জন্মশতবর্ষ উদযাপন ও একটি প্রতিকৃতি by রাজু আলাউদ্দিন

রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী ভারতে যেমন, তেমনি আর্জেন্টিনায়ও বিশেষ মর্যাদায় এবং নানা রকম কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উদযাপিত হয়েছিল। আর্জেন্টিনায় যে ঘটা করে উদযাপিত হতে পেরেছিল তার পেছনে একটা বড় ভূমিকা ছিল মূলত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোরই। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কয়েক দিনব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠান, রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত সুর (Sur) পত্রিকার বিশেষসংখ্যা প্রকাশ এবং সরকারি পর্যায়েও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেরিয়েছিল ২ পেসোর মুদ্রামানের একটি ডাকটিকিট আর সঙ্গে ছিল একটি স্মরণিকা। স্মরণিকাটি বের করেছিল আর্জেন্তিনার যোগাযোগ মন্ত্রণালয় (Secretaria de comunicaciones) আর এ স্মরণিকায় রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের পরিচয়জ্ঞাপক চুম্বকধর্মী দুই পৃষ্ঠার একটি লেখা লিখেছিলেন জন্মশতবর্ষে ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপক পরিষদের সভাপতি’ (Presidente comision de homenaje a Rabindranath Tagore) ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। ওকাম্পো এতে লিখেছিলেন :
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার দারাকানাথ ঠাকুর লেনের যে বাসাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঠিক সেখানেই ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রিন্স দারাকানাথ ঠাকুরের নাতি বা মহর্ষি (Gran Santo) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে। দেবেন্দ্রনাথ পিতার উল্লেখযোগ্য বিষয়-সম্পদের উত্তরাধিকার অর্জন করলেও আইনের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে তার বিরাট অংশ হারিয়ে ফেলেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ এক মহৎ চরিত্রের অধিকারী যার উত্তরাধিকার বর্তেছিল রবীন্দ্রনাথে, রবীন্দ্রনাথ তার বিষয়-সম্পদ এমনকি নোবেল পুরস্কারের অর্থ ও লেখকস্বত্বও দান করেছিলেন নিজের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং শান্তিনিকেতনকে।
ঠাকুর পরিবারের সবাই ছিলেন প্রতিভাদীপ্ত এবং শিল্পানুরাগী। মহর্ষির চতুর্দশ সন্তানদের মধ্যে কনিষ্ঠতম রবীন্দ্রনাথের বিপুল খ্যাতির সূচনা হয় যখন ইংরেজ কবি ইয়েটস কবিকৃত গীতাজ্ঞলির কিছু অনুবাদ পাঠ করেন। গীতাঞ্জলির প্রকাশ এবং ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি বিশ্বখ্যাত হয়ে ওঠেন। ফ্রান্সে (আঁদ্রে) জিদ, স্পানঞায় সেনোবিয়া ও হুয়ান রামোন হিমেনেথ সত্যিকারের আবেগ নিয়ে তার লেখা অনুবাদ করেছেন, ফরাসি এবং স্পানঞল, দুই অনুবাদকই পরে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। এটা বললে পুনরুক্তি হবে না যে রবীন্দ্রনাথ শুধু মহান কবিই ছিলেন না (যদিও এটাই হতে পারে তার সর্বোচ্চ অভিধা), নেহেরুর ভাষায় ‘তিনি ছিলেন স্বাপ্নিক ও কর্মযোগী, গীতিকার ও দার্শনিক, নাট্যকার, অভিনেতা, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ, মানবতাবাদী, জাতীয়তাবাদী বা আন্তর্জাতিকতাবাদী। যদিও তার জীবনের এ সংক্ষিপ্ত রূপরেখা, তিনি যা ছিলেন সে সম্পর্কে আমাদের কেবল সামান্য ধারণা দেয় মাত্র।’
রবীন্দ্রনাথের কাছে কেবল শিল্পীর সমস্যাবলীই আগ্রহের বিষয় ছিল না।
তার সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তার একটা বিষয় ছিল দ্রুত যোগাযোগে সক্ষম আধুনিক পৃথিবীতে সহিংস সংঘাতের সূচনাকারী মানুষের আবির্ভাব।
১৯১৩ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘জাতিবিদ্বেষের সমস্যাটি আমাদের যুগে এক জলন্ত প্রশ্ন এবং মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বিজয় সম্পন্ন হওয়ার আগে দুর্ভোগের জন্য আমাদের প্রস্তুত হওয়া দরকার।’
রবীন্দ্রনাথ গোটা পৃথিবী সফর করেছেন। তিনি আমন্ত্রিত হয়ে সফর করেছেন ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি, রাশিয়া, চীন, জাপান, ইরান, থাইল্যান্ড, আমেরিকা, পেরু। লিমার (১৯২৪) উদ্দেশে সর্বশেষ ভ্রমণটি সম্পন্ন করতে পারেননি, কারণ বুয়েনোস আইরেসে আসার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ডাক্তার তাকে পার্বত্য এলাকা অতিক্রম না করার পরামর্শ দেন। ওই কারণে তিনি আর্জেন্টিনায় অবস্থান করেন এবং মাস দুয়েক তিনি সান ইসিদ্রোতে কাটান। লেখক ও জ্ঞানীগুণী, রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের দ্বারা তিনি অভ্যর্থিত হয়েছিলেন।
তার নাট্যকর্ম, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাসগুলো স্পানঞা এবং আর্জেন্টিনায় প্রকাশিত হয়েছে। যদিও তার বহু লেখাই অনুবাদের অপেক্ষায় আছে (অন্যান্য লেখার মধ্যে সান ইসিদ্রোতে অবস্থানকালে লেখা তার কবিতাগুলোও রয়েছে, গ্রন্থাকারে যার শিরোনাম পুরবী।) এখনও পর্যন্ত। পাঠকরা সহজেই নিজেদের কৌতূহলকে তৃপ্ত করতে পারবেন এ কারণে যে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম সুলভ সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে।
তার বন্ধু গান্ধী ও নেহেরুর পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে তিন ব্যক্তিত্বের একজন। তার ব্যক্তিত্বের অভিঘাত কেবল ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়। গোটা পৃথিবী তার প্রতি যে সম্মান ও ভালোবাসা দেখিয়েছে তা কেবল মহৎ কবিদের মতো ব্যক্তিত্বরই অর্জন করতে পারেন যারা একই সঙ্গে মহৎ মানুষও।
এ ছিল স্মরণিকায় ওকাম্পোর লেখাটির পূর্ণাঙ্গ রূপ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার একাধিক লেখা রয়েছে এবং সেসব লেখা গ্রন্থাকারেও বেরিয়েছে, কিন্তু এটি এখনও পর্যন্ত কোনো গ্রন্থে তো নয়ই, এমনকি সম্ভবত তার রচনাবলীর কোনো খণ্ডেও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এটিই সম্ভবত তার সংক্ষিপ্ততম রচনা। হয়তো এ স্মরণিকার কারণেই এটি লেখা এবং সে কারণেই এ হ্রস্ব আয়তন। রবীন্দ্র স্মরণিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালের ১৩ মেতে। স্মরণিকাটিতে ছাপা হয়েছিল আর্জেন্টিনার শিল্পী ওরাসিও আলবারেস বোয়েরোর আঁকা রবীন্দ্রনাথের একটি প্রতিকৃতি। এটি খুব সম্ভবত ওরাসিও এঁকেছিলেন রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে প্রকাশিত রবীন্দ্র-স্মারক ডাকটিকিটের জন্য। এ একই প্রতিকৃতি ছাপা হয়েছে এ স্মরণিকাটিতেও। রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিসহ ডাকটিকিটের মুদ্রণসংখ্যা ছিল ৩০ লাখ। এবং তা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল আর্জেন্টিনার সব প্রদেশে।
আর্জেন্টিনায় সম্ভবত রবীন্দ্রনাথই একমাত্র বিদেশী লেখক যার সম্মানে এ আয়োজন এবং ডাকটিকিট প্রকাশ। আর সবটাই সম্ভব হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘বিজয়া’র কারণে। আর্জেন্টিনা সফরকালে জীবদ্দশায় যেমন, তেমনি মৃত্যুর পরও রবীন্দ্রনাথের প্রতি এত সম্মান আর অন্য কোনো দেশে ঘটেছে কিনা সন্দেহ।

No comments

Powered by Blogger.