যখন-তখন গ্যাস-বিদ্যুৎ বিপর্যয়: রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে পাইপে ফাটল by অরূপ দত্ত

মগবাজারের রাশমনো হাসপাতালের সামনে রাস্তার নিচের
গ্যাসের পাইপ লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে। সংস্কার না করেই
স্থানটি মাটিতে ভরাট করা হয়। ছবি আবদুস সালাম
রাজধানীতে যখন তখন যেখানে সেখানে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটছে। পানি সরবরাহও বিঘ্নিত হচ্ছে। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণ ছাড়াও বৈদ্যুতিক কেব্ল ক্ষতিগ্রস্ত, সঞ্চালন-বিতরণ লাইন সংস্কার করতে গিয়ে এই বিপর্যয় হচ্ছে বলে জানা যায়। দিনভর পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় নাগরিক ভোগান্তি চরমভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
গ্যাস পাইপ ফেটে আগুন: মগবাজার প্রধান সড়কে নজরুল শিক্ষালয়ের সামনে পাইপ ফেটে পাঁচ দিন ধরে গ্যাস বেরোচ্ছে। সড়কটি ভাঙাচোরা। বৃষ্টিতে সৃষ্টি হয়েছে প্রায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা। জমে থাকা পানিতে গ্যাসের বুদ্বুদ উঠে আসছে। গত সোমবার এ ঘটনা ঘটার পর নজরুল শিক্ষালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করে। গ্যাসের তীব্র গন্ধে এখন সেখানে চলাচলই কঠিন হয়ে গেছে।
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, গ্যাস বেরোবার পর খবর পেয়ে তিতাস গ্যাস কোম্পানি পাইপের ফাটা অংশ সংস্কার না করে ওই স্থানে মাটি চাপা দেয়। এরপর চারপাশে ফিতা টেনে এবং কাগজে ‘সাবধান গ্যাস নির্গত হচ্ছে’ লিখে দায়িত্ব শেষ করে। গতকাল বিকেলে গ্যাসের বুদ্বুদের সঙ্গে আগুন বের হলে আতঙ্কিত এলাকাবাসী রাস্তায় বেরিয়ে আসেন।
যোগাযোগ করা হলে তিতাস গ্যাস কোম্পানির পরিচালক (উৎপাদন) আশরাফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে গ্যাস লাইনের ফুটো মেরামত করা হয়। কিন্তু সেখানে বিদ্যুতের অত্যন্ত শক্তিশালী ২৩০ কেভি ভোল্টের লাইন থাকায় কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। বিষয়টি ঢাকা পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানিকে (ডিপিডিসি) জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি দেখছি, প্রয়োজনে নিজে আজ (শুক্রবার) রাতে মুভ করব।’
মিরপুরের কিছু অংশ ১৯ ঘণ্টা গ্যাসবিহীন: মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত প্রায় ১৯ ঘণ্টা মিরপুরের অনেক স্থানে গ্যাস ছিল না। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সূত্র জানায়, সেনপাড়া পর্বতায় ঢাকা ওয়াসার প্রকল্পকাজের রাস্তা খোঁড়ার কারণে মঙ্গলবার তিতাস গ্যাসের চার ইঞ্চি পাইপ লাইন ফেটে যায়। এতে মিরপুরের অনেক এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বুধবার বিকেল চারটার দিকে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেনপাড়া পর্বতায় শিববাড়ি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কাছে ঢাকা ওয়াসার ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ (ডিডব্লিউএসএসডিপি) আওতায় গভীর গর্ত খোঁড়া হয়েছিল। গর্ত খুঁড়তে গিয়ে মঙ্গলবার রাতে মাটির গভীরে থাকা চার ইঞ্চি গ্যাস পাইপ ফেটে যায়। ওই অংশ দিয়ে দ্রুত গ্যাস বেরোতে থাকে। এ অবস্থায় তিতাস গ্যাস কোম্পানি একে একে এলাকার নয়টি বাল্ব (গ্যাস সরবরাহ লাইনে থাকে) বন্ধ করে দেয়। এতে সেনপাড়া পর্বতা, মিরপুর ১৩ নম্বর, ১৪ নম্বর সেকশনের কাফরুল, বউবাজার, ইব্রাহিমপুরসহ আশপাশের এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
ইনসেটে ঘটনাস্থলে টাঙানো সতর্ক বার্তা। ছবি আবদুস সালাম
কাফরুল থানার বিপরীত দিকে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের তৈরি ২০টির মতো বহুতল ভবন রয়েছে। একটি ভবনের ফ্ল্যাট মালিক মনোয়ার হোসেন বলেন, মঙ্গলবার রাতে গ্যাস বন্ধ হওয়ার বিষয়টি তাঁরা জানতে পারেন বুধবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে, খাবার তৈরি করতে গিয়ে। তখন টিম টিম করে চুলা জ্বলছিল। সকাল নয়টার দিকে গ্যাস সরবরাহ একদম বন্ধ হয়ে যায়। বিকেল চারটার দিকে সরবরাহ চালু হয়। অপর একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা বিলকিস আক্তার বলেন, আকস্মিকভাবে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় বুধবার সকালে মেয়ের জন্য খাবার তৈরি না করেই স্কুলে পাঠিয়েছেন। পরে বাইরে থেকে খাবার আনাতে হয়েছে।
তিতাসের পরিচালক আশরাফুল হক বলেন, ফেটে যাওয়া গ্যাস পাইপ দ্রুত মেরামত করা হয়েছে। বিষয়টি ওয়াসাকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে।
মোহাম্মদপুরের একাংশ দিনভর বিদ্যুৎবিহীন: গতকাল শুক্রবার সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত মোহাম্মদপুর নূরজাহান রোড, শেখেরটেক, আদাবরসহ আশপাশের এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। এতে এসব এলাকায় পানির সরবরাহও বিঘ্নিত হয়। উত্তরার আজমপুরেও দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ ছিল না বলে এলাকার একজন বাসিন্দা টেলিফোন করে জানান।
নূরজাহান রোডের আর-৪১ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা নূরুন্নাহার বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকাল আটটার দিকে বিদ্যুৎ যাওয়ার পর প্রথমে মনে হয়েছিল লোডশেডিং। কিন্তু দুই ঘণ্টা পরও যখন বিদ্যুৎ এল না, বুঝলাম অন্য সমস্যা। প্রচণ্ড গরমে কষ্ট করতে হয়ে।’
‘এস’ রোডের বাসিন্দা শাহাবুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘সকাল থেকে বিদ্যুৎ না থাকায় পানির সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। বাড়িওয়ালার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংরক্ষিত ট্যাংকিতে যেটুকু পানি ছিল শেষ হয়ে গেছে।’
‘এফ’ রোডের বাসিন্দা আবদুস সবুর ও মিল্লাতুর রহমান বলেন, শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করার জন্য তাঁরা গোসল বা অজু পর্যন্ত করতে পারেননি।
শেকেরটেকের বাসিন্দা পারভীন সুলতানা সন্ধ্যায় প্রথম আলোয় ফোন করে জানান, প্রায় আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় ফ্রিজের খাবার নষ্ট হয়ে যায়।
এসব এলাকার বাসিন্দারা জানান, অনেক সময় মাইকে আগেই নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যুৎ না থাকার ঘোষণা দেওয়া হয়। গতকাল তেমন কোনো ঘোষণা না দেওয়ায় তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না কখন বিদ্যুৎ আসবে।
জানতে চাইলে ঢাকা পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির (ডিপিডিসি) স্থানীয় (স্ক্যাডা) কর্মকর্তা আমীর হোসেন জানান, মাটির নিচে একটি কেব্ল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের এই বিপর্যয় ঘটে। কারণ, এর জন্য সরবরাহকারী ফিডার বন্ধ রাখতে হয়।

No comments

Powered by Blogger.