শরণার্থীরা কাউকে গুলি করে মারে না

কয়েক সপ্তাহ ধরে মার্কিন রাজনীতিকেরা সিরিয়ার শরণার্থীদের সঙ্গে আগত বিপদ নিয়ে অনেক ফোঁস ফোঁস করছেন, যদিও গত ১২ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের একজন মানুষও শরণার্থীদের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়নি। গত কয়েক সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকধারীদের হামলায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এসব হামলার মধ্যে স্যান বার্নার্দিনোর হামলা ও কলোরাডো স্প্রিংয়ের প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ক্লিনিকে হামলা ছিল সবচেয়ে নাটকীয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে দৈনিক গড়ে প্রায় ৯২ জন ব্যক্তি বন্দুকের গুলিতে মারা যায়, যার মধ্যে আবার আত্মহত্যা, খুন ও দুর্ঘটনাও রয়েছে। সুতরাং রাজনীতিকেরা যদি হুমকি মোকাবিলা করতে চান, তাহলে বন্দুক হামলায় প্রাণনাশ ঠেকানোর লক্ষ্যে নীতি প্রণয়ন করলে কেমন হয়, যার মধ্যে সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ থাকতে পারে, কিন্তু এই নাজুক মানুষকে বলির পাঁঠা বানানো নয়। সিরিয়ার শরণার্থীদের জিহাদি হিসেবে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তারা ‘আমাদের হত্যা করতে চায়।’ কিন্তু যাঁরা এই শরণার্থীদের সঙ্গে সময় কাটান, তাঁরা জানেন, এসব কথার ভিত্তি নেই। লেসবসের সৈকতে পাঠকেরা যদি আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রাবারের নৌকায় গাদাগাদি করে আসা শরণার্থীদের মুখোমুখি হন, তাহলে তাদের প্রতি রূঢ়তা আর থাকবে না। শরণার্থীরা আমাদের মতোই মানুষ, তবে তাদের শরীর ভেজা ও ঠান্ডা, তারা ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। আমাকে যদি সরল মনে হয়, তাহলে এই ১৬ বছর বয়সী সিরিয়ার ছেলেটির সঙ্গে কথা বলুন, যাকে আমি আহমেদ বলে ডাকি। এই ছেলেটি সিরিয়ার আইএস-নিয়ন্ত্রিত ভূমিতে বসবাস করত। তাদের হাতে মার খেয়ে সে পশ্চিমে পালিয়ে এসেছে। আইএস ওই অঞ্চলে ঢোকার পর থেকেই স্কুল বন্ধ, সে কারণে আহমেদ একটি ওষুধের দোকানে কাজ নেয়। কিন্তু একদিন ওর দোকানের ওষুধ ফুরিয়ে গেলে আহমেদ আরেকটি দোকান থেকে কিছু ওষুধ ধার করতে যায়। কিন্তু দোকানটি চালাত এক নারী, যার ক্রেতাও ছিল শুধু নারীরা।
ফলে আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। একসময় ছেলেটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়, কিন্তু তার আগেই সে দেখেছে, আইএস কীভাবে অগণিত মানুষের শিরশ্ছেদ করতে চেয়েছিল। প্রতি শুক্রবার শহরের কেন্দ্রস্থলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, আর সেই দৃশ্য দেখার জন্য মানুষকে সেখানে আহ্বান জানানো হয়। এরপর মরদেহগুলো জনসমক্ষে প্রদর্শন করা হতো, মাঝে মাঝে সেগুলো ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখা হতো। আহমেদ আরও বলে, ‘কেউ যদি পবিত্র রমজান মাসে রোজা না রাখত, তাহলে তাঁকে একটি খাঁচায় ভরে জনসমক্ষে রাখা হতো, তাঁকে সেখানে তিন দিন না খাইয়ে রাখা হতো।’ আহমেদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হয়েছিল, সে নামাজ ফাঁকি দিয়েছে। শাস্তি হিসেবে তাঁকে ২০টি বেত্রাঘাত করা হয়েছিল। এক সৌদি নাগরিক ঘোড়ার চাবুক দিয়ে এই দণ্ড কার্যকর করতেন। এত কিছুর পর আহমেদের পরিবার ওকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে, পাছে ছেলেটিকে না আইএসে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। তাহলে এই ১৬ বছর বয়সী কিশোরকে আমি কী বলব, সে তো চরমপন্থার কবল থেকে বাঁচতে চেয়েছে। আর মার্কিনরাই যে তার ব্যাপারে ভীত, সে ব্যাপারেই বা আমি কী বলব। ওদিকে স্যান বার্নার্দিনোতে যে হত্যাকাণ্ড হলো, তার জন্যও এই শরণার্থীদের প্রতি মার্কিনদের সন্দেহ বাড়বে। আর নির্বাচন এলে তো রাজনীতিকেরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভোটারদের ভীতি বাড়িয়ে দেন। এদিকে লেসবসের সৈকতে সিরিয়ার শরণার্থীরা যে প্রাথমিক চিকিৎসাকর্মীদের সাক্ষাৎ পায়, তারা ছিল ইসরায়েলি। এতে তারা কিছুটা বিস্মিত হলেও একরকম আনন্দিতই হয়েছিল, এই কর্মীরা ইসরাএইড নামের একটি সংগঠনের কর্মী। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে মার্কিনরা বাইরের মানুষদের ভুল করে হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৯৩৮ ও তারপর ১৯৪১ সালে এক বেপরোয়া হয়ে ওঠা ইহুদি পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী মর্যাদা চেয়েছিল, কিন্তু আরও হাজার হাজার পরিবারের সঙ্গে তারাও সেটা পায়নি।
সেটা ছিল আনা ফ্রাঙ্কের পরিবার। ফলে নাৎসিরা আনাকে হত্যা করলেও তার দায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও বর্তায়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের শরণার্থী-বিষয়ক কর্মকর্তা পিটার বুকায়ের্ত বলেছেন, ‘আমরা আইএসের মতো ইসলামি চরমপন্থীদের মারাত্মক হুমকির মুখে আছি। ফলে আমাদের অত্যন্ত চৌকসভাবে তাদের মোকাবিলা করতে হবে। আইএসের হাত থেকে যারা পালাচ্ছে, তাদের অপমান করে ও বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়ে আমরা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক জায়গাতেই মানুষের মধ্যে ক্রোধ সৃষ্টি করছি। সিরিয়ার শরণার্থীদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করার মানে হলো, আইএসের বিজয়ের প্রচারণা চালানো।’ রাজনীতিকেরা যদি আমাদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি মোকাবিলা করতে চান, তাহলে তাঁদের অত দূরে শরণার্থীদের দিকে তাকানোর দরকার নেই, তাঁদের ঘরের আশপাশে তাকাতে হবে। সম্ভাব্য সন্ত্রাসী ও বন্দুকের দিকে তঁাদের নজর দিতে হবে। এটা সত্যিই অদ্ভুত যে সিনেট সন্ত্রাসী নজরদারির তালিকায় থাকা মানুষের বন্দুক কেনা বন্ধ করতে রাজি নয়। অর্থাৎ সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীরা সহজেই বিমানে উঠতে পারে না, কিন্তু তারা সহজেই অ্যাসাল্ট রাইফেল কিনতে পারে? সেলুকাস! প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ও গভর্নরদের শরণার্থীদের ব্যাপারে ভীতি সৃষ্টি করা চলবে না। সর্বোপরি, ৯/১১-এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৭ লাখ ৮৫ হাজার শরণার্থী প্রবেশ করেছে, কিন্তু তাদের কেউই এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে সন্ত্রাসী হামলায় অভিযুক্ত হয়নি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন, ১৮ বছর বয়সী এক নারী রাফা এক শিবিরে আমাকে বলল, ‘আমারও মানুষ, বেঁচে থাকার অধিকার আমাদের আছে। আমরা সন্ত্রাসী নই, যুদ্ধ থেকে পালানো মানুষ। আমি শুধু চাই, আমার সন্তানেরা যেন শান্তিতে বেড়ে উঠতে পারে।’

No comments

Powered by Blogger.