আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ২০৪১ by মাহবুব তালুকদার

জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দৌড়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেমে যাওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফোন করে তিনি তার এই দুঃখের কথা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এই দুঃখ প্রকাশের বার্তাটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এত বড় একটি বিষয় বান কি মুন কেন সরাসরি বেগম খালেদা জিয়াকে জানালেন না, এটা আমার প্রশ্ন। জাতিসংঘ সদর দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ জাতিসংঘ মহাসচিবের মন্তব্য বা বক্তব্যটিকে কেন তুলে ধরলেন না, সেটাও আমার জিজ্ঞাসা।
চাচাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেই চাচা বললেন, এতে অসুবিধা কি হয়েছে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের একান্ত সচিবও বিষয়টি প্রকাশ করলে কোন অসুবিধা ছিল না। চাচা আরও বললেন, বিএনপি সাংগঠনিকভাবে খুবই দুর্বল। নিজেদের অবস্থা বুঝতে পেরে তারা নির্বাচনে পিঠটান দিয়েছে। সফরকারী মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শ্যারমেন পর্যন্ত বিএনপির নির্বাচন বয়কটে হতাশা ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। জনগণ যে বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, মার্কিনিরা ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না।
কিন্তু তারা তো নির্বাচনে অনিয়মের কথাও তুলে ধরেছেন।
কিছু অনিয়ম তো হতেই পারে। সহস্র নাগরিক কমিটি বলেছে নির্বাচন ছিল উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ। নির্বাচন যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ ছিল প্রধান নির্বাচন কমিশনারও তা বলেছেন।
চাচা! এত কিছুর পর এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ছিল?
অবশ্যই ছিল। তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে একজন লোকও মারা যায়নি।
লোকের মৃত্যু বা মৃত্যুর সংখ্যা দিয়েই কি নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ছিল কিনা, তা বিচার করা যায়?
কেন যাবে না? এছাড়া শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আর কি মাপকাঠি আছে বলো? মাত্র দু-তিনশ’ কেন্দ্রে যে গোলযোগের কথা উঠেছে, সেটা কোনো ব্যাপারই না।
নির্বাচন কমিশন তো বিরোধী দলের কোন অভিযোগ আমলেই নেয়নি।
কে বলেছে? চাচা সরোষে বলে উঠলেন, নির্বাচন কমিশন সবার অভিযোগই আমলে নিয়ে ডব্লিউপিবি-তে জমা করে রেখেছে।
ডব্লিউপিবি মানে?
মানে, ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট। পরদিন ঝাড়ুদার তুলে না নেয়া পর্যন্ত সেগুলো সেখানেই ছিল।
আমি বললাম, মিডিয়া বলছে, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি।
মিডিয়ার কথা আর বলো না। আমাদের দেশে মিডিয়া হচ্ছে বেইমান। সরকারের টাকা খেয়ে তারা সরকারের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
সরকারের টাকা খেল কীভাবে?
কেন? ওরা সরকারের বিজ্ঞাপন পায় না? চাচা হতাশ কণ্ঠে আরও বললেন, যেসব টিভি চ্যানেলকে বর্তমান সরকার লাইসেন্স দিয়েছিল, যেসব আওয়ামী চ্যানেল মালিকের পকেট ভারি করে দিয়েছিল, তাদের চ্যানেলে পর্যন্ত নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়মনের ঘটনা প্রকাশ করেছে। নইলে বিদেশীরা আমাদের নির্বাচনের অনিয়মের এত খবর পেল কীভাবে?
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শারম্যান সিটি নির্বাচনে অনিয়মের স্বচ্ছ তদন্তের তাগিদ দিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশও একই কথা বলেছে। এটা কী করা হবে? আমার জিজ্ঞাস্য।
চাচা বললেন, আমরা বিদেশীদের কথায় চলি না। আমরা ওদেরকে থোড়াই কেয়ার করি। আমাদের প্রাণপ্রিয় মন্ত্রী শাজাহান খান খালেদা জিয়াকে পেশাদার খুনি বলেছেন। খুবই সত্য কথা। ওইসব বিদেশী একজন খুনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তার বাসায় যায় কেন? তিনি তো সংসদে বিরোধী দলের নেতাও নন। মিডিয়ার আচরণও বড় অদ্ভুত। আসল বিরোধী দলের সঙ্গে, মানে বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে বিদেশীদের সাক্ষাতের কোনো গুরুত্ব না দিয়ে তারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের গুরুত্ব বেশি দেয়।
তারা হয়তো খবরের গুরুত্ব বেশি বিবেচনা করে, ব্যক্তির গুরুত্ব তেমন বিবেচনা করে না।
ঠিক বলেছ। চাচা এবার উদ্দীপ্ত হয়ে বললেন, আজ পর্যন্ত মিডিয়ার কাউকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে দেখলাম না। তুমি কি বলতে পার, এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি লাভ কার হয়েছে?
আওয়ামী লীগ। আমি জানালাম।
মোটেই না।
তাহলে বিএনপি?
না। চাচা বললেন, সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে জাতীয় পার্টির।
কীভাবে হলো? তাদের সব প্রার্থীর তো জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
তুমি আমার কথা ঠিক বুঝতে পার না। আমি প্রার্থীর লাভের কথা বলিনি। পার্টির লাভের কথা বলেছি। জাতীয় পার্টির লাভ হয়েছে বলেই অন্যদের মতো তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়নি। তাদের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন নিয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেননি।
তাতে জাতীয় পার্টির কি উপকার হয়েছে?
তুমি রাজনীতি বোঝ না বলে এসব কথা বলছ। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টি তাকিয়ে দেখছিল বিএনপি নির্বাচনের আগেই সরে দাঁড়ায় কিনা! জাতীয় নির্বাচনের মতো তখন তারা সামনে এগিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু হটকারি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের প্রোগ্রামটা ভণ্ডুল করে দিল।
কিন্তু এখন জাতীয় পার্টির কি লাভ হয়েছে?
ধৈর্য ধর। বলছি। ২৮শে এপ্রিলের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির একাত্মতা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। সেজন্য নির্বাচন সম্পর্কে তাদের কোন সাড়াশব্দ নেই। জাতীয় পার্টি জাতীয় সংসদের বিরোধী দল। সিটি করপোরেশন নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তাদের লক্ষ্য আগামী জাতীয় নির্বাচন। মাননীয় মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনও আওয়ামী লীগের অধীনে হবে। আশা করি গতবারের মতো সেই নির্বাচনেও বিএনপিকে ভোটের বাইরে রাখা সম্ভব হবে। জাতীয় পার্টি তখনও হবে আবার সংসদে বিরোধী দল। অর্থাৎ এবারের মতো কয়েকজন মন্ত্রীও থাকবে তাদের। রাজনীতিটা বুঝলে?
চাচা! বিএনপির লাভক্ষতির বিষয়ে কিছু বলুন।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মতো দূরদর্শী নেত্রী ইতিহাসে বিরল। তিনি-
আমি বিএনপি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাচ্ছিলাম।
সে কথাই তো বলছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে কৌশলে মানুষ পোড়ানোর রাজনীতি থেকে নির্বাচনে নিয়ে এসেছেন। এতে বিএনপির লাভ হয়েছে না ক্ষতি হয়েছে, তারা আত্মজিজ্ঞাসা করলে বুঝতে পারবে। তবে তোমাকে একটি কথা বলতে চাই। বিএনপির মনস্তত্ত্ব প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে আর কেউ ভালোভাবে বুঝতে পারে না। তিনি বিএনপিকে হাড়ে হাড়ে চেনেন।
হাড়ে হাড়ে চেনার সঙ্গে মনস্তত্ত্বের কোন সম্পর্ক আছে কি?
অবশ্যই আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে সেদিন বলেছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন নস্যাৎ করার লক্ষ্যে লাশ ফেলার আরও খারাপ পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। হত্যার মাধ্যমে লাশ ফেলে বিএনপি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে যেতে চেয়েছিল।
বিএনপির এমন পরিকল্পনার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানলেন কি করে?
ওই যে তোমাকে বললাম, তিনি বিএনপির মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারেন। আমাদের ভাগ্য ভাল যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্কতার কারণে বিএনপির কু-অভিসন্ধি থেকে দেশকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
তাহলে নির্বাচনে বিএনপির কি কোনো অর্জন নেই?
আছে। দেশের মানুষ যে বিএনপিকে বর্জন করেছে, এটাই তাদের অর্জন।
সেটা কি বিএনপি বুঝতে পেরেছে?
হয়তো পেরেছে। সেজন্যই নির্বাচনের পর তারা আর কোন হুমকি-ধমকি দিতে সাহস করছে না। আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারার দুঃসাহস আর তারা দেখাতে পারবে না।
চাচা! এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অর্জন কি?
আওয়ামী লীগের অর্জন বহুমাত্রিক। না, আমি নির্বাচনে জেতাকে অর্জন বলব না। এটা ছিল আওয়ামী লীগের জন্য সহজাত ও স্বাভাবিক একটা বিষয়। তবে এবারের নির্বাচনে সাময়িক আনসাররা একটা ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে।
সাময়িক আনসার মানে?
মানে, আনসার বাহিনীর জ্যাকেট পরিয়ে যেসব স্কুলের বাচ্চাদের নির্বাচনের দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। আগামীতে ওদের বয়স বাড়িয়ে নিয়োগ করা হলে ওরা নির্বাচনে আরও ভালো অবদান রাখতে পারবে। তবে জাতীয় নির্বাচনের জন্য হাজার হাজার সাময়িক আনসার নিয়োগ জরুরি। তাদের বাছাই প্রক্রিয়া আনসার কর্তৃপক্ষের হাতে না থেকে পুলিশের কাছে ন্যস্ত করা উচিত। তারা জানে কারা কারা সাময়িক আনসার হওয়ার যোগ্য। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাদের কি করতে হবে, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণও প্রয়োজন।
চাচা! আমার প্রশ্ন ছিল নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অর্জন কী? সেটা তো সরকারের অর্জন নয়।
চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, আওয়ামী লীগ আর সরকার কি আলাদা? জনগণের সরকার ও জনগণের আওয়ামী লীগের এমন মেলবন্ধন তুমি বিশ্বের আর কোন দেশে দেখতে পাবে না। এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য সরকার ও আওয়ামী লীগের একটি যৌথ মহড়া হয়ে গেল। দেশবাসীকে আশ্বাস দিতে পারি যে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মতোই অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে।
কিন্তু বিদেশীরা যে নির্বাচনের মান আরও উন্নত করতে বলেছে?
হুঁ! চাচা গম্ভীর হয়ে বললেন, এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে বিদেশীদের চাপের কাছে অবনত না হওয়া। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে থোড়াই কেয়ার করে বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক মহলের সামনে মাথা উঁচু রাখার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, দেশবাসীও তার সঙ্গে একাট্টা।
তাহলে ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগই আসছে?
শোনো! আগামী পঁচিশ ছাব্বিশ বছর দেশকে স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে তুলে দেয়ার কারণ নেই। ২০১৯ সালের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ মোটেই ভাবছে না। তাদের দৃষ্টি অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী। আগামী ২০৪১ পর্যন্ত।
২০৪১ সাল পর্যন্ত কেন?
ওই সময় পর্যন্ত দেশকে উন্নত দেশের সারিতে নিয়ে যেতে চায় আওয়ামী লীগ। মধ্যম আয়ের দেশ নয়, উচ্চ আয়ের দেশ হবে বাংলাদেশ। এটাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের ভিশন। তুমি কি দেশের উন্নয়ন চাও না?
অবশ্যই চাই।
তাহলে মনে রেখ ২০৪১। আপাতত: ওই ফিগারটা আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। চাচা হেসে বললেন।

No comments

Powered by Blogger.