রাজনৈতিক আপস অর্থনৈতিক উন্নতিরও সোপান by সুজিত চৌধুরী
![]() |
| জার্মানিকে বিভক্তকারী বার্লিন দেয়ালের পতনের ক্ষণে জার্মান সংহতি |
রাজনৈতিক
সংস্কৃতির ব্যর্থতা কত বড় বিপর্যয় নিয়ে আসে, জার্মানির ভাইমার প্রজাতন্ত্র
ছিল তার উদাহরণ। ওই বিপত্তির জেরেই হিটলারের ফ্যাসিবাদ জার্মানির ঘাড়ে
চেপে বসেছিল। ১৯১৯-এর জার্মানির প্রথম রিপাবলিক অর্থবহ গণতান্ত্রিক
প্রক্রিয়া শুরু করেও শেষ করতে পারেনি। দলীয় স্বার্থদ্বন্দ্ব প্রাতিষ্ঠানিক
উপরিকাঠামো তৈরি করতে দেয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভাইমারের ব্যর্থতা
থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক রিপাবলিকের যাত্রা শুরু করে
জার্মানি। অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত বিভক্ত দেশটি যে পুনর্গঠনের রাজনীতি
দাঁড় করিয়েছিল, তা অভূতপূর্ব। আগে পূর্ব জার্মানিতে ছিল কমিউনিস্ট পার্টির
একদলীয় শাসন এবং পশ্চিম জার্মানিতে দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক রিপাবলিকের
গণতন্ত্রের মহড়া। পশ্চিম জার্মানির দলীয় রাজনীতি ১৯৪৫ সালে রাষ্ট্র
পরিচালনার যে ভিত্তি তৈরিতে সমর্থ হয়েছিল, তা আজ ২৫ বছরের ঐক্যবদ্ধ
জার্মানিকেও সরাসরি প্রভাবিত ও পরিচালিত করছে।
পশ্চিম জার্মানিতে কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত জার্মানিতে কোয়ালিশন সরকারব্যবস্থা চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে প্রথম চ্যান্সেলর কনরাড আভেনাওয়ার কোয়ালিশন সরকার গঠনে বাধ্য হয়েছিলেন। বৃহৎ খ্রিষ্টান ডেমোক্র্যাটরা লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে কোয়ালিশন করেছিলেন। এই কোয়ালিশন রাজনীতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিশ্চয়ই ছিল। জনসাধারণ ফ্যাসিবাদী একদলীয় স্বেচ্ছাচারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে। এরপর আর কোনো দলকে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়নি। জার্মান ভোটারদের ব্যতিক্রমধর্মী এই আচরণ গণতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়। জাতিগত ও আন্তর্জাতিক সব সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে আপস দরকার। একমাত্র কোয়ালিশন প্রয়োজনবোধে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ হয়।
বর্তমান জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল গ্র্যান্ড কোয়ালিশন পরিচালনা করছেন। মেরকেলের খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি কোয়ালিশন করেছে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে। তাই এটা গ্র্যান্ড কোয়ালিশন। এটাই সেখানে জাতীয় ঐকমত্যের বৃহত্তর ভিত্তি। মেরকেল শরণার্থী সমস্যার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন ব্যাপক জনমতের সমর্থনেই। এতে মেরকেলের রক্ষণশীল দলের বাভারীয় অংশীদাররা কিছুটা জটিলতা বাড়ালেও সোশ্যাল ডেমোক্রেসির পূর্ণ সহযোগিতা তিনি পেয়ে যাবেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে জার্মান সরকারের এই সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়েছে বিশেষভাবে এই গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের কারণে।
মেরকেলের সহযোগী সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি জার্মানির প্রাচীনতম দল, বয়স ১৫০-এর বেশি। ১৮৮৫ সালে জার্মান প্রথম চ্যান্সেলর অটো ফন বিসমার্ক জার্মানিতে সামাজিক বিমা-ব্যবস্থা প্রচলনে বাধ্য হন এই সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির চাপেই। সোশ্যাল ডেমোক্রেসির শ্রমিক নেতা ড. ফার্ডিনান্ড লাসাল লাইপজিগ শহরে পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক সংগঠন করেন। তাঁর জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে বিখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক স্টেফান হাইমের একটি ইতিহাস-আশ্রয়ী উপন্যাসও আছে। লাসালের সঙ্গে বিসমার্ক দেখা করতেন, দাবা খেলতেন এবং বন্ধুত্ব রাখতেন। বিসমার্কের ওপর লাসালের প্রভাব উপেক্ষা করার নয়। অন্যদিকে মার্ক্স ও লাসাল তাত্ত্বিক বিষয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের বন্ধুত্বও রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সহযোগ ও বন্ধুত্বও একধরনের কোয়ালিশন বা সমঝোতামূলক আপসের নিদর্শন।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট ছিলেন যুদ্ধোত্তর জার্মানির প্রথম সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির চ্যান্সেলর। তিনি তখন বিশাল আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছিলেন। একদিকে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে জার্মান জাতির অপরাধের ভার কমানো, অন্যদিকে ঠান্ডা যুদ্ধে বিভক্ত পৃথিবীতে সহযোগিতার সেতু তৈরি করা। ব্রান্ট জার্মান সামাজিক বিতর্ককে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পোল্যান্ডের ওয়ারশতে শহীদ মিনারে হাঁটু গেড়ে বসে জার্মান জাতির পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন। বার্লিনের ১৯৬৮-৬৯ সালের ছাত্র-যুব আন্দোলনেও ছিল জাতীয় আত্মশুদ্ধি ও পুনর্গঠনের চেতনা। এই সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই উইলি ব্রান্ট ১৯৬৯ সালে চ্যান্সেলর নির্বাচিত হন। তাঁরও ছিল জার্মান লিবারেল পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন।
সময়ের ব্যবধানে ব্রান্ট ও মেরকেলের চ্যালেঞ্জে কিছুটা অমিল থাকতে পারে, তবে মিল অনেক। শরণার্থী সমস্যা পরিচিত আন্তর্জাতিক সমস্যা। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চলছে। সিরিয়া গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। ইরাক যুদ্ধবিধ্বস্ত। লিবিয়ার সমাজও যুদ্ধবিধ্বস্ত। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দায় প্রশ্নাতীত। বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ইউরোপ অভিমুখে আশ্রয়যাত্রা ওই যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের রপ্তানি করা যুদ্ধের ফসল। অ্যাঙ্গেলা মেরকেল অবশ্যই ইউরোপীয় স্বার্থ রক্ষা করছেন। দারিদ্র্য ও ক্ষুধা এখন বিশ্বায়িত সমস্যা। রাজনৈতিক বা মানবিক যে কারণেই হোক, শরণার্থী সমস্যার মুখোমুখি সবাইকে দাঁড়াতে হবে। মেরকেল তাই সামনে দাঁড়াচ্ছেন। যেমন ১৯৬০-৭০ দশকে উইলি ব্রান্ট দাঁড়িয়েছিলেন। তখনো জার্মানিতে অনেকেই ব্রান্টের পক্ষে ছিলেন না। ব্রান্ট আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু না করলে জার্মানির প্রতি প্রতিবেশী দেশগুলোর আস্থা ফিরে আসত না। সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই কোটি মানুষ হিটলারের যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। ব্রান্ট পূর্ব ইউরোপের হিটলার কর্তৃক অত্যাচারিত সমাজগুলোর প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, দরজা খুলে দিয়েছিলেন।
ব্রান্টের পূর্বমুখী আত্মশুদ্ধির রাজনীতির প্রেক্ষাপট ছাড়া প্রতিবেশী দেশ ও সমাজগুলো জার্মান রাষ্ট্রীয় ঐক্য মেনে নিত না। গরবাচেভ দেয়াল খুলে দিলেও নতুন নতুন দেয়াল তৈরি হতো। মেরকেলের বর্তমান ভূমিকার হিসাব-নিকাশ হবে অনেক পরে। এমনও তো হতে পারে, শরণার্থী সমস্যার ব্যাপকতা ও অর্থনৈতিক চাপে জনমত উল্টে গেল। মেরকেল পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু ইউরোপীয় বিশ্বে এবং বিশ্বের কাছে ইউরোপের দায়বদ্ধতা নিয়ে যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ একদিন হবে, তাতে অবশ্যই শরণার্থী বিষয়ে মেরকেলের ভূমিকা আলোচিত হবে। তা ব্রান্টের ওই পূর্বমুখী ও আত্মশুদ্ধির রাজনীতির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
রাজনীতির এই জার্মান পথ বহুমুখী ও বিচিত্র। মোদ্দাকথা, জার্মানির যুদ্ধোত্তর সমাজ কোয়ালিশন ছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান করেনি। সবুজ দলের উৎপত্তি হলো ১৯৮০-র দশকে। জার্মানি ছাড়া ইউরোপের অন্য কোনো দেশে পরিবেশবাদী সবুজ দল এত শক্তিশালী ছিল না। সবুজ দল তো পুরো জার্মান সমাজ পাল্টে দিল। জার্মানিতে পরিবেশ ও প্রতিবেশ নিয়ে যুক্তিতর্ক সামাজিকীকরণ হয়ে গেছে। এই আলোচনায় উত্তেজনা আর নেই। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে সবুজ দল কোয়ালিশন করেছিল ১৯৯৮ সালে। তারপর জার্মানি ক্রমান্বয়ে পরমাণু শক্তি থেকে বিদায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কয়লা ছাড়া জার্মানির বিশেষ কোনো খনিজ সম্পদ নেই। তেল নেই, গ্যাস নেই। সব আমদানি করতে হয়। এখন বিশাল বিনিয়োগ করতে হচ্ছে সৌর ও বায়ুশক্তির জন্য। এখন ট্রেনে চড়ে জার্মানি ঘুরলে অনেক জায়গায় বায়ু এনার্জির সাদা বড় খুঁটিগুলো দেখা যায়। ওই সব বিবর্তনের কারণ সবুজ দলের উত্থান। সবুজ দল পরিবেশ প্রশ্নকে ক্লাসরুম থেকে ফেডারেল সরকারের কর্মসূচিতে রূপান্তরিত করতে সমর্থ হয়েছে। তা–ও সম্ভব হয়েছে কোয়ালিশন রাজনীতির কারণে।
সারমর্মে একটা কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানির ব্যর্থ ও ভয়ংকর কাজগুলো সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর আপসহীনতা ও একচেটিয়াপনার জন্য। জার্মানির যা কিছু অর্জন, চ্যালেঞ্জ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সব সম্ভব হয়েছে সামাজিক আপসে। জার্মান অর্থনৈতিক মডেলকে বলা হয় রাইন নদীর মডেল। এই পৃথিবীকে চমকিত করা রাইন মডেলে মালিক-শ্রমিক সহযোগিতার মাধ্যমে জার্মানি অর্থনৈতিক উন্নয়নের শীর্ষে উঠতে পেরেছে। এটাও একধরনের অর্থনৈতিক কোয়ালিশন। আপস উন্নয়নের পথকে সুগম করে। জার্মানি তার প্রমাণ। জার্মান ঐক্যের ২৫ বছর পূর্তিতে জার্মানির ঐক্য-উৎসবেও সেই সত্য প্রতিফলিত।
সুজিত চৌধুরী: অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশে জার্মান দূতাবাসের সাবেক পরিবেশ উপদেষ্টা। এখন জার্মান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার উপকূলীয় পরিবেশ প্রকল্পের উপদেষ্টা।
পশ্চিম জার্মানিতে কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত জার্মানিতে কোয়ালিশন সরকারব্যবস্থা চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে প্রথম চ্যান্সেলর কনরাড আভেনাওয়ার কোয়ালিশন সরকার গঠনে বাধ্য হয়েছিলেন। বৃহৎ খ্রিষ্টান ডেমোক্র্যাটরা লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে কোয়ালিশন করেছিলেন। এই কোয়ালিশন রাজনীতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিশ্চয়ই ছিল। জনসাধারণ ফ্যাসিবাদী একদলীয় স্বেচ্ছাচারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে। এরপর আর কোনো দলকে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়নি। জার্মান ভোটারদের ব্যতিক্রমধর্মী এই আচরণ গণতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়। জাতিগত ও আন্তর্জাতিক সব সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে আপস দরকার। একমাত্র কোয়ালিশন প্রয়োজনবোধে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ হয়।
বর্তমান জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল গ্র্যান্ড কোয়ালিশন পরিচালনা করছেন। মেরকেলের খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি কোয়ালিশন করেছে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে। তাই এটা গ্র্যান্ড কোয়ালিশন। এটাই সেখানে জাতীয় ঐকমত্যের বৃহত্তর ভিত্তি। মেরকেল শরণার্থী সমস্যার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন ব্যাপক জনমতের সমর্থনেই। এতে মেরকেলের রক্ষণশীল দলের বাভারীয় অংশীদাররা কিছুটা জটিলতা বাড়ালেও সোশ্যাল ডেমোক্রেসির পূর্ণ সহযোগিতা তিনি পেয়ে যাবেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে জার্মান সরকারের এই সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়েছে বিশেষভাবে এই গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের কারণে।
মেরকেলের সহযোগী সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি জার্মানির প্রাচীনতম দল, বয়স ১৫০-এর বেশি। ১৮৮৫ সালে জার্মান প্রথম চ্যান্সেলর অটো ফন বিসমার্ক জার্মানিতে সামাজিক বিমা-ব্যবস্থা প্রচলনে বাধ্য হন এই সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির চাপেই। সোশ্যাল ডেমোক্রেসির শ্রমিক নেতা ড. ফার্ডিনান্ড লাসাল লাইপজিগ শহরে পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক সংগঠন করেন। তাঁর জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে বিখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক স্টেফান হাইমের একটি ইতিহাস-আশ্রয়ী উপন্যাসও আছে। লাসালের সঙ্গে বিসমার্ক দেখা করতেন, দাবা খেলতেন এবং বন্ধুত্ব রাখতেন। বিসমার্কের ওপর লাসালের প্রভাব উপেক্ষা করার নয়। অন্যদিকে মার্ক্স ও লাসাল তাত্ত্বিক বিষয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের বন্ধুত্বও রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সহযোগ ও বন্ধুত্বও একধরনের কোয়ালিশন বা সমঝোতামূলক আপসের নিদর্শন।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট ছিলেন যুদ্ধোত্তর জার্মানির প্রথম সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির চ্যান্সেলর। তিনি তখন বিশাল আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছিলেন। একদিকে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে জার্মান জাতির অপরাধের ভার কমানো, অন্যদিকে ঠান্ডা যুদ্ধে বিভক্ত পৃথিবীতে সহযোগিতার সেতু তৈরি করা। ব্রান্ট জার্মান সামাজিক বিতর্ককে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পোল্যান্ডের ওয়ারশতে শহীদ মিনারে হাঁটু গেড়ে বসে জার্মান জাতির পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন। বার্লিনের ১৯৬৮-৬৯ সালের ছাত্র-যুব আন্দোলনেও ছিল জাতীয় আত্মশুদ্ধি ও পুনর্গঠনের চেতনা। এই সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই উইলি ব্রান্ট ১৯৬৯ সালে চ্যান্সেলর নির্বাচিত হন। তাঁরও ছিল জার্মান লিবারেল পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন।
সময়ের ব্যবধানে ব্রান্ট ও মেরকেলের চ্যালেঞ্জে কিছুটা অমিল থাকতে পারে, তবে মিল অনেক। শরণার্থী সমস্যা পরিচিত আন্তর্জাতিক সমস্যা। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চলছে। সিরিয়া গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। ইরাক যুদ্ধবিধ্বস্ত। লিবিয়ার সমাজও যুদ্ধবিধ্বস্ত। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দায় প্রশ্নাতীত। বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ইউরোপ অভিমুখে আশ্রয়যাত্রা ওই যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের রপ্তানি করা যুদ্ধের ফসল। অ্যাঙ্গেলা মেরকেল অবশ্যই ইউরোপীয় স্বার্থ রক্ষা করছেন। দারিদ্র্য ও ক্ষুধা এখন বিশ্বায়িত সমস্যা। রাজনৈতিক বা মানবিক যে কারণেই হোক, শরণার্থী সমস্যার মুখোমুখি সবাইকে দাঁড়াতে হবে। মেরকেল তাই সামনে দাঁড়াচ্ছেন। যেমন ১৯৬০-৭০ দশকে উইলি ব্রান্ট দাঁড়িয়েছিলেন। তখনো জার্মানিতে অনেকেই ব্রান্টের পক্ষে ছিলেন না। ব্রান্ট আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু না করলে জার্মানির প্রতি প্রতিবেশী দেশগুলোর আস্থা ফিরে আসত না। সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই কোটি মানুষ হিটলারের যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। ব্রান্ট পূর্ব ইউরোপের হিটলার কর্তৃক অত্যাচারিত সমাজগুলোর প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, দরজা খুলে দিয়েছিলেন।
ব্রান্টের পূর্বমুখী আত্মশুদ্ধির রাজনীতির প্রেক্ষাপট ছাড়া প্রতিবেশী দেশ ও সমাজগুলো জার্মান রাষ্ট্রীয় ঐক্য মেনে নিত না। গরবাচেভ দেয়াল খুলে দিলেও নতুন নতুন দেয়াল তৈরি হতো। মেরকেলের বর্তমান ভূমিকার হিসাব-নিকাশ হবে অনেক পরে। এমনও তো হতে পারে, শরণার্থী সমস্যার ব্যাপকতা ও অর্থনৈতিক চাপে জনমত উল্টে গেল। মেরকেল পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু ইউরোপীয় বিশ্বে এবং বিশ্বের কাছে ইউরোপের দায়বদ্ধতা নিয়ে যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ একদিন হবে, তাতে অবশ্যই শরণার্থী বিষয়ে মেরকেলের ভূমিকা আলোচিত হবে। তা ব্রান্টের ওই পূর্বমুখী ও আত্মশুদ্ধির রাজনীতির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
রাজনীতির এই জার্মান পথ বহুমুখী ও বিচিত্র। মোদ্দাকথা, জার্মানির যুদ্ধোত্তর সমাজ কোয়ালিশন ছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান করেনি। সবুজ দলের উৎপত্তি হলো ১৯৮০-র দশকে। জার্মানি ছাড়া ইউরোপের অন্য কোনো দেশে পরিবেশবাদী সবুজ দল এত শক্তিশালী ছিল না। সবুজ দল তো পুরো জার্মান সমাজ পাল্টে দিল। জার্মানিতে পরিবেশ ও প্রতিবেশ নিয়ে যুক্তিতর্ক সামাজিকীকরণ হয়ে গেছে। এই আলোচনায় উত্তেজনা আর নেই। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে সবুজ দল কোয়ালিশন করেছিল ১৯৯৮ সালে। তারপর জার্মানি ক্রমান্বয়ে পরমাণু শক্তি থেকে বিদায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কয়লা ছাড়া জার্মানির বিশেষ কোনো খনিজ সম্পদ নেই। তেল নেই, গ্যাস নেই। সব আমদানি করতে হয়। এখন বিশাল বিনিয়োগ করতে হচ্ছে সৌর ও বায়ুশক্তির জন্য। এখন ট্রেনে চড়ে জার্মানি ঘুরলে অনেক জায়গায় বায়ু এনার্জির সাদা বড় খুঁটিগুলো দেখা যায়। ওই সব বিবর্তনের কারণ সবুজ দলের উত্থান। সবুজ দল পরিবেশ প্রশ্নকে ক্লাসরুম থেকে ফেডারেল সরকারের কর্মসূচিতে রূপান্তরিত করতে সমর্থ হয়েছে। তা–ও সম্ভব হয়েছে কোয়ালিশন রাজনীতির কারণে।
সারমর্মে একটা কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানির ব্যর্থ ও ভয়ংকর কাজগুলো সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর আপসহীনতা ও একচেটিয়াপনার জন্য। জার্মানির যা কিছু অর্জন, চ্যালেঞ্জ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সব সম্ভব হয়েছে সামাজিক আপসে। জার্মান অর্থনৈতিক মডেলকে বলা হয় রাইন নদীর মডেল। এই পৃথিবীকে চমকিত করা রাইন মডেলে মালিক-শ্রমিক সহযোগিতার মাধ্যমে জার্মানি অর্থনৈতিক উন্নয়নের শীর্ষে উঠতে পেরেছে। এটাও একধরনের অর্থনৈতিক কোয়ালিশন। আপস উন্নয়নের পথকে সুগম করে। জার্মানি তার প্রমাণ। জার্মান ঐক্যের ২৫ বছর পূর্তিতে জার্মানির ঐক্য-উৎসবেও সেই সত্য প্রতিফলিত।
সুজিত চৌধুরী: অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশে জার্মান দূতাবাসের সাবেক পরিবেশ উপদেষ্টা। এখন জার্মান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার উপকূলীয় পরিবেশ প্রকল্পের উপদেষ্টা।

No comments