথা হচ্ছে, তাঁদের সহকর্মীরা যেটাকে ‘বেকারত্ব’ বলছেন তার আসলে অস্তিত্বই নেই। এই ব্যাপারটা স্বতঃপ্রণোদিত, কারণ কিছু কিছু একগুঁয়ে প্রকৃতির শ্রমিক বিদ্যমান মজুরিতে কাজ করতে রাজি হয় না। যে মানুষেরা ব্যক্তি ইচ্ছা-নিরপেক্ষ বেকারত্বের ধরন বোঝেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জন ম্যানিয়ার্ড কেইনস ও আর্থার লুইস। এঁরা এই বিষয়টিকে দ্বৈত অর্থনীতির মডেলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যেখানে শহরে শ্রমিকের সংখ্যাধিক্য থাকলেও তাঁদের মজুরির তারতম্য হয় না, আর শহুরে শ্রমিকদের মজুরি গ্রামের শ্রমিকদের চেয়ে বেশি থাকে। কেইনস ও লুইস উভয়ই তাঁদের কাজে এই মূল্যের পরিবর্তনবিমুখতা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তাঁদের কাছেও এই ধারণাটা স্রেফ পূর্বানুমান ছিল, তাঁরা কখনো এটা বোঝাতে পারেননি, মজুরি ও সুদের হার কেন প্রায়ই চাহিদা ও সরবরাহের চাপকে প্রতিহত করে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিৎস এই ধাঁধার সমাধান দিয়েছেন, তিনি এ বছর শিক্ষকতার ৫০ বছর উদ্যাপন করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, কেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে মূল্যের পরিবর্তন হয় না, যে কারণে বাজারের কার্যকারিতা কমে যায়, আর পরিণামে অদৃশ্য হাতের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। স্টিগলিৎস এ প্রসঙ্গে বলেছেন, অদৃশ্য হাত ‘এই অর্থে কিঞ্চিৎ অদৃশ্য যে সেটা আসলে নেই’। স্টিগলিৎস এক উল্লেখযোগ্য ১০ বছর কালের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের যুক্তিমালা সাজিয়েছেন। ১৯৭৪ সালে স্টিগলিৎস শ্রমিকদের ঝরে পড়ার ওপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কেন মজুরির হার অপরিবর্তিত থাকে। উন্নয়ন অর্থনীতির জন্য তাঁর এই গবেষণার বেশ গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে, আমি ওটা প্রায়ই ব্যবহার করে থাকি। এরপর তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, যার মধ্যে ক্রেডিট রেশনিংয়ের ওপর একটি নিবন্ধ, সুদের হারে অপরিবর্তনশীলতা ও এফিসিয়েন্সি ওয়েজের ওপর আরেকটি নিবন্ধও ছিল। তারপর ১৯৮৪ সালে তিনি কার্ল শাপিরোর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ কারণে সৃষ্ট বেকারত্বের ওপর এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। অন্যান্য অর্থনীতিবিদের কাজও এই মূল্যের অপরিবর্তনশীলতার ওপর গবেষণার ভিত্তি রচনা করেছে। কিন্তু ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে স্টিগলিৎস যেসব কাজ করেছেন, তা বাজার-সংক্রান্ত সামষ্টিক অর্থনীতির চিন্তাকাঠামো বদলে দেয়। অপরিবর্তনশীল মূল্য-সংক্রান্ত স্টিগলিৎস যেসব যুক্তি দিয়েছেন তার অন্তর্জ্ঞান কিন্তু খুবই সাধারণ। কাজে ফাঁকি দেওয়ার কোনো শাস্তি যদি না থাকে, তাহলে লোকে হরহামেশাই কাজে ফাঁকি দেয়। আর কর্মস্থলে কাজে ফাঁকি দেওয়ার সবচেয়ে অভিন্ন শাস্তি হচ্ছে চাকরি হারানোর ঝুঁকির মধ্যে থাকা। কিন্তু কর্মীরা যদি চাকরি চলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি কাজ খুঁজে পায়, তাহলে তাদের চাকরি খাওয়ার হুমকি দিয়ে কোনো কাজ হয় না। কাজে ফাঁকি না দেওয়ার প্রণোদনা হিসেবে যদি কর্মীকে বাজারের চেয়ে বেশি বেতন দেওয়া হলে চাকরি হারানোর মূল্য আরও বেড়ে যায়। এটা অবশ্যই সত্য যে এই সূত্র যদি একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে তাহলে সেটা অন্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও কাজ করবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মজুরি বেড়ে যাবে, আর পরিণামে শ্রমিকের সরবরাহ চাহিদার চেয়ে বেড়ে যাবে। অন্যকথায় বললে, বেকারত্বের হার বাড়বে। তারপর যদি সব প্রতিষ্ঠান সমান বেতন দেয়, তাহলে কর্মীদের ছাঁটাই করার হুমকি বেশ কার্যকর হবে, কারণ এতে যে কর্মী কাজ হারাবে, তাঁর বেকার হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। ফলে বাজারে এক সাম্যাবস্থা সৃষ্টি হবে, যেখানে বেকারত্ব থাকবেই, কিন্তু মজুরির হার কমবে না। সংক্ষেপে বললে, এটা হলো শাপিরো-স্টিগলিৎস সাম্যাবস্থা। জ্যানেট ইয়েলেন ১৯৮৪ সালে এই তত্ত্বের ওপর এক চমৎকার সমীক্ষা চালিয়েছিলেন, যার শিরোনাম ছিল ‘এফিসিয়েন্সি ওয়েজ মডেলস অব আন-এমপ্লয়মেন্ট’। হ্যাঁ, স্টিগলিৎসের গবেষণা এখনো প্রভাবশালী হলেও এই ক্ষেত্রে এখনো অনেক কাজ করা সম্ভব। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেভাবে মুদ্রানীতি করা হয়, তা আমাকে হতাশ করেছে। সেসব দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রায়ই শিল্পায়িত দেশের সূত্র নকল করে, তারা এ কথা চিন্তা করে না ওই নীতির কার্যকারিতা সংশ্লিষ্ট দেশের পরিপ্রেক্ষিতের ওপর নির্ভর করে। স্টিগলিৎসের কাজ আমাদের এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে সুদের হার মসৃণভাবে ওঠা-নামা করে—এই ধারণার ভিত্তিতে নীতি প্রণয়নের ঝুঁকিটা কোথায়। সুদের হার কখন বাড়াতে হবে আর কখন কমাতে হব, তার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, তার জন্য আমাদের সৃজনশীল ও বিশ্লেষণী চিন্তা করতে হবে। বিশেষ করে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে তথ্য সংগ্রহে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে, যাতে আরও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে নীতি প্রণয়ন করা যায়। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে আমি বিশ্বব্যাংকে জোসেফ স্টিগলিৎসের সঙ্গে কাজ করেছি, তখন তিনি সেখানে প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করতেন। সে সময় তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে খুবই উত্তপ্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন, বিষয় ছিল পূর্ব এশিয়ায় সংস্থাটির হস্তক্ষেপ। আমি সুস্পষ্টভাবেই বলতে পারি, ওই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি আইএমএফকে বদলে দিয়েছিলেন। আমরা আশা করি, তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ভবিষ্যতেও তেমন প্রভাব ফেলবে, কারণ সেটা আমাদের সব পর্যায়ে আরও বিশ্লেষণী নীতি প্রণয়ন করতে উৎসাহিত করে। (জোসেফ স্টিগলিৎসের শিক্ষকতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ)
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ।

No comments

Powered by Blogger.