শান্তিপূর্ণ বনাম সহিংস আন্দোলন by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে এখন এ কথা স্পষ্ট যে বর্তমান সরকার বিএনপি বা ২০-দলীয় জোটের সঙ্গে কোনো সংলাপ করতে আগ্রহী নয়। নানা কৌশলে আওয়ামী লীগ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে চায়। বিএনপি নির্বাচন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে পরাজিত হয়েছে। বিএনপির নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্য শুনে মনে হয়, তাঁরা আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চান। এ ছাড়া বিএনপির আর বিকল্প কিছু নেই। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বড় নেতারা বারবার বলেছেন, ‘তাঁরা বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন প্রশ্নে কোনো সংলাপে আগ্রহী নন।’ আওয়ামী লীগের এই অবস্থান গণতন্ত্রমনা ব্যক্তি ও বিদেশি বন্ধুরা কীভাবে নেবেন জানি না। তবে এটুকু বুঝতে পারি, আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা এগুলোকে থোড়াই কেয়ার করেন। ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অনেক নেতাই বলেছিলেন, ‘এটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। কিছুদিন পরেই সব দলের অংশগ্রহণে আবার নির্বাচন হবে।’ (সূত্র: বিভিন্ন সংবাদপত্র, টিভি, বেতার) মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই এখন এই বক্তব্য প্রকাশ্যে ও মিডিয়ায় অস্বীকার করছেন। কোনো গবেষক নভেম্বর-ডিসেম্বরের (২০১৩) পত্রপত্রিকা ও টিভির ‘খবর’ থেকে আওয়ামী লীগের নেতাদের এই বক্তব্যের একটা সংকলন প্রকাশ করে এই মিথ্যাচারের জবাব দিতে পারেন। বিএনপিও এ কাজ করতে পারে।

আমাদের রাজনীতিতে মিথ্যাচার, কথা বলে তা ফিরিয়ে নেওয়া, কথা অস্বীকার করা, ভুল স্বীকার না করা—এগুলো কোনো ‘অন্যায়’ বলে বিবেচিত হয় না। রাজনীতিবিদেরা নিজেরাই একটা ধারণা তৈরি করেছেন, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।’ এ কথার কোনো অর্থ হয় না। একমাত্র সুবিধাবাদী ও স্বার্থপর রাজনীতিকেরাই এমন কথা বলতে পারেন। যাঁরা এ কথাটি বলেন, বুঝতে হবে, তাঁরা আদর্শের রাজনীতি করেন না, ধান্দার রাজনীতি করেন। কাজেই ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ এখন যে আগের কথা অস্বীকার করছে, তা আমাদের রাজনীতিতে নতুন নয়। দেশের পরিস্থিতি এখন আন্দোলনের অনুকূলে নয়, এটা আওয়ামী লীগের নেতারা বুঝতে পেরেছেন বলে আগের কথা অস্বীকার করছেন। এটাও তাঁদের একটা কৌশল।
বিএনপির অবশ্য উচিত শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দেওয়া। কারণ শেখ হাসিনা সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিএনপিকে সরাসরি মাঠে নামার সুযোগ করে দিয়েছেন। সরকার চাইলে সংলাপের নামে এক-দুই বছর সময়ক্ষেপণ করতে পারত। দেশে ও বিদেশে এমন একটা ধারণা দিতে পারত যে সরকার নির্বাচন নিয়ে সংলাপ করছে। দেশে তো বটেই, বিদেশেও বিভিন্ন বন্ধু সরকার বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। শেখ হাসিনা সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিদেশে বন্ধু সরকারগুলোর কাছেও এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন, ‘তাঁর সরকার সংলাপে আগ্রহী নয়, তাঁরা বিএনপিকে মাঠে মোকাবিলা করতেই আগ্রহী।’
এখন বিএনপি কী করবে? তাদের দলের পক্ষ থেকে বারবার আন্দোলনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সরকার বলেছে, ‘বিএনপির শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকার বাধা দেবে না। তবে সহিংস আন্দোলন হলে সরকার জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’ বিএনপি কী ধরনের আন্দোলন করার চিন্তা করছে, তা আমরা জানি না। আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হলে তা আমরা জানতে পারব। আমরা আশা করতে চাই, বিএনপি বা ২০-দলীয় জোট শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করবে। সহিংস, ধ্বংসাত্মক বা জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন বিএনপি করবে না এবং জোটের মধ্যে কেউ করলে তার দায়িত্বও বিএনপি নেবে না।
অনেকে আশঙ্কা করছেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হলেও সরকারের এজেন্টরা বোমাবাজি করতে পারে, গাড়ি পোড়াতে পারে, সম্পত্তি ধ্বংস করতে পারে। এগুলো যে বিএনপি বা জামায়াতই করছে, তা প্রমাণ করা যাবে কীভাবে? সরকারই এ রকম ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে বিএনপি বা ২০-দলীয় জোটের প্রথম কাতারের নেতাদের সন্ত্রাসের অভিযোগে গ্রেপ্তার করার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। লোকের কাছেও তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে পারে। গত আন্দোলনের সময় সরকার যদি গাড়িতে আগুন লাগানোর অভিযোগে সেলিমা রহমানকে গ্রেপ্তার করতে পারে, তাহলে বিএনপির সব নেতাকেই গ্রেপ্তার করা যায়। সরকারের যে এ রকম নীলনকশা নেই, তা কে নিশ্চিত বলতে পারেন? এই আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রস্তাব, বোমাবাজি, গাড়িতে বা বাসে আগুন দেওয়া, সম্পত্তি ধ্বংস করার কাজে যারা যুক্ত থাকবে, প্রথমত, তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। কারণ, প্রধানত তারাই প্রকৃত অপরাধী। অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা ও শাস্তি দেওয়াই হলো আইন। বাস্তবে দেখা যায়, সরকার তাদের গ্রেপ্তার না করে ‘পরিকল্পনাকারী’, ‘অর্থ জোগানদাতা’ অভিযোগে বিএনপির নেতাদের গ্রেপ্তার করে।
এ ব্যাপারে বিএনপি কী কৌশল অবলম্বন করবে জানি না। তাঁরা কী ধরনের আন্দোলন করতে চায় বা আন্দোলন করার শক্তিই বা তাদের কতটুকু আছে, তা–ও জানি না। সময়ই সব বলে দেবে আমাদের। নাগরিক সমাজ এখনো অন্ধকারে। তবে বিএনপি যদি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনই করতে চায়, সরকার তা ‘শান্তিপূর্ণ’ থাকতে দেবে না বলে অনেকের আশঙ্কা। আন্দোলন যদি শান্তিপূর্ণই হয়, তাহলে সরকার বা আওয়ামী লীগ ঝাঁপিয়ে পড়বে কার ওপর? বিএনপির নেতাদের গ্রেপ্তার করার উপলক্ষই বা কী হবে? আন্দোলন দমন করবেই বা কোন অজুহাতে? বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করবে আর সরকার বসে বসে সে দৃশ্য দেখবে, এটা কি বাস্তবসম্মত? তা ছাড়া তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা তো বলেই দিয়েছেন, ‘মাঠে দেখা হবে।’ শেখ হাসিনা তো কর্মীদের এ কথা বলেন, ‘গ্যালারিতে দেখা হবে।’ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হলে আওয়ামী লীগের মাঠে নামার কোনো সুযোগ হবে না।
আমরা আশা করি, বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনই করবে। আওয়ামী লীগকে মাঠে নামতে হবে না। গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে পারবে। এমনকি বাড়িতে বসে টিভিতেও দেখতে পারবে। তবে এই আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল না। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভূত রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা যেত। শেখ হাসিনার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও দম্ভের কারণে বিএনপি মাঠে নামার সুযোগ পেয়ে গেল।
বিএনপি একদিকে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, অপর দিকে আদালত বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা সচল করছেন। বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ ৪১ জন নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগ ও ত্রাস সৃষ্টির মামলায় বিচার শুরু হয়েছে। এ নিয়ে এ ধরনের পাঁচটি মামলায় প্রায় ২০০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এগুলো ছাড়াও আরও অন্তত ৭০টি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। (প্রথম আলো, ৩ সেপ্টেম্বর) পাঠক লক্ষ করুন, অভিযোগগুলো কী? ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগ। নিঃসন্দেহে এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আদালতের বিজ্ঞ বিচারকেরা তাঁদের জ্ঞান বিবেচনামতো আসামিদের অপরাধ প্রমাণিত হলে নিশ্চয় যথাযথ শাস্তি দেবেন।
এই মামলাগুলো বিএনপির নেতারা কীভাবে মোকাবিলা করবেন জানি না। এই মামলা থেকে শাস্তি এড়ানোর কোনো পথ আছে কি না, তা আইনজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। যেসব অভিযোগে মামলাগুলো দেওয়া হয়েছে, ঘটনাগুলো তো ঘটেছে। এটা তো মিথ্যা নয়। এখন কে সেই ঘটনা ঘটিয়েছে, সেটাই হলো প্রশ্ন। বিএনপি এখন আন্দোলন করলে আবার একই ঘটনা ঘটবে না, তা কে বলতে পারে? আবার একই ঘটনা ঘটলে এবার নতুন ২০০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া সহজ হবে।
এগুলো আমাদের দূষিত রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। যে দল ক্ষমতায় থাকে, সে তার দলের নেতা-কর্মীদের সাত হাজার মামলা তুলে নিতে পারে। দল ক্ষমতায় থাকলে নেতা-কর্মীদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। এ ব্যাপারে আদালতও নিশ্চুপ। মিডিয়াও যে এর বিরুদ্ধে খুব সোচ্চার হয়েছিল এমন দাবি করা যাবে না।
বিএনপির সামনে এখন দুটি পথ: ১. আন্দোলন করা ও আগের মামলাগুলোর কারণে নেতাদের কারাদণ্ড মেনে নেওয়া, ২. আন্দোলন না করা ও মামলাগুলো নিষ্ক্রিয় করা।
অনেকের ধারণা, এই রাজনৈতিক মামলাগুলোর বিচার হলে বিএনপির প্রথম সারির অনেক নেতাই কারাদণ্ড এড়াতে পারবেন না। অগ্নিসংযোগ বা ত্রাস সৃষ্টিতে নেতারা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিক বা না নিক। বিচারে নেতাদের কারাদণ্ড হবে বলে অনেকের আশঙ্কা। আন্দোলনের সময় বিএনপির নেতাদের কারাদণ্ড দেওয়ার জন্যই এই মামলাগুলো দেওয়া হয়েছে। এটা বোঝার জন্য বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। বিএনপি যদি মাঠে নেমে আন্দোলন না করে, শুধু টিভির সামনে হুমকি দিতে থাকে, তাহলে এই মামলাগুলোর গতি শ্ল­থ হয়ে যেতে পারে। জানি না বিএনপি কোনটি বেছে নেবে।
আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কথা বলছি। সাধারণ ভোটারদের কথা বলছি না। তাঁরা যে গত সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি, তার কী হবে? বিএনপি ও আওয়ামী লীগের লাঠালাঠির জন্য তাঁদেরও কি আরও পাঁচ বছর ভোটের জন্য অপেক্ষা করতে হবে? ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে আবার প্রমাণিত হয়েছে যে সাধারণ মানুষ (ভোটার) রাজনীতিতে কোনো ফ্যাক্টর নয়। বড় কয়েকটি রাজনৈতিক দলের স্বার্থই প্রধান ইস্যু। তারাই ‘জনগণের’ নামে ও ‘রাজনীতির’ নামে লুটপাট করে চলেছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন কবে হবে জানি না। আদৌ কি হবে?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.