‘শাহবাগ আন্দোলন বিভাজনে সরকারের ভূমিকা ছিল’ -আনিসুজ্জামান

যুদ্ধাপরাধের বিচারে সরকারের তরফে গতি আনার জন্য তেমন কোনও প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতি সত্যই অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। তার মতে, আসলে এই যুদ্ধাপরাধের বিচার অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। শেষ অবধি কাজটা শুরু হলো বটে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধের মামলাগুলোর বিচার চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এই ধরনের মামলার আপিলের নিষ্পত্তি হচ্ছে আরও ধীরে। এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর মতো রাজনৈতিক দলের কোন আঁতাত হয়েছে, এমন কথা বলব না। অথচ এটা রূঢ় বাস্তব যে, সরকারের তরফে এই মামলাগুলোতে গতি আনার জন্য তেমন কোন প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার বুধবারের সংস্করণের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় আনিসুজ্জামানের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। ওই সাক্ষাৎকারে আনিসুজ্জামান শাহবাগ আন্দোলনের পরিণতি নিয়ে যেমন তার স্পষ্ট মত জানিয়েছেন তেমনি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খোলামেলা তার মত জানিয়েছেন। শাহবাগ আন্দোলনের পরিণতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান জানিয়েছেন, শাহবাগ আন্দোলন ভাঙার পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। নিজেদের মধ্যে বিরোধ যেমন তৈরি হচ্ছিল, তেমনই আন্দোলন বিভাজন সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারও কিন্তু নির্দিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিল। সে যা-ই হোক, মোদ্দা কথা হলো, এই স্বপ্ন দেখানো আন্দোলন শেষ অবধি ভেঙে গেল। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই ধরনের ঐক্য আর কখনও নজরে আসেনি। কাজেই, শেষ পর্যন্ত শাহবাগ আন্দোলনের এই পরিণতি বাংলাদেশের পক্ষে অত্যন্ত দুঃখজনক এবং হতাশাব্যঞ্জক বলে জানিযেছেন আনিসুজ্জামান। তার মতে, গণজাগরণ মঞ্চ একসময় উদ্দীপনামূলক ছিল, এখন শুধুই দৈনন্দিনতা। তবে শাহবাগ আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন, শাহবাগ নিঃসন্দেহে মেয়েদের অগ্রগতির চিহ্ন। সাধারণ মানুষ তো এগিয়েছে। শাহবাগের জমায়েতে যাবে শুনলে রিকশাচালকও সওয়ারির কাছ থেকে ভাড়া নিতে চাননি। বিনা পয়সায় গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন! কিন্তু এই পরিস্থিতি, এই ঐক্য ধরে রাখা গেল না। তবে, শাহবাগ আন্দোলন মেয়েদের সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন সূচিত করে না। আন্দোলনের তো এক সময়ে সমাপ্তি হয়। আরও আগে সমাপ্তি হলে হয়তো এতটা অনৈক্য দেখা দিতো না। আবার এই আন্দোলন আরও এগোলেও হয়তো তা ইতিবাচক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে শেষ হতে পারত। বাংলাদেশের নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এই সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কিছুটা হলেও বেড়েছে। বিগত মাস ছয়েক ধরে সরকার নিজের অবস্থা অনেক শক্তিশালী করেছে। কিন্তু পাশাপাশি দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে। শাসক দলের অনেক সাংসদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এতে সরকার এবং শাসক দলের দুর্নামও বেড়েছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, পশ্চিমা দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো নির্বাচনের পরেও বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এতে বাংলাদেশের সরকার শক্তিশালীই হয়েছে। মনে রাখা দরকার, আমেরিকা ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নই সেই সময়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বৈধতা নিয়ে বিশেষভাবে প্রশ্ন তুলেছিল। আবার এই ইইউ-এর তরফেই কিন্তু বাংলাদেশকে বর্ধিত আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা করা হয়েছে। সেটা বাংলাদেশের এখনকার স্থিতিশীলতা দেখে কিনা, তা অজানা। সামগ্রিক বিচারে এই সরকারের আইনগত ভিত্তি নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। তবে নৈতিকতার প্রশ্ন থেকেই গেছে বলে মনে করেন আনিসুজ্জামান। তিনি স্বীকার করেন যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশে এখনও বিতর্ক আছে। ২০০৭ সালে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে দেশের প্রধান দুই দলের যে ধরনের মনোভাব ছিল, ইদানীংকালে তা দেখা যায়নি। বিতর্ক এতে বেড়েছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া আরও সংকটের মধ্যে পড়েছে। সঙ্গে দেশও। উপরন্তু, সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন নিজস্ব শক্তি ও সামর্থ্য দেখাতে পারেনি। এই প্রেক্ষিতে বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে আনিসুজ্জামান বলেছেন, বিরোধীদের আন্দোলনও এখন স্তিমিত। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) কার্যত নিষ্ক্রিয়। ভোটের ঠিক আগে, গত বছরে নভেম্বর-ডিসেম্বরে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের প্রভাব জনজীবনে পড়েছিল। বিরোধীদের আন্দোলনে জনগণের যোগ না থাকলেও দৈনন্দিন বিপর্যয় হতে পারে। যেমনটা তখন হয়েছিল। এখন তা নেই। আনিসুজ্জামান আরও জানিয়েছেন, আগে যখন জামায়াত আন্দোলনের পথে পা বাড়িয়েছিল, বিএনপি তখন জামায়তের পাশে দাঁড়ায়নি। এখন বিএনপি নতুন করে আন্দোলনের কথা ভাবলেও তাতে জামায়াতের সাড়া মিলছে না। অন্যদিকে, বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছেই। দলের নেতাদেরও জনসাধারণের কাছে তেমন স্বীকৃতি নেই। তাই সরকারের বর্তমান মেয়াদ পূরণের পথে আপাতত কোন বাধা নেই বলে মনে করেন আনিসুজ্জামান। আর তাই তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বাইরের জগতের উৎসাহও এখন কম। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কেও রাজনীতি সম্পর্কে প্রবীণ এই অধ্যাপক জানিয়েছেন, আওয়ামী লিগ সরকার ২০০৮-এ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বরাবরই তার কাজের মাধ্যমে দিল্লিকে বোঝাতে চেয়েছে যে, তারা কোনভাবেই ভারত-বিরোধিতাকে সমর্থন করে না। সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতার প্রশ্নেও দুই দেশের মধ্যে মিল দেখা গেছে। অথচ, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন বাংলাদেশ গেলেন, বিএনপি নেত্রী তার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করলেন না। এতে ভারতের তরফে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন আরও বেড়েছে। তবে ভারত সম্পর্কে যে অভিযোগটা বাংলাদেশে শোনা যায় সে সম্পর্কে আনিসুজ্জামান বলেন, মূল অভিযোগ এটাই যে দুই দেশের সম্পর্ক কার্যত একতরফা। বাংলাদেশ বহুভাবে ভারতকে সাহায্য করলেও ঢাকার কোন প্রত্যাশাই দিল্লি পূরণ করছে না। এবং আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে কিছু করছে না। এতে বাংলাদেশের সরকারের সংকট বাড়বে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের পক্ষেও এটা ভাল হবে না বলে স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন তিনি। তবে বিএনপি  সম্পর্কে ভারতের নতুন সরকারের মনোভাবকে তিনি সদর্থক বলে জানিয়েও বলেছেন, বিএনপির ধারাবাহিক ভারত-বিরোধিতা দুই দেশের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট রাখতে দেবে কিনা, সেটাই প্রশ্ন।

No comments

Powered by Blogger.