হেমিংওয়ের বাড়ি by শাহাবুদ্দীন নাগরী

১৮ জুন, ২০১৩।
আমরা যখন কী-ওয়েস্টে পৌঁছুই তখন মধ্যদুপুর। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণপূর্বের সর্বশেষ প্রান্তসীমা কী-ওয়েস্ট, ফ্লোরিডা রাজ্যের মনরো কাউন্টির বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র। মায়ামি থেকে আমরা রওনা দিয়েছিলাম সকাল সাড়ে ন’টায়। প্রায় ১৬০ মাইল পথ পেরিয়ে আমাদের পৌঁছুতে সময় লেগে গেল ৪ ঘণ্টা। যাওয়ার পথের সরু যে ভূখণ্ডটি ফ্লোরিডা রাজ্য থেকে বেরিয়ে ঢুকে গেছে সমুদ্রের মধ্যে, তার একপাশে মেক্সিকো উপসাগর, অন্যপাশে আটলান্টিক মহাসাগর। কী ওয়েস্টে দাঁড়ালে কিউবা দেখা যায়, মাইলের হিসেবে ৯০ মাইল পেরুতে হবে আটলান্টিক।
কী-ওয়েস্টের বিশাল শহরটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান, অন্তত আমার কাছে, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র (১৮৯৯-১৯৬১) বাড়ি ও জাদুঘর। ৯০৭ হোয়াইটহেড স্ট্রিটের বাড়িটিতে হেমিংওয়ে তার জীবনের নয়টি বছর (১৯৩১-৩৯) কাটিয়েছিলেন। চমৎকার দোতলা বাড়ি, পেছনে সুন্দর একটি সুইমিংপুল। ১৮৫১ সালে নির্মিত এ বাড়িটি হেমিংওয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী পলিন ফেইফার ১৯৩০ সালের শেষদিকে চাচার কাছ থেকে উপহার পাওয়ার পর ২০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করে এই সুইমিংপুলটি নির্মাণ করেছিলেন, যার নীল জল এখনও পর্যটকদের চোখ আটকে রাখে। এই বাড়িতে এখনও আছে হেমিংওয়ের পোষা সেই বিড়ালগুলো, যাদের থাবায় রয়েছে পাঁচটির পরিবর্তে ছয়/সাত আঙুল। হেমিংওয়ের দ্বিতীয় পুত্র প্যাট্রিক ১৯৯৪ সালে মায়ামি হেরাল্ড-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কী-ওয়েস্টের এই বাড়িতে তার বাবা ময়ূর পুষতেন, বিড়াল পুষতেন কিউবাতে, যদিও হেমিংওয়ের চতুর্থ স্ত্রী মেরি এই বক্তব্যকে খণ্ডন করে বলেছেন, বিড়ালগুলো এই বাড়িরই এবং কেউ তা বিক্রয় করেনি, বরঞ্চ বছর বছর প্রজননের মাধ্যমে এর বংশবিস্তার অব্যাহত আছে।

বিংশ শতাব্দীর ইংরেজি কথাসাহিত্যে একটি ব্যতিক্রমী নাম আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। তার ভূমিকার জন্য পরবর্তী প্রজন্মর ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছিলেন মার্কিন এই লেখক ও সাংবাদিক। তার রোমাঞ্চকর জীবনধারণ এবং জনসমক্ষে প্রচারিত প্রতিচ্ছবি বিশ শতকীয় তরুণদের আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়েছিল। তিনি তার জীবদ্দশায় মাত্র নয়টি উপন্যাস এবং ছয়টি ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। এছাড়াও, অন্যান্য বিষয়ের বই ছিল মাত্র দুটি। এত অল্প লিখেও সাহিত্যে বিশাল ভূমিকা রাখার বিষয়টি অনেকের কাছেই বিস্ময়কর ছিল সে সময়ে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখার সময়কাল মোটামুটিভাবে ১৯২৫ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত। এ সময়ে বিচিত্র জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তার। কর্মজীবন পরিবর্তন করেছেন সময়ে সময়ে, জীবনসঙ্গীও পরিবর্তিত হয়েছে তার জীবনধারায়। তার মৃত্যুর পর তিনটি উপন্যাস, বহু ছোটগল্পের সংকলন এবং অনেক মননশীল লেখার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, যা তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত গ্রন্থের চেয়েও অধিক। মার্কিন সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রতিটি রচনাই ক্লাসিক হিসেবে খ্যাত হয়ে আছে। অনেকে বলে থাকেন, প্যারিসে বসবাসকালীন সময়ে যেসব লেখা হেমিংওয়ে লিখেছিলেন, সেসব লেখাই তাকে অধিক পরিচিতি দিয়েছে ও খ্যাতিমান করেছে।
১৯২০ সালের প্রেক্ষাপটে হেমিংওয়ে রচনা করেছিলেন ‘দি মুভেবল ফিস্ট’, তার প্যারিস জীবনের কথাকাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে উপন্যাসটি। একে উপন্যাস না বলে আত্মজৈবনিক রচনা বলাই শ্রেয়। এটি তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। ১৯৬৪ সালে, তার মৃত্যুর তিন বছর পর, যে সংস্করণটি প্রকাশিত হয় তাও পূর্ণাঙ্গ ছিল না। আড়ালে লুকোনো ছিল এর আরেকটি পাণ্ডুলিপি, যা ২০০৯ সালে প্রকাশিত হলে বিশ্বসাহিত্যে তুমুল আলোড়ন হয়। একটি ক্লাসিক রচনার পুনর্লিখন! তাও আবার হেমিংওয়ের হাতেই! ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত সংস্করণের সঙ্গে যোগ করা
হয় আরও নয়টি অনুচ্ছেদ এবং সংযুক্ত হয় নতুনভাবে লিখিত সমাপ্তি।
এক বিস্ময়কর জীবনযাপন হেমিংওয়ের। তার স্ত্রী ছিলেন চারজন, যারা তার জীবনের একেক সময়ে প্রবেশ করেছেন এলিজাবেথ রিচার্ডসন (১৯২১-২৭), পলিন ফেইফার (১৯২৭-৪০), মার্থা গেলহর্ন (১৯৪০-৪৫) এবং তার মৃত্যু পর্যন্ত মেরি ওয়েলস (১৯৬৪-৬১)। তিন সন্তান জ্যাক, প্যাট্রিক এবং গ্রেগরি- বেঁচে আছেন শুধু প্যাট্রিক, যিনি ‘দি মুভেবল ফিস্ট’-এর নবতর সংস্করণের ভূমিকা লিখেছেন। এলিজাবেথ এবং পলিন ছিলেন দুই বান্ধবী, হেমিংওয়ে এলিজাবেথকে ত্যাগ করে বিয়ে করেন স্ত্রীর বান্ধবী পলিনকে, যেই পলিন কী-ওয়েস্টে রেখে যাওয়া হেমিংওয়ের বাড়ির ক্রেতা এবং এই বাড়িতে থাকার পুরোটা সময় হেমিংওয়ের সঙ্গেই ছিলেন।
১৮৯৯ সালে ইলিনয়েসে জন্ম হয়েছিল হেমিংওয়ের, ১৯৬১ সালে নিজের শটগানের গুলিতে আÍহত্যা করেছিলেন আইদহ’তে। কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিডেল ক্যাস্ট্রো তার বন্ধু ছিলেন, তার সাংবাদিকতা জীবনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, স্পেনের গৃহযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ গভীর ছায়াপাত করেছিল, তিনি বুর্জোয়া ধনতান্ত্রিক রীতির চেয়ে পছন্দ করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে। এ কারণেই জীবনের শেষদিকে এসে তিনি তার অর্থ এবং নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েছিলেন, তার ধারণা হয়েছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তাকে ক্রমাগত অনুসরণ করে চলেছে।
১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘দি টরেন্টস অব স্প্রিং’ এবং জীবদ্দশায় তার সর্বশেষ প্রকাশিত উপন্যাস ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ (১৯৫২)। এছাড়া, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। জীবনের বিভীষিকাময় এবং অসম্ভব মানসিক বিপর্যয়ের কালে যখন তার লেখক বন্ধুরা একে একে মৃত্যুবরণ করতে থাকেন, ১৯৩৯ সালে ইয়েটস এবং ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড, ১৯৪০ সালে স্কট ফিটজিরাল্ড, ১৯৪১ সালে শেরউড অ্যান্ডারসন ও জেমস জয়েস, ১৯৪৬ সালে গ্রার্ট্রুড স্টেইন এবং ১৯৪৭ সালে দীর্ঘদিনের বন্ধু ম্যাক্স পার্কিনস, তখন হেমিংওয়ে গভীর বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এই সময়ে তার প্রচণ্ড মাথাব্যথা, উচ্চরক্তচাপ, ওজনজনিত সমস্যা দেখা দেয় এবং এর পরিণতিতে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন।
জীবনে বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন হেমিংওয়ে। স্কুলপড়া শেষ করে তিনি কয়েক মাস ‘দি কানসাস সিটি স্টার’ পত্রিকায় রিপোর্টিংয়ের কাজ করেন এবং এরপর রেডক্রসের মনোনয়ন নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইটালি ফ্রন্টে যোগদান করেন (১৮১৮)। এখানে তিনি প্রথম আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং যুদ্ধ বাদ দিয়ে ফিরে আসেন বাড়িতে। এই দুর্ঘটনায় তিনি মিলানের রেডক্রস হাসপাতালে ছয় মাস শয্যাশায়ী ছিলেন। ১৯২৮ সালে প্যারিসে বসবাসকালীন সময়ে হেমিংওয়ে বাথরুমে ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। তিনি কমোডের চেইন ভেবে জানালা ধরে মাথার ওপর টান দিয়েছিলেন, যা ভেঙে পড়েছিল মাথার ওপর। কপালের ওপর ক্ষতটি আমৃত্যু চিহ্ন হয়েছিল তার, এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যেতেন। প্যারিস ত্যাগের সময় আর বড় শহরে বাস করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। ১৯৩৩ সালের দিকে হেমিংওয়ে সপরিবারে পূর্ব আফ্রিকার কয়েকটি সাফারি ভ্রমণ করেন। মোমবাসা, নাইরোবি, ম্যাকাকোস, তাঙ্গানিকা, লেক মনিয়ারা এবং তারাঙ্গির ন্যাশনাল পার্ক পরিদর্শন করেন। এ সময়ও তিনি দুর্ঘটনায় পড়েন, তার অ্যামিবা ঘটিত আমাশয় হয়, যা তার আন্ত্রিক স্থানচ্যুতি ঘটায় এবং তাকে বিমানে করে নাইরোবিতে স্থানান্তর করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই অভিজ্ঞতা তার ‘দি øোজ অব কিলিমানজারো’ গ্রন্থে প্রতিফলিত হয়েছে। এরপর হেমিংওয়ে যে দুর্ঘটনাটির শিকার হন তা ঘটে ১৯৪৫ সালে। তার গাড়িটি দুর্ঘটনায় পতিত হলে তার হাঁটু ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় এবং কপালে মারাÍকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। ক্রমে ক্রমে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং নানা বিষাদ তাকে গ্রাস করে ফেলে।
এর ভেতরেই ১৯৫১ সালে মাত্র আট সপ্তাহে তিনি লিখে ফেলেন তার ক্লাসিক উপন্যাস ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ এবং লেখা শেষ করে বন্ধুদের বলেছিলেন, সারাজীবনে এটিই আমার শ্রেষ্ঠতম লেখা। এই গ্রন্থটির জন্য তিনি ১৯৫২ সালে লাভ করেন পুলিৎজার পুরস্কার। বইটি মাসের পর মাস সেরা গ্রন্থের তালিকায় শ্রেষ্ঠ স্থান দখল করে রেখেছিল। ১৯৫৪ সালে পরপর দুটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন হেমিংওয়ে, প্রথমটিতে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান তিনি, দ্বিতীয়টিতে তার মগজ থেকে তরল পদার্থ নির্গত হতে থাকে। এ দুটি দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে উড়োখবর প্রচারিত হলেও শেষপর্যন্ত বেঁচে যান তিনি। পরবর্তীতে শারীরিক নানা সমস্যায় জড়িয়ে গেলে মদ্যপান বাড়িয়ে দেন, যা তাকে ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যায়। এসবের মধ্যেই ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে হেমিংওয়ে লাভ করেন নোবেল পুরস্কার। শারীরিক দুরবস্থা এবং বিমানভ্রমণ আতংকে তিনি স্টকহোমে তার নোবেল পুরস্কার সশরীরে উপস্থিত থেকে গ্রহণ করতে পারেননি। এটাও হেমিংওয়ের জীবনে একটা ট্র্যাজেডি হিসেবেই থাকবে।
হেমিংওয়ের সব লেখালেখির মূল চালিকাশক্তি ছিল প্রেম, যুদ্ধ, বন্যতা এবং হারানো। একদা মার্কিন সাহিত্য এসবের ওপর ভর দিয়ে অনেকটা চলেছিল, কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে, কিন্তু যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া রোমান্টিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র ভেতর সবকিছু যেন একসঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়ায়। হয়তো এ কারণেই মার্কিন সাহিত্যের এই ধারাটির প্রতি পরবর্তী প্রজন্মর আগ্রহ বেড়ে যায়, সমসাময়িক সাহিত্যিকরা থমকে দাঁড়ায় এই বিষয় এবং ভাষার ক্ষিপ্রতা দেখে। হেমিংওয়ের ভাষায় ছিল নতুনত্ব, তার সাহিত্য ও ব্যক্তিগত রচনায় তিনি ‘কমা’র পরিবর্তে ‘অ্যান্ড’ শব্দটি ব্যবহার করতেন, এতে পরবর্তী বাক্যটির অনিবার্যতা নিশ্চিত হয়ে যেত। চরিত্রের ইমেজ তৈরিতে তিনি গ্রহণ করেছিলেন নিজস্ব রীতি। একটি ‘রিয়াল থিং’ সৃষ্টিতে তিনি অনেক চরিত্রের কোলাজ আঁকতেন তার ভাষা দিয়ে, যা ক্রমে পৌঁছে যেত তার গন্তব্যে। এজরা পাউন্ড (১৮৮৫-১৯৭২), টিএস এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫), জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১) প্রমুখের রচনায় এই ইমেজের একটা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত চরিত্র খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি, তার গবেষকদের মতে, যে কোনো বই অন্তত দু’বার পড়তেন হেমিংওয়ে, খুঁজতেন সেসব বইয়ের ভেতর লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যের লালিমা।
খুব যতœ করে সাজানো হেমিংওয়ের কী-ওয়েস্টের বাড়িটি। কয়েকধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই নিচতলার ডান দিকে তার লিভিং রুম, বাম দিকে ডাইনিং রুম। হেমিংওয়ে যখন ১৯৩১ সালে এই বাড়িটিতে ওঠেন তখন এটির অবস্থা ছিল ভঙ্গুর। দ্বিতীয় স্ত্রী পলিন প্রথমেই প্রতিটি ঘরের ছাদ থেকে ফ্যানগুলো অপসারণ করেন এবং সেখানে মোমদানি স্থাপন করেন। লিভিং রুমের ভেতর ক্রিস্টালের দু’টো বিড়ালের মূর্তি ছিল, হেমিংওয়ে বিড়াল খুব পছন্দ করতেন বলে পলিন ওই দু’টো বিড়াল হেমিংওয়েকে উপহার দেন তার জন্মদিনে। বিড়াল ছিল হেমিংওয়ের প্রিয় প্রাণী, ৩০ বছরে সেখানে ৬০টি বিড়াল বড় হয়ে ওঠে। এখনও বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় বিড়ালগুলোকে। দোতলায় শোবার ঘরে শাদা ধবধবে বিছানায়, যে বিছানায় হেমিংওয়ে ঘুমোতেন, আমরা দেখলাম একটি বিড়াল শুয়ে আছে। তার লেখার টেবিলে শুয়ে আছে আরেকটি বিড়াল। এই ছয়-সাত আঙুলের বিড়ালগুলো এখনও বংশবিস্তার করে চলেছে এবং কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা ঝুলছে দেয়ালে, বিড়ালগুলোকে বিরক্ত না করার জন্য। তার চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চি পলিশ করে সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং প্রতিটি আইটেমের ওপর ট্যাগ বসানো আছে তাতে না বসার জন্য।
ডাইনিং রুমের দেয়ালে অনেক ছবি দেখা গেল। এগুলো সবই হেমিংওয়ের জীবনের ছবি। ওক-পার্কে তোলা তার ছোটবেলার ছবি থেকে শুরু করে জীবনের বিভিন্ন সময়ের ছবি দেয়ালে আটকানো। তার প্রথম স্ত্রী এলিজাবেথ রিচার্ডসনের ছবি উপরে বাঁ দিকে, তার ডান দিকে দ্বিতীয় স্ত্রী পলিন ফেইফারের ফটোফ্রেম এবং সর্বডানে তাদের দুই পুত্র গ্রেগরি এবং প্যাট্রিকের ছবি। নিচে বাঁ দিকে তার তৃতীয় স্ত্রী মার্থা গেলহর্নের ছবি, আর তার ডানেই চতুর্থ স্ত্রী মেরি ওয়েলস’-এর ছবি। এই ঘরটির সঙ্গেই সংযুক্ত তাদের রান্নাঘর, যেটির নাম ছিল ‘দ্য কুকহাউস’। মাছ কাটাকুটার পর হেমিংওয়ে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে এর বর্জ্য অংশগুলো ছুঁড়ে ফেলতেন খোলা জায়গায় তার পোষা বিড়ালগুলোর জন্য। লিভিং রুমে এখন সাজানো আছে হেমিংওয়েকে নিয়ে লেখা বই, তার ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ চলচ্চিত্রের বিশালাকার পোস্টারসহ নানা জিনিসপত্র, যা ধারণ করে আছে এই মহৎ কথাশিল্পীকে।
বাড়ির পেছন দিকটায় গড়ে তোলা হয়েছে একটি স্যুভেনির শপ। এখানে হেমিংওয়েকে নিয়ে তৈরি টি-শার্ট, মগ, চাবির রিং, বাড়ির রেপ্লিকা থেকে শুরু করে তার রচিত বইগুলোর কপি পাওয়া যায়। এই বাড়িটি এখন প্রধানত জাদুঘর, যদিও কোথাও সেটি লেখা নেই, যেমন লেখা নেই শিলাইদহ বা পতিসরে আমাদের রবীন্দ্রনাথের বাড়িগুলোতে। প্রধান গেটে যে সাইনবোর্ডটি দেখলাম তাতেও লেখা ‘আর্নেস্ট হেমিংওয়ে হোম’। ১৩ ডলারের টিকিট কেটে ঢুকতে হয় এই বাড়িটিতে। মিজ জ্যাকি স্যান্ডস এই হোমের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমি ঢাকা থেকে অনুবাদক-কথাসাহিত্যিক ফখরুজ্জামান চৌধুরীর ‘দূরাগত ধ্বনি’ (সূচিপত্র, ২০১০) বইটির একটি কপি নিয়ে গিয়েছিলাম, যে বইয়ের একটি অংশে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সম্পর্কে একটি ছোট নিবন্ধ আছে। আমি বইটি হেমিংওয়ে হোমকে উপহার দেয়ার জন্য মিজ জ্যাকি স্যান্ড্স’-এর হাতে তুলে দিই। তিনি পরম আগ্রহভরে বইটি নিয়ে জানান, এটি যত্নসহকারে এখানে প্রদর্শন করা হবে (বই হস্তান্তরের ছবিটিসহ)। আমার বন্ধুর ক্যামেরায় তখন আমি বন্দি হয়ে চলেছি। বাড়িটি ঘুরে দেখে যখন বাইরে বেরিয়ে এলাম তখন এক অদ্ভূত অনুভূতি মনের ভেতর দোলা দিতে শুরু করল। মাথার ওপর সূর্যটা জানান দিয়ে গেল এটা কী-ওয়েস্ট, এখানেই হেমিংওয়ের বাড়ি। আটলান্টিকের ওপর দিয়ে উড়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্শে আমি কিছুক্ষণের জন্য বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম হোয়াইটহেড স্ট্রিটের ওপর। আর কখনও কি আসা হবে এই বাড়িটিতে?
e-mail: snagari55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.