ছিটমহলে সূর্যোদয় by অমর সাহা

কোচবিহারের মশালডাঙ্গা ছিটমহলের বাসিন্দারা
ধীরে ধীরে মেঘ কাটছে। সূর্যের রঙিন আলো এসে পড়েছে ছিটমহলে। আর সেই আলোয় স্নাত হচ্ছে ছিটমহলের হাজারো মানুষ।
কত দিন মেঘে ঢাকা ছিল এই ছিটমহলগুলো। সেই ভারতের ভূখণ্ডে থাকা ৫১টি আর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা ১১১টি ছিটমহল। দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর অবশেষে এই ছিটমহলবাসীর দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে ভারতের আইনসভার দুটি কক্ষ রাজ্যসভা ও লোকসভায় ৬ ও ৭ মে পাস হয়ে যায় ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে ভারতীয় সংবিধান সংশোধনী বিল।
এই বিল পাস হওয়ার পর নব জন্মলাভ করেন ছিটমহলের বাসিন্দারা। এখন তাঁরা নতুন করে জীবন উপভোগের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন, যা ছিল তাঁদের কাছে একসময় স্বপ্ন; এবার তা বাস্তবের পথে। তাঁরা পাবেন নাগরিকত্ব। ভোটার পরিচয়পত্র, রেশন কার্ড। আর তাঁদের অন্য দেশের বেষ্টনীর মধ্যে পরগাছা হয়ে থাকতে হবে না। পাবেন মুক্ত আকাশ, মুক্ত বিহঙ্গের মতো স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর থেকে এক মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দুই দেশের ১৬২টি ছিটমহলের বাসিন্দারা নাগরিকত্ব অধিকারহীন একটি স্বাধীন দেশেই বাস করে আসছেন। ইতিমধ্যে ছিটমহলবাসীর পুনর্বাসনের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া ৩ হাজার ৮ কোটি রুপির প্যাকেজ মেনে নেওয়ার কথা বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে সত্যিই কি দুই দেশের ছিটমহলের সব বাসিন্দা ফিরে যাবেন নিজ নিজ দেশে? কথা হচ্ছিল ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্তর সঙ্গে। তাঁর দাবি, ভারতের ভূখণ্ডে থাকা ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দারা কেউই আর ফিরে যাবেন না বাংলাদেশে। এই ৫১টি ছিটমহলে রয়েছে ১৪ হাজার ২১৫ জন বাংলাদেশি মানুষের বাস। অন্যদিকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলে রয়েছে ৩৭ হাজার ৩৬৯ জন ভারতীয় নাগরিকের বাস। তাঁদের মধ্য থেকে মাত্র ১৪৯টি পরিবারের ৭৪৩ জন বাসিন্দা ভারতে এসে বসবাস করতে চান। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে সব ছিটমহলবাসীও যদি ভারতে এসে থাকতে চান, তবে তাঁদের পুনর্বাসন করবে ভারত সরকার। কিন্তু তাঁরা সম্ভবত আসবেন না। দীর্ঘদিন ধরে ওখানকার মাটির সঙ্গে তাঁদের যে ভালোবাসা গড়ে উঠেছে, সেই মাটির টান ত্যাগ করে এখনই ফিরতে নাও পারেন তাঁরা। তবু ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসা ছিটমহলবাসীর পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১০০ একর জমি চিহ্নিত করে রেখেছে। সরকার চাইলে এখানেই পুনর্বাসনের জন্য আবাস তৈরি করে দিতে পারবে।
কথা বলছিলাম, ভারতীয় ভূখণ্ডে থাকা বাংলাদেশের ছিটমহলের বাসিন্দা সাহেব আলী, গোবিন্দ বর্মণ, আলাউদ্দিন মিয়া ও অরুণ কুমার রায়ের সঙ্গে। তাঁরা সবাই এক বাক্যে জানালেন, তাঁরা কাগজ-কলমে বাংলাদেশের নাগরিক হলেও বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবেননি। এই মাটিতেই থাকতে চান তাঁরা। তাঁদের এটুকু শান্তি যে তাঁরা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন। ভোটার পরিচয়পত্র পাবেন। রেশন কার্ড পাবেন। এবার তাঁরা আর গোপনে নয়, জাল কাগজপত্র দিয়েও নয়, এবার তাঁরা প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক হিসেবে এখানকার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে পারবেন। বাড়িতে বিদ্যুৎ–সংযোগ নিতে পারবেন। এই আনন্দই তাঁদের নতুন জীবনের স্বপ্নকে আরও উজ্জীবিত করেছে। নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
মূলত ভারতের ভূখণ্ডে থাকা ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহলের অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায়। এসব ছিটমহলের বাসিন্দাদের যন্ত্রণার কথা স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে ছিটমহলবাসী নিজেদের হৃদয়ে আঁকড়ে ধরে রাখলেও এই ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবিতে মূলত আন্দোলন জোরদার হয় ১৯৯৪ সাল থেকে।
তৎকালীন বিধায়ক প্রয়াত দীপক সেনগুপ্ত ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি গড়ে আন্দোলন জোরদার করেন। ছিটমহলবাসীর কাছ থেকে দাবি ওঠে, দিতে হবে তাঁদের নাগরিকত্ব। যেহেতু এই ১৬২টি ছিটমহলের বাসিন্দারা হয়তো বাংলাদেশের, নয়তো ভারতের নাগরিক। কিন্তু কোনো দেশের সরকারই ছিটমহলবাসীর এই দাবির প্রতি সদয় ছিল না। কিন্তু সমন্বয় কমিটির আন্দোলনের জেরে দুই দেশের সরকার উভয় দেশের ছিটমহলে জরিপ করে। সেই জরিপে উঠে আসে ছিটমহলে উভয় দেশের বাসিন্দাদের তালিকা, তাঁদের চাওয়া-পাওয়া। ভারতের ভূখণ্ডের বেষ্টনীতে থাকা ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দা বাংলাদেশের হলেও তাঁরা যেতে পারেন না তাঁদের নিজ দেশ বাংলাদেশে। একই চিত্র কিন্তু বাংলাদেশের বেষ্টনীর মধ্যে থাকা ভারতীয় ছিটমহলগুলোর বাসিন্দাদেরও। ফলে দুই দেশের ছিটমহলবাসী অন্য দেশে পরগাছা হিসেবেই বাস করছেন দীর্ঘকাল ধরে।
এসব কথা মাথায় রেখেই উভয় দেশ ছিটমহল বিনিময়ের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এই ডাকে কতজন সাড়া দেবেন, সে ব্যাপারে শঙ্কায় আছেন ছিটমহল আন্দোলনের কর্মকর্তারা। তাঁরাই বলেছেন, এখন ভারতের ভূখণ্ডে থাকা ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দারা বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাইছেন না। পাশাপাশি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা ভারতীয়রাও ফিরে আসতে চাইছেন অল্পসংখ্যক।
কিন্তু এই পরিস্থিতিও বদলে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে পুনর্বাসনের প্যাকেজ যদি লোভনীয় হয়, আয়ের পথ যদি সুগম হয়, বেঁচে থাকার গ্যারান্টি যদি জোরালো হয়, চাকরিবাকরি এবং আবাসনের সুযোগ-সুবিধা যদি আকর্ষণীয় হয়, তবে সমন্বয় কমিটির এই হিসাব পাল্টে যেতে পারে। আর পাল্টে যাবে এই ধারণা নিয়ে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের প্যাকেজের জন্য খরচ ধরেছে সর্বমোট ৩ হাজার ৮ কোটি ৮৯ লাখ রুপি। এর মধ্যে ৭৭৫ কোটি রুপি ধরা ধরেছে স্থায়ী পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য। আর বাকি ২ হাজার ২৩৩ কোটি ৮৯ লাখ রুপি ধরা হয়েছে পরিবর্তনশীল খরচের জন্য।
অর্থাৎ ওপার থেকে মানুষ কম এলে খরচ কম হবে। আর বেশি এলে বেশি খরচ। এখন শুধু অপেক্ষা করে থাকা, কত মানুষ আসছে ওপার থেকে আর কত মানুষ যাচ্ছে এপার থেকে?
অমর সাহা, প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.