মেধার বিপরীতে কোটা—যৌক্তিক পর্যায়ে হ্রাস করুন by আলী ইমাম মজুমদার

সরকারের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জনপ্রশাসন অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই আমাদের এ প্রতিষ্ঠানটি একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উত্তরোত্তর দক্ষ হবে, এটা সবারই প্রত্যাশা। কোনো সরকারেরই এর ভিন্ন কিছু চাওয়ার কথা নয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের সুশীল সমাজ এবং উন্নয়ন–সহযোগীরা মনে করছে, প্রতিষ্ঠানটির গুণগতমান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। উন্নয়ন–সহযোগীরা মনে করেই থেমে থাকছে না, প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসছে। এতে কাজ কিছুটা হলেও তা প্রান্তিক পর্যায়ে থেকে যাচ্ছে। এ অবক্ষয়ের কারণ বহুবিধ। তার মধ্যে নিয়োগ-প্রক্রিয়া একটি বড় নিয়ামক, এমনটি বলা অসংগত হবে না। এমনিতেই অপ্রতুল বেতন-ভাতা, যুগবাহিত মর্যাদা লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস আর ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি মেধাবীদের সরকারের বেসামরিক চাকরিতে কমই আকর্ষণ করছে। আর যাঁরা আসতে চাইছেন, তাঁদের মধ্য থেকে আমরা মেধার ভিত্তিতে নিচ্ছি মোটে ৪৫ শতাংশ। অবশিষ্ট ৫৫ শতাংশ যাচ্ছে প্রাধিকার কোটায়। এ প্রক্রিয়ায় প্রাধিকারের বরাতে মেধাতালিকায় অনেক নিচে থাকা প্রার্থীরাও গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় চাকরিগুলোয় এসে পড়ছেন। সুতরাং, গোড়াতেই যেখানে গলদ, সেখানে পরবর্তী সময়ে এর মান উন্নয়নের প্রচেষ্টা তেমন সফল হওয়ার কথা নয়। যেমন বীজ, ফলন হবে তেমনই।
প্রশ্ন আসে কেন এমনটা হচ্ছে। আমাদের সংবিধানপ্রণেতারা তো প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগ লাভের জন্য সব নাগরিকের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন। অবশ্য সংবিধানে কোনো অনগ্রসর শ্রেণি বা অঞ্চলের জন্য বিশেষ সুবিধার বিধানও রয়েছে। আর তা যৌক্তিকভাবে থাকলে তেমন কথা ছিল না। এমনকি সমস্যাটি ইতিবাচকভাবে পর্যালোচনাও করা হয় না। কোটা ছিল ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান আমলেও। তবে সেগুলো ছিল অনগ্রসর শ্রেণি আর অঞ্চলের জন্য। সেটা করতে গিয়ে মেধাবীদের চাকরিতে আসার বড় বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়নি। অথচ আমরা তা-ই করে চলছি। অনগ্রসর শ্রেণি, যেমন নারী ও উপজাতির জন্য যথাক্রমে ১০ ও ৫ শতাংশ চাকরি সংরক্ষিত রয়েছে। অনগ্রসর অঞ্চলের কোটাটি রয়েছে জেলার হিসাবে। এ ২৫ শতাংশ বাদে আরও ৩০ শতাংশ রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। আগে এ কোটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। দীর্ঘদিন থেকে প্রশ্ন এসেছে, এঁরা সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি কি না। কেউ কেউ তা হলেও সবাই নন, এ বিষয়ে দ্বিমত করার সুযোগ খুব কম। তার চেয়ে বড় কথা, এখন পর্যন্ত রেজিস্ট্রিকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কমবেশি তিন লাখ। তাঁদের পোষ্য সংখ্যা কত হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এ ধরনের ক্ষুদ্র জনসমষ্টির জন্য ৩০ শতাংশ চাকরি বরাদ্দ রাখার যৌক্তিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্রে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই অংশ। এ ধরনের কোটাব্যবস্থা সে চেতনার বিপরীত অবস্থানে যায় কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন করা চলে। চলমান কোটাব্যবস্থার যৌক্তিকতা নিয়ে অনেক কমিশন-কমিটি কাজ করেছে। এসব কমিশন-কমিটির কোনো একটি এ ব্যবস্থা সমর্থন করেছে, এমনটি দেখা যায় না। তবু তা রয়ে গেছে। এমনকি হয়েছে জোরদার।
কোটা নিয়ে কয়েকটি কমিশন-কমিটির মতামত আলোচনার দাবি রাখে। স্বাধীনতার পরপরই বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত চাকরি পুনর্গঠন কমিশন ১৯৭৩ সালে আর ১৯৭৭-এ বেতন ও চাকরিসংক্রান্ত রশিদ কমিশন কোটাপদ্ধতির সুস্পষ্ট বিরোধিতা করে। তাদের মতে, কোটাপদ্ধতি একটি শীর্ষ মানের জনপ্রশাসন গড়ার প্রতিবন্ধক হবে। আর দক্ষ জনপ্রশাসন গঠনের সূচনাটা হতে পারে একটি সুষ্ঠু নিয়োগ-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কাঙ্ক্ষিত উঁচু মানের জনপ্রশাসন দুর্বল নিয়োগ-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হতে পারে না। কোটাব্যবস্থাকে জাতীয় সংহতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও এ প্রতিবেদনগুলোয় আলোচিত হয়েছে। ঠিক তেমনি দীর্ঘ পাঁচ বছর কাজ করে ২০০০ সালে প্রতিবেদন দেয় এ টি এম শামসুল হকের নেতৃত্বাধীন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। সে প্রতিবেদনে কোটাব্যবস্থাকে সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ রয়েছে। তাদের মতে, চলমান কোটাব্যবস্থা কোনো যৌক্তিক ভিত্তির দ্বারা সমর্থিত নয়; বরং এটা জনপ্রশাসনের গুণগত মান হ্রাসে প্রভাব ফেলছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনও তাদের বিভিন্ন বার্ষিক প্রতিবেদনে এ কোটাব্যবস্থা মেধাভিত্তিক জনপ্রশাসন গড়তে বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সুপারিশ করেছে ক্রমান্বয়ে এ ব্যবস্থা বিলুপ্তির। ১৯৯৩ সালে তদানীন্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. আইয়ুবুর রহমানের নেতৃত্বে চারজন সচিবের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি এ কোটাপদ্ধতি নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় মেধাকে অস্বীকারের নামান্তর বলে মন্তব্য করেছে। বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে মেধাভিত্তিক নিয়োগের পক্ষে তারা মত দিয়েছে।
কোটাব্যবস্থার ভিন্ন একটি দিকও পর্যালোচনার দাবি রাখে। জেলাভিত্তিক কোটা দেওয়া হয়েছিল মূলত অনগ্রসর জেলাগুলোকে কিছুটা বিশেষ সুবিধা দিতে। কিন্তু বাস্তবে এ জেলা কোটা উন্নত-অনুন্নত সব জেলার জনসংখ্যা অনুপাতে ভাগ হচ্ছে। অনুন্নত জেলাগুলোর জন্য একটি থোক কোটা একত্রে রেখে শুধু সেই জেলাগুলোর প্রার্থীদের থেকে মেধা অনুসারে নিয়োগ দেওয়া হলে কিছুটা যুক্তিসংগত হতো। উপজাতি কোটার সুফল মূলত ভোগ করছে পাহাড় ও সমতলে বসবাসকারী বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে আর্থসামাজিক বিবেচনায় অগ্রসর এক-দুটি গোত্র। অন্যরা সেই তিমিরেই থাকছে। ভর্তুকির সুফল যেমন প্রায় ক্ষেত্রে বৃহত্তর বিবেচনায় ধনিক শ্রেণির কাছেই যায়, এসব ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটে চলছে।
আশার কথা, চলমান কোটাপদ্ধতি নিয়ে হাল আমলে নীতিনির্ধারণী মহলেও গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। অতি সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির এক সভায় একজন সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা তৃতীয় প্রজন্মের জন্যও সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে তীব্র আপত্তি করেছেন। অবশ্য সভাটিতে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে মতামতটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ; এটা যুগের দাবির সঙ্গে সংগতিপূর্ণও বটে। সরকারের বর্তমান অবস্থানও কোটাপদ্ধতিকে একটি যৌক্তিক পর্যায়ে নেওয়ার পক্ষে বলেই মনে হচ্ছে। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্রটি অনুমোদিত হয়। এ কৌশলপত্রে করণীয় কর্মপরিকল্পনার মধ্যে কোটাপদ্ধতি যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে মেধা কোটা বৃদ্ধির প্রত্যয়ও ঘোষিত হয়েছে। তবে এ প্রত্যয় বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর উদ্যোগ এখনো লক্ষণীয় হয় না।
উল্লেখ করা সংগত, কোটাপদ্ধতি রয়েছে জনপ্রশাসনের প্রতিটি অঙ্গের নিয়োগ পর্যায়ে। বিসিএসের অঙ্গ হিসেবে বাদ যাননি কলেজশিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষিবিজ্ঞানী কিংবা এমন কেউ। এমনকি জনপ্রশাসনের অঙ্গ না হলেও এটা কার্যকর করা হয়েছে অধস্তন বিচার বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে। সুতরাং নিম্ন আদালতের বিচারক, প্রশাসক, কূটনীতিক, চিকিৎসক, শিক্ষকসহ সব নিয়োগের ক্ষেত্রেই আমরা মেধাকে গৌণ বিবেচনায় নিচ্ছি। দীর্ঘকাল এ ব্যবস্থা চলতে থাকায় এসব চাকরির মান যে নেমে যাওয়াই স্বাভাবিক, তা আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা পদে নিয়োগে নেই কোনো কোটার বালাই। তাই তাঁরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানের মান ধরে রাখতে সক্ষম হবেন এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করবেন, এটাই স্বাভাবিক।
এটা অনস্বীকার্য, কোটাপদ্ধতি রাতারাতি রদ করা যাবে না। আর সমাজের অনগ্রসর অংশের জন্য কোটা সংরক্ষণের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতাও রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্যও তাঁদের সংখ্যার অনুপাতকে বিবেচনায় নিয়ে আরও কিছুকাল এ কোটা চালু রাখার প্রয়োজন থাকবে। তবে সবকিছু মিলিয়ে প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ২০ শতাংশের ওপর প্রাধিকার কোটা রাখা অসংগত হবে। এখন নিয়োগ পর্যায়ে সরকার মেধাকে প্রাধান্য দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর অবশ্যই এ অঙ্গীকার তাদের সুস্পষ্ট উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ। সোনার বাংলা গড়তে একটি দক্ষ জনপ্রশাসন আবশ্যক। এটা কারও না বোঝার কথা নয়। তাহলে আমরা সে অঙ্গীকারের আশু বাস্তবায়নও চাইতে পারি।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.