মালিক শ্রমিক মন্ত্রী, সবই তিনি by আনোয়ার হোসেন

নৌপথের নিরাপত্তা ও যাত্রীস্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব এবং পরিবহনব্যবস্থা তদারকির দায়িত্ব যে মন্ত্রণালয়ের, সেই নৌমন্ত্রীর পরিবারই এই খাতের ব্যবসায় নিয়োজিত। দুর্ঘটনাপীড়িত মাওয়া-কাওড়াকান্দি পথে চলাচল–কারী সার্বিক শিপিং লাইনসের মালিক তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এই কোম্পানির লঞ্চের নাম এমভি ঐশী খান।
ঢাকা থেকে মাওয়া ঘাট হয়ে মাদারীপুরের মধ্যে চলাচলকারী বাস সার্বিক পরিবহনের মালিকও নৌমন্ত্রীর পরিবার। এই নৌমন্ত্রীই আবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি।
সড়ক পরিবহন ও নৌপরিবহন খাতের শ্রমিক সংগঠনগুলো বাস ও লঞ্চ থেকে প্রতিদিন চাঁদা তোলে। শ্রমিকনেতা হিসেবে এই দায় শাজাহান খানের। আবার মন্ত্রী হিসেবে এই চাঁদাবাজি বন্ধ করার অন্যতম দায়িত্বও তাঁর।
লঞ্চ ও পরিবহনমালিক, শ্রমিক-নেতা ও মন্ত্রী—এই তিন পারস্পরিক বৈপরীত্য এবং নৈতিকভাবে সাংঘর্ষিক অবস্থানে থেকেও এই দুই খাত দাবড়ে বেড়াচ্ছেন শাজাহান খান। জনপ্রতিনিধি হলেও তাঁর এই স্বার্থের দ্বন্দ্বে উপেক্ষিত কেবল জনগণ। কারণ, লঞ্চ আর সড়ক পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণে অতীতে তাঁকেই মালিকদের পক্ষে সবচেয়ে সক্রিয় দেখা গেছে।

মালিক, শ্রমিকনেতা ও জনগণের স্বার্থে আইনের প্রয়োগকারী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত তৈরি হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে শাজাহান খান গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘না, এমন সংঘাতের সুযোগ নেই। সব দিকে নিয়ন্ত্রণ আছে বলেই এই খাতে শৃঙ্খলা আছে।’ তিনি বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের বলে দিয়েছি, ব্যবসা করবা আইন মেনে। এ ক্ষেত্রে আমি সফল।’
মাওয়া-কাওড়াকান্দি পথে চলাচলকারী এমভি ঐশী খান নৌমন্ত্রীর পারিবারিক লঞ্চ। ঐশী খান মন্ত্রীর মেয়ের নাম। শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, মেয়ে ছাড়াও তাঁর ছোট ভাই, ভায়রা ও শ্যালক লঞ্চটির মালিক। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই লঞ্চটি নামানো হয়েছে।
জানতে চাইলে নৌমন্ত্রীর ভায়রা সিদ্দিক মোল্লা গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ও আমার শ্যালক (নৌমন্ত্রীরও শ্যালক) শেয়ারে এই লঞ্চ ব্যবসা করছি।’ সার্বিক তো নৌমন্ত্রীর কোম্পানি, মালিকও তিনিই হওয়ার কথা—জবাবে সিদ্দিক মোল্লা বলেন, ‘কোম্পানি মন্ত্রীর। কিন্তু মালিক তিনি নন।’
এই বিষয়ে শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালিক চারজন, সবাই আমার পরিবারের। আদর করে সবাই আমার মেয়ের নামে লঞ্চের নাম রেখেছে। আমি মন্ত্রী বলে তাদের তো ব্যবসা করতে মানা নেই। আর সড়ক পরিবহন ব্যবসা আমার বাবার আমলের।’
সার্বিক পরিবহন নামে নৌমন্ত্রীর পরিবারের বাস কোম্পানিও আছে। এই পরিবহনের বাস ঢাকা থেকে মাওয়া-কাওড়াকান্দি ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া—এই দুই পথে চলাচল করে।
মাওয়া, কাওড়াকান্দিসহ দেশের নৌঘাটগুলোর নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এই প্রতিষ্ঠানটি লঞ্চ চলাচলের অনুমোদন দেয়। একই সঙ্গে ভাড়া নির্ধারণ, বাড়তি ভাড়া আদায় রোধ, যাত্রীদের নিরাপত্তা, অতিরিক্ত যাত্রী বহন প্রতিরোধ করার দায়িত্বও এই সংস্থার। আর লঞ্চের নকশা অনুমোদন, নিবন্ধন এবং এর ফিটনেস ছাড় দেওয়ার দায়িত্ব সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের। দুটি সংস্থাই নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীন দুটি বিভাগ।
নৌ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মাওয়া-কাওড়াকান্দি পথে চলাচলকারী ৮৬টি লঞ্চের অন্তত ৩৩টি অধিক পুরোনো ও ফিটনেস সনদ পাওয়ার যোগ্যতা নেই। পিনাক-৬ লঞ্চটিও এই ৩৩টির একটি। অভিযোগ রয়েছে, ডুবে যাওয়ার দেড় মাস আগে পিনাক-৬-এর অনুমোদন বাতিল করা হয়েছিল। ৮৫ জন যাত্রী বহনের অনুমোদন ছিল এই লঞ্চটির। কিন্তু তা মানা হয়নি। ফলে বিআইডব্লিউটিএ এবং সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ উঠেছে।
মালিকদের চাপে সরকারের পিছু হটার কথা স্বীকার করলেও দায়িত্ব পালনে স্বার্থের সংঘাতের কথা অস্বীকার করেন নৌমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মালিকেরা শক্তিশালী। ৩৩টি লঞ্চের চলাচল বন্ধ করতে গেলে তারা ধর্মঘট করে। এরপর আমি পিছু হটেছি। তবে সময় দেন। একদিন সফল হব।’
নিজেকে শতকরা ৭০ ভাগ সফল দাবি করে শাজাহান খান বলেন, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বছরে সর্বোচ্চ ৩১টি থেকে সর্বনিম্ন ২০টি পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটেছিল। লঞ্চ উদ্ধারেও ওই সরকার ব্যর্থ হয়েছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বছরে সর্বোচ্চ ১৬টি থেকে সর্বনিম্ন পাঁচটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। পিনাক-৬ লঞ্চও উদ্ধার করতে পারবে তারা।
তবে গত শুক্রবার মন্ত্রীর পরিবারের মালিকানাধীন এমভি ঐশীকেও ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং দুই মাসের জন্য চলাচলের অনুমতি বাতিল করেছে বিআইডব্লিউটিএ। নৌমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পরিবারের মালিকানাধীন লঞ্চটি ওই পথের সবচেয়ে বড় ও মানসম্মত লঞ্চ। জরিমানা করা হয়েছে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না থাকার দায়ে।’
শ্রমিক-মালিকের দ্বৈত ভূমিকার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই পরিবহন খাতে শাজাহান খানের একচ্ছত্র আধিপত্য। নৌমন্ত্রী হওয়ার সুবাদে এবং মাদারীপুর সদর আসনের সাংসদ হিসেবে মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌ ও সড়কপথেও তাঁর একক কর্তৃত্ব আছে বলে পরিবহন ও লঞ্চমালিকেরা জানিয়েছেন।
ওই পথে চলাচলকারী একাধিক পরিবহনমালিক অভিযোগ করেন, কাওড়াকান্দি ঘাটে প্রতিটি পরিবহনের প্রতি যাত্রায় ৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। ঈদের সময় চাঁদার হার বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হয়। এ ছাড়া খুলনা, বাগেরহাটসহ দক্ষিণের বিভিন্ন জেলা থেকে কাওড়াকান্দি পর্যন্ত চলাচলকারী বাস, মাইক্রোবাস চলে৷ সেগুলোকে আরও বেশি চাঁদা গুনতে হয়।
পরিবহনমালিকেরা জানান, বর্তমানে কাওড়াকান্দি ঘাটে চাঁদা তোলার দায়িত্বে আছেন ফারুক ব্যাপারী, ইসমাইলসহ স্থানীয় কয়েকজন। ইসমাইল স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফারুক ব্যাপারী বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন শ্রমিক লীগ করেন।
জানতে চাইলে ফারুক ব্যাপারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি একা চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করি না। আরও অনেকেই আছেন। তবে যারাই চাঁদা তুলুক না কেন, গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য যে লোকবল নিয়োগ দিতে হয়, তাদের পেছনেই এই টাকা খরচ হয়ে যায়।’
নিজের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে ফারুক ব্যাপারী বলেন, তিনি বিএনপির রাজনীতি ছেড়ে শ্রমিক লীগে যোগ দিয়েছেন। এখন স্থানীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি। শাজাহান খানের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তাঁকে চাঁদার টাকা দেন কি না—জানতে চাইলে ফারুক ব্যাপারী বলেন, ‘২০ টাকা চলে যায় শ্রমিক সংগঠনের নামে। আর বাকি টাকা ব্যয় হয় তদারকির কাজে।’
পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের স্থানীয় সূত্র জানায়, মাওয়া প্রান্তে দিনে চাঁদা আদায় না হলেও রাতে প্রতিটি গাড়ি থেকে স্থানীয় যুবলীগ ৩০ টাকা করে চাঁদা আদায় করে।
এই চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাঁদাবাজি হয় জানি। তবে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই। যতটুকু পারি, নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। কারা চাঁদাবাজিতে জড়িত, তাদের আপনারা খুঁজে বের করেন।’
সড়ক, রেল ও নৌপথে যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নৌ মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর লঞ্চমালিকদের কবজায় চলে গেছে। গত বছর বিআইডব্লিউটিএর বৈঠকে নৌ-নিরাপত্তা ও যাত্রী অধিকার নিয়ে বক্তব্য দেওয়ায় তাঁকে গত ঈদুল ফিতরের আগে অনুষ্ঠিত এ-সংক্রান্ত বৈঠকে ডাকাই হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.