ঘুষে বেহুঁশ সিলেট বিআরটিএ by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ

ঘুষের রমরমা বাণিজ্যে মুখর হয়ে আছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয়। কোন কাজই ঘুষ ছাড়া হয় না এখানে। পদে পদে ঘুষের জাল পাতা। কর্তাদের হয়ে সে জাল বিছিয়ে রেখেছেন দালালরা। জালের প্রান্তগুলো মুঠোয় থাকায় দালালরা সিলেট বিআরটিএতে পরম ক্ষমতার অধিকারী। বলতে গেলে তারাই সিলেট বিআরটিএ’র ‘মা-বাপ’। পদ-পদবি না থাকলেও দালালদের জন্য আলাদা টেবিল-চেয়ারের ব্যবস্থাও রয়েছে। অবশ্য সিলেট বিআরটিএ’র কর্মকর্তারা এদের দালাল বলতে চান না। সম্মান দিয়েছেন তাদের ‘সহযোগী’ হিসেবেই। বলছেন, লোকবল সংকটের কারণে তাদের সহযোগিতা করছেন এরা।
দালালদের না ছুঁয়ে সিলেট বিআরটিএতে কোন কাজই সম্ভব নয়। কোন সেবা নিতে হলে প্রথমেই হাত ধরতে হবে কোন দালালের। তারপর দরদাম। বৈধ-অবৈধ কোন সেবাই বিনা দামে মিলে না। দালাল না ধরে কোন সেবা নিতে গেলে লাইন ধরতে হবে, টেবিলে টেবিলে ঘুরতে হবে। কিন্তু কাজ হবে না কিছুই। বাধ্য হয়েই দালাল খুঁজতে হবে। খুঁজে নিতে কষ্ট হবে না বেশি। কারণ পাশেই উঁকি দিচ্ছে দালাল। তারা থাকে কর্তাদের কাছাকাছিই। গত ২রা সেপ্টেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালত বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক এনায়েত হোসেন মন্টুর কক্ষ থেকে সাজ্জাদুর রহমান, দারা মিয়া ও নিজাম উদ্দিন নামের তিন দালালকে আটক করলেও সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সিলেটের এ কার্যালয়ে দালালদের দৌরাত্ম্য এতটুকু কমেনি।
বিআরটিএতে সবকিছুর জন্যই দালালরা দর ‘ফিক্সড’ করে রেখেছে। সরকারি খরচের সঙ্গে দালালদের ফিক্সড করা রেট মতো টাকা না দিলে সব কাজই আটকে যায়। আর নির্ধারিত রেটে টাকা দিলে মেলে অনৈতিক সুবিধাও। গাড়ি না চালিয়েও পাস করা করা যায় ড্রাইভিং পরীক্ষা। মিলে যায় লাইসেন্সও। শুধু জায়গা মতো পয়সা খরচ করতে হয়। পরীক্ষার ঝক্কি ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে খরচ করতে হবে ৫ হাজার টাকা। আবার টাকা দিলে লক্কড়-ঝক্কর মার্কা গাড়ির মিলে যায় ফিটনেস সার্টিফিকেট। ফিটনেস সার্টিফিকেট যোগাড় করতে হলে দুটি প্রক্রিয়া রয়েছে। বিআরটিএ’র ভাষায় যার নাম ‘সিন’ ও ‘আনসিন। সিন মানে গাড়ি দেখে ফিটনেসের সনদ দেয়া আর আনসিন মানে গাড়ি না দেখেই ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদান। বলাবাহুল্য সিনের চেয়ে আনসিনের রেট একটু বেশিই। সিনের রেট ১ হাজার টাকা আর আনসিনের রেট এর দ্বিগুণ। দালালদের হাতে টাকা দিলেই মিলে যায় মোটর যান পরিদর্শকের ‘গ্রিন সিগন্যাল’।  মোটরযান পরিদর্শক নাসির উদ্দিন অবশ্য একাই এ টাকা ভোগ করেন না। ‘শ্রেণীমতো’ সকলেই এর ভাগ পান।
সিএনজি অটোরিকশায় গ্রিল ছাড়া রেজিস্ট্রেশন দেয়ার নিয়ম নেই। তবে ঘুষের বিনিময়ে গ্রিল ছাড়াই রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ করে দেন। এ জন্য রয়েছে নিজস্ব ব্যবস্থা। টাকা দিলে সবই হয়। গ্রিলসহই অটোরিকশা হাজির হয় বিআরটিএ কার্যালয়ে। এ জন্য রয়েছে সিলেট বিআরটিএ ‘অনুমোদিত’ কয়েকটি গ্রিলের প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ সুরমার জালালি ডেন্টিং, সৈয়দ কামাল ডেন্টিং, আইয়ুব আলী ডেন্টিং, ইয়াসিন ডেন্টিং, সুলাইমান ডেন্টিং, লোকমান ডেন্টিং, নজরুল অটো টেইলার্স, রিপন ডেন্টিং, ছালেক ডেন্টিং; শাহ আলম ডেন্টিং। এসব প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রেশনের জন্য গ্রিল ভাড়া দেয় অটোরিকশা মালিকদের। বিআরটিএতে হাজিরার আগে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রিল লাগিয়ে নেয়া হয়। হাজিরা শেষে গ্রিল খুলে নেয় প্রতিষ্ঠান। মাঝের সময়টুকুর জন্য ঘণ্টাপ্রতি ভাড়া হিসেবে ৬ থেকে ৭শ’ টাকা দিতে হয় তাদের। এর মধ্যে ভাগ আছে বিআরটিএ’র দালাল থেকে শুরু করে একদম শীর্ষকর্তা পর্যন্ত।
মালিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও রেট বাঁধা আছে বিআরটিএ’র সিলেট কার্যালয়ে। গাড়ির মালিকানা পরিবর্তনের সময় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হলেও টাকা দিলে বিক্রেতার উপস্থিতি ছাড়াই মালিকানা পরিবর্তন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে বাড়তি দিতে হয় ১২ হাজার টাকা। এর ফলে চোরাই গাড়ি-মোটরসাইকেলের মালিকানাও নিজের নামে করে নিচ্ছেন কেউ কেউ। আর বৈধ উপায়ে মালিকানা পরিবর্তন করতে হলেও ঘুষ ছাড়া উপায় নেই। ৫ হাজার টাকা ছাড়া মালিকানা পরিবর্তনের কাগজে সহকারী পরিচালকের সই মেলে না। টাকা দিলে দালালরাই সইয়ের যোগাড় করে দেন।
বিআরটিএ’র ঘুষ বাণিজ্যের খবর এ কান ও কান হয়ে অনেক কানেই পৌঁছে গেছে। ভাগ বসাতে তৎপর হয়ে উঠেন অনেকেই, সহজ পথে ভাগ না পেয়ে বাঁকা পথেরও আশ্রয় নেন কেউ কেউ। ৩১শে আগস্ট ঘুষের টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে বিআরটিএ অফিসে। কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে যুবলীগ নেতা কালা ফারুকের নেতৃত্বে ৪/৫ জনের একটি দল বিআরটিএ’র ফিটনেস শাখা থেকে অস্ত্র ধরে ছিনিয়ে নেয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। তবে ছিনতাইয়ের এ ঘটনায় চুপ থাকে বিআরটিএ। মামলা তো দূরের কথা থানায় অভিযোগও করেনি থলের বেড়াল বেরিয়ে আসার ভয়ে। ব্যবসার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তারা চেষ্টা করেন ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার।
মানবজমিনের অনুসন্ধানে তথ্য মিলেছে, চট্টগ্রাম বিআরটিএতে কাজ করার সময় ১৯৯৪ সালে দুর্নীতির অভিযোগে অপসারিত হয়েছিলেন মীর মোহাম্মদ আলী।
মানবজমিনের সঙ্গে কথা হয় সিলেট বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক এনায়েত হোসেন মন্টুর সঙ্গে। ঘুষের টাকা ছিনতাই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওটা ঘুষের টাকা ছিলো না। কাজের জন্য স্পিড গভর্নর মীর মোহাম্মদ আলীর কাছে একজন এই টাকাটা দিয়েছিলো। মামলা করেননি কেন এমন প্রশ্নে তিনি জানান, বিষয়টি আপসে মীমাংসা হয়ে গেছে। বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক তথ্য দেন দেড় লাখ নয় ছিনতাই হয়েছিলো ৩৪ হাজার টাকার মতো। দালাল প্রসঙ্গে বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালকের বক্তব্য, বিআরটিএতে তো কতজনই আসে কারা দালাল চিনবো কি করে? আসে নিজেদের কাজের কথা বলে। তারা যে দালাল চিনার উপায় কি?

No comments

Powered by Blogger.