ব্যালট ও গণতন্ত্রের শক্তি by আলী ইদরিস

প্রবাদ আছে অসির চেয়ে মসি বড়। অর্থাৎ তলোয়ারের চেয়ে কলম শক্তিশালী। কিন্তু এখন তলোয়ারের যুগ নেই, তলোয়ারের জায়গা দখল করেছে বুলেট ও কামান। এখন তাই বলা যায় বুলেট ও কামানের চেয়ে কলম শক্তিশালী। কিন্তু কলমের চেয়েও শক্তিশালী ব্যালট ও গণতন্ত্র। কামান বা বোমা সরবে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে জীবন হরণ ও জনপদ ধ্বংস করে, আর গণতন্ত্র নীরবে, নিভৃতে একটি শক্তিশালী সরকার, দল, গোষ্ঠী বা সাম্রাজ্যকে ভূপাতিত করে দেয়। ব্যালটের শক্তি যে কতটা কার্যকরী যুক্তরাজ্যের সামপ্রতিক গণভোট তা প্রমাণ করে। ৩০৭ বছর যুক্তরাজ্যের অধীনে থেকে স্কটল্যান্ডের অধিবাসীরা স্বাধীনতা লাভ করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতা লাভ করাটা সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা কিনা তা প্রমাণ করতে ব্যালটের মাধ্যমে গণভোটের ব্যবস্থা করা হয়। গণভোটের ৫৫% স্বাধীনতা লাভের বিপক্ষে ভোট দেয় বলে স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে পৃথক হতে পারেনি। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে, সংখ্যালঘিষ্ঠের ইচ্ছা পূরণ হয়নি, কিন্তু গণতন্ত্র তার পূর্ণ শক্তি ও মর্যাদা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। স্বাধীনতা দাবির পক্ষ ও বিপক্ষের জনগণ মুখোমুখি হয়ে প্রকাশ্যে রাজপথে হাঁ ও না ভোটের প্রচার চালিয়েছেন, কিন্তু কোথাও কোন তর্ক-বিতর্ক বা সংঘাত-মারামারি হয়নি। স্কটল্যান্ডবাসী এবং যুক্তরাজ্য সরকার ব্যালটের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সসম্মানে সুরক্ষা করেছে। যুক্তরাজ্য ইচ্ছা করলে অনেক রকম কূটকৌশল বা শক্তি প্রয়োগ করে এ গণভোট বিলম্বিত বা বন্ধ করে দিতে পারতো, কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধার জন্যই তারা তা করে নি। কয়েক মাস আগে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল। সেখানে জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৫ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে ৩০ বছরের ব্যবধানে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিজেপিকে ব্যালটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় বসালো। ১২৭ কোটি লোকের দেশে নির্বাচন কর্মযজ্ঞ যে কত বিশাল এবং কঠিন সেটা অকল্পনীয়। ৮১.৪ কোটি ভোটার ৯ দফায়, ৯ দিনে, ৯ লাখ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। ৩৭ দিন যাবৎ ৯ লাখ নির্বাচন কেন্দ্রে ভোট গণনা করা হয়। ৫০০টি রাজনৈতিক দলের প্রায় ১৫ হাজার প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। বিশাল দেশে বিশাল নির্বাচন কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন, যে কমিশনকে প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগের বিরুদ্ধে প্রশাসন বিন্দুমাত্র প্রভাব খাটায় নি এবং কমিশনও সরকারি দলের ধামাধরা কর্ম করে নিজেদের পক্ষপাতিত্ব প্রমাণ করে নি। সমগ্র প্রশাসন নির্বাচনের সময় তাদের অধীনে কাজ করেছে। বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী অমিত শাহ এক জনসভায় কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে ‘‘বদলা” নিতে তার পার্টিকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানালে নির্বাচন কমিশনের আদেশে জেলা প্রশাসন তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এতেই বোঝা যায় ভারতের নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষমতা প্রয়োগে কত আন্তরিক এবং তৎপর। এমন একটি পড়শি, খাঁটি গণতান্ত্রিক দেশ থেকে আমরা কতটুকু শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছি। কোন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি নি বলেই এ দেশের নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স জাল ভোটে ভরে যায়, অথবা ভোটের দিনে নির্বাচন কর্মকর্তারাই জাল ভোট দেয়, ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয় ইত্যাদি। স্বৈরাচারী এরশাদ দীর্ঘ নয় বছর গণতন্ত্রকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। এরশাদ সরকারের পতনের পর এ দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ভোটাধিকার ফিরে পায়। অতঃপর পাঁচ বার জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, এ সমস্ত নির্বাচনে যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, স্বচ্ছতা পাওয়া গিয়েছিল। ৫ই জানয়ারির এবং উপজেলা নির্বাচনের অরাজকতা অতীতের সব গৌরব বিনষ্ট করে দিয়েছে। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার পথে নির্বাচনের পবিত্র ভূমিকা ৫ই জানুয়ারিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। প্রতিবেশী বৃহৎ শক্তি ও পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারত থেকে গণতন্ত্র ও নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। ভারতের নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করলে উপজেলা নির্বাচনে এত অনিয়ম হতো না। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আর একটি শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতি এবং ভোটগ্রহণের ব্যবস্থাপনা পৃথিবীর মধ্যে আর একটি অনন্য উদাহরণ। গণতন্ত্রের প্রথম এবং মূলভিত্তি নির্বাচন হলেও গণতন্ত্রকে লালন করার জন্য আরও বহুবিধ আচরণ দরকার। সুষ্ঠুভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সরকারের তথা নির্বাচন কমিশনের প্রধান দায়িত্ব। এ উদ্দেশ্যেই সংবিধানের আলোকে নির্বাচন কমিশনকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেয়া হয়। নির্বাচন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগ নির্বাচন কমিশনের প্রধান নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নির্দলীয়। নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এ দু’টি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ ক্ষমতা, স্বাধীনতা ও সুবিধা দিলে সে দেশের গণতান্ত্রিক, সুশাসনিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি কেউ রুখতে পারে না। নির্বাচন কমিশন, দুদক, বিচার বিভাগ ইত্যাদি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো জনমানুষের শেষ আশা-ভরসা ও আশ্রয়স্থল। এগুলো দলীয়করণ বা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না। ৫ই জানুয়ারির ব্যালটবিহীন, ভোটারবিহীন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন একতরফা নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রতি অবমাননা। ব্যালটের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সত্যিকারের মর্যাদা দিলেই সে টিকে থাকবে, নতুবা ভোটাধিকার হরণ করা ভোটারগণ একদিন না একদিন গণতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য বিদ্রোহ করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.