প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে প্রাপ্তি কী by মিজানুর রহমান খান

জাপানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ব্যাঘ্র কূটনীতি’ সফল বলা যেতে পারে৷ কিন্তু তাকে ‘অত্যন্ত সফল’ আখ্যা দেওয়া চলে না৷ টোকিও ‘পরীক্ষিত বন্ধুত্বের’ ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে৷ গত ৩১ মে সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং ২৬ মে টোকিওতে স্বাক্ষরিত যৌথ বিবৃতির মধ্যে বিস্তর রকমফের দেখতে পাই৷
বাংলাদেশকে জাপানের ৬০০ বিলিয়ন ইয়েন সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতিকে ‘এবারের সফরের সবচেয়ে বড় সফলতা’ হিসেবে দাবি করা হয়েছে৷ টোকিও থেকে পাঠানো বাসসের সংবাদ এবং প্রধানমন্ত্রীর লিখিত ভাষণে সতর্কতার সঙ্গে ৬০০ বিলিয়ন ইয়েনকে ‘সহায়তা’ বলা হয়েছে৷ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারকে৷ অথচ ৬০০ বিলিয়ন ইয়েন প্রধানত ঋণ৷ অবশ্য এটা কৃতিত্ব এই অর্থে যে ৩৫ বছরে (১৯৭২-২০০৬) বাংলাদেশ যেখানে ইয়েন ঋণ পেয়েছে ৬০০ বিলিয়নের কিছু কম, সেখানে এবারের এক সফরেই প্রতিশ্রুতি মিলেছে সমপরিমাণের ঋণ৷ এই ঋণ-অঙ্গীকারকে যেভাবে একান্ত দ্বিপক্ষীয় বাতাবরণে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাতে পুরো সত্য প্রকাশ পায় না৷ কারণ, এই ৬০০ বিলিয়ন ইয়েন প্রসঙ্গটি প্রধানত রিজিওনাল কানেকটিভিটির মতো ‘ব্যাপকতর আঞ্চলিক উন্নয়নের’ পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছে৷ তাই মনে হচ্ছে, জাপান এই সহায়তা ঘোষণা কেবল ঢাকার দিকেই তাকিয়ে নয়, এই অঞ্চলের অন্যান্য রাজধানীর দিকেও নজর রেখে করে থাকতে পারে৷ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী আসনে জাপানের সফল প্রার্থী হতে চাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তো আছেই৷
আমাদের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার হয়েও বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ কম৷ তবে অাওয়ামী লীগ সরকারের তুলনামূলক সাফল্য বিরাট৷ গত ৫ বছরে জাপানে মোট রপ্তানি বেড়েছে আড়াই গুণ, পোশাকে এই হার ২০ গুণ৷ এ রকম রকেটগতিতে বেড়ে রপ্তানির অঙ্কটা এক বিলিয়ন ছুঁয়েছে৷ জাপানি কোম্পানির সংখ্যা গত পাঁচ বছরে আড়াই গুণ বেড়ে তবে ১৭৬ হয়েছে৷ এখন যাঁরা বিএনপির সঙ্গে তুলনা করবেন, তাঁরা সুখানুভূতি পাবেন৷ কিন্তু সীমান্তের বাইরে তাকালে আত্মজিজ্ঞাসার মুখে পড়বেন৷

কারণ, ২০১২ সালে বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ যখন দেড় বিলিয়ন ডলারেও পৌঁছায়নি, তখন ওই বছরটিতে আমাদের মতোই চিতাভস্ম থেকে ফুঁড়ে ওঠা ভিয়েতনামে জাপানি বিনিয়োগ ৩১৭টি প্রকল্প নিয়ে চার বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে৷ বাংলাদেশ এই প্রথম পাঁচ বছর ধরে খরচের শর্তে অনধিক ছয় বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পেল৷ অার ভিয়েতনাম ইিতমধ্যে প্রায় দুই দশক ধরে বছরে এক বিলিয়ন ডলার জাপানি ঋণ ব্যবহারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে৷ বাংলাদেশি নেতা যখন ২০১৪ সালে এসে সংবাদ সম্মেলনে বড় মুখ নিয়ে (সেটা যথার্থ কারণ পাঁচ বছর আগে ছিল ২০০ মিলিয়ন) এক বিলিয়ন ডলার রপ্তানির তথ্য দেন, তখন জাপানে ভিয়েত-রপ্তানি তিন বছর আগেই সাত বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার নজির সৃষ্টি হয়েছে৷
বিদেশে জাপানের চেয়ে বাংলাদেশি পণ্যের আরও ১০টি বড় বাজার আছে৷ বিদেশি বিনিয়োগে জাপানের স্থান আটে৷ তবে রপ্তানির ৯০ ভাগই জুড়ে আছে মাত্র সাত-আটটি পণ্য৷ সুশাসনের ঘাটতি ও শাসনগত অদক্ষতাই এ ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী৷ ঢাকা-টোকিও সম্পর্ক নিরঙ্কুশভাবে রয়ে গেছে সাহায্য ও অনুদাননির্ভর৷ যে সম্পর্ক কোনো এক পক্ষের বদান্যতানির্ভর হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে আত্মমর্যাদার বিষয়টি ধরে রাখা কঠিন৷ বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের বাণিজ্য ঘাটতি ৬৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ টোকিও তার বিশ্ব বাণিজ্যের মাত্র দশমিক ১ শতাংশ করে ঢাকার সঙ্গে৷ তাদের সঙ্গে বাণিজ্য নব্বই দশকে যে পিছু হটা শুরু করল, তা আর অগ্রসর হলো না৷ ঢাকার জাপানি রাষ্ট্রদূত ২০১১ সালের জুলাইয়ে বলেছিলেন, তাঁরা আসিয়ানসহ চীন, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে তাঁদের গামে৴ন্টস কারখানা বাংলাদেশে স্থানান্তর করবেন৷ এই বিষয়ে কোনো অগ্রগতির উল্লেখ দেখি না৷ অথচ এসবই প্রকৃত অর্জন হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা৷
টোকিওতে দুই নেতার যৌথ বিবৃতির সবচেয়ে লক্ষণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে, বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ বৃদ্ধি বা তাদের আগ্রহের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়ে জাপান প্রকারান্তরে বাংলাদেশকেই অভিযুক্ত করেছে৷ এবং তাতে বাংলাদেশ আত্মপক্ষ সমর্থনেরই চেষ্টা করেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে৷ সোজা করে বললে দাঁড়ায়, জাপানের এই দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী নেতা, যিনি ২০০৭ সালেও প্রধানমন্ত্রীর পদে ছিলেন, তিনি কার্যত আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মুখের ওপর বলে দিলেন, বিনিয়োগ তো করতে চাই৷ কিন্তু পরিবেশ তো নেই৷ সেটা আগে ঠিক করুন৷ বাংলাদেশ তরফে উত্তরটা সম্ভবত মুখরক্ষা ধরনের৷
টোকিওর যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ রাজনীতির বর্তমান অচলাবস্থার কথা নেই৷ গত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের কথা নেই৷ এই নেই মানে সেটা কোনো স্বস্তির বিষয় নয়৷ যতদূর বোঝা যাচ্ছে, বিবৃতিতে সেটা অাক্ষরিক অর্থে না থাকলেও আছে৷ কীভাবে আছে, ঢাকার সংবাদ সম্মেলনে তা খোঁজার চেষ্টা ছিল বলে মনে হয় না, বরং ফরমালিনীকরণ গুরুত্ব পেয়েছে৷ ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে কিংবা গাওয়াতে পেরে মিডিয়াকে উৎফুল্ল মনে হয়েছে৷ কারণ, তাদের কপালে চটকদার শিরোনাম জুটেছে৷
বিবৃতির ৯ ও ১২ দফায় জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে যতটা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সর্বাগ্রে ‘বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ’ উন্নয়নে তাগিদ দিয়েছেন, তার চেয়ে পরিষ্কার করে আর রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের কথা বলার তো দরকার পড়ে না৷ জাপানি কূটনীতিকেরা দারুণ কূটনৈতিক দক্ষতা দেখিয়েছেন৷ কারণ, তাঁরা হাসতে হাসতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিয়েছেন যে বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ অনুপস্থিত৷ এই দুটি দফার সঙ্গে গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত শিরো সাদোশিমার বিবৃতির যোগসূত্র অনুধাবন করি৷
জাপান ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন হিসেবে মেনে নেয়নি, বরং তারা এই নিব৴াচনের ফলাফলকে সোজাসাপটা নাকচ করেছে৷ তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জাপান বিশ্বাস করে যে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখন যে যেমন অবস্থানেই থাকুন (এর অর্থ হতে পারে আপনি প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকুন আর আপনি বিরোধী দলের নেতা থাকুন আর না থাকুন), তাঁদের উচিত হবে অবিলম্বে বাংলাদেশের জনগণকে ভোটদানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে গুরুত্বের সঙ্গে উদ্যোগ গ্রহণ করা৷ বাংলাদেশের জনগণ যাতে তাদের রাজনৈতিক পছন্দ এমনভাবে বেছে নিতে পারে, যাতে তাদের ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটে৷’
এখন দেখুন যৌথ বিবৃতিতে দুই প্রধানমন্ত্রী কী বলছেন৷ ৯ দফা বলেছে, ‘অভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে শিনজো আবে ও শেখ হাসিনা বলেন যে, বাংলাদেশে জাপািনসহ বিদেশি িবনিয়োগ অাকৃষ্ট করতে হলে বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন প্রয়োজন৷’ এরপর বিবৃতি যা বলেছে, তাতে ধরে নেওয়া কষ্টকল্পনা নয় যে জাপান পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলকাণ্ড মনে রেখেছে৷ তাই তারা বলেছে, ‘৬০০ বিলিয়ন ইয়েন আগামী ৪ থেকে ৫ বছর মেয়াদে খরচ করা হবে৷ তবে সেটা করতে গিয়ে প্রকল্পগুলোর যথাযথ এবং মসৃণ বাস্তবায়ন সম্পূর্ণরূপে বিবেচনায় নেওয়া হবে৷’ এই কথাটি গত পাঁচ বছরে ক্ষমতাসীন দলের প্রকল্প বাস্তবায়নের রেকর্ডের সঙ্গে মিলিয়ে নিলেই হলো৷ শর্ত পূরণ সাপেক্ষে টাকা ছাড় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকে ঠোঁট আর চায়ের কাপের ব্যবধান বললে কম বলা হবে৷ এ ক্ষেত্রে আমরা ভারতের প্রতিশ্রুত ১ বিলিয়ন ডলার ঋণের বড় অংশ অব্যবহৃত থাকার কথাও স্মরণ করতে পারি৷
প্রধানমন্ত্রী গত শনিবারের বিবৃতিতে ১২ দফার বরাতে জাপানি বিনিয়োগ পেতে আবে যে ‘অবকাঠামো উন্নয়ন ও স্থিতিশীল জ্বালানি সরবরাহের’ শর্ত দিয়েছেন, তা উল্লেখ করেছেন৷ কিন্তু তিনি সেখানে কী বলেছেন, তা বলেননি৷ তিনি বলেছেন, ‘বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের জরুরি প্রয়োজনীয়তা’ তিনি স্বীকার করেন এবং এ জন্য তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন৷ তবে আমরা জানি, সাধারণ জ্বালানি সরবরাহ যেখানে কণ্টকিত, সেখানে ‘স্থিতিশীল সরবরাহ’ প্রায় অসম্ভব৷ সুতরাং, প্রধানমন্ত্রীর মুখে জাপানি ব্যবসায়ীদের উেদ্দশে ‘আমার সরকারের অনুসৃত নীতির’ কারণে বাংলাদেশে ‘জাপানি বিনিয়োগের সম্ভাবনার’ কথা কতটা বাস্তবসন্মত?
তবে সন্দেহ নেই যে ‘উচ্চাভিলাষ’ বলা সত্ত্বেও গঙ্গা ব্যারাজ, যা রূপায়ণে মমতার সহায়তা লাগবেই, যমুনার বুকে আরেকটি রেল, ইস্টার্ন বাইপাস ও ঢাকার চার নদী দূষণমুক্তকরণের মতো প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে জাপানি মিশনের আসন্ন ঢাকা সফরের খবর অসাধারণ প্রাপ্তি৷ তবে জাপানি বার্তাটা ভালোভাবে পাঠ করতে হবে৷ সেটা হলো ঢাকায় জাপানি রাষ্ট্রদূত ৭ জানুয়ারি উল্লিখিত যে বার্তা দিয়েছিলেন, সেটা প্রধানমন্ত্রীর ‘অত্যন্ত সফল’ সফরের কারণে একেবারে নাকচ হয়নি, বরং নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে৷
‘জাপানি অনুদান ও ঋণের সিংহভাগই এসেছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে’—এটা কি তথ্যনির্ভর? তারা তিন ধরনের ‘সহায়তা’ দেয়৷ গ্রান্ট এইড, কারিগরি সহযোগিতা ও ওডিএ৷ এর মধ্যে বিশুদ্ধ ঋণ ওডিএ৷ প্রতিশ্রুত ৬০০ বিলিয়ন এই ওডিএ গোত্রের৷ এটা নিলে ফেরত দিতে হবে৷ ১৯৭২-২০০৬ গ্রান্ট ৪৫৫ বিলিয়ন, কারিগরি ৪৬ বিলিয়ন আর ওডিএ ৫৯৮ বিলিয়ন ইয়েন৷ এটাই বড় সত্য যে ব্যক্তি কিংবা দলের মুখ চেয়ে সম্পর্ক করা টোকিওর নীতি নয়৷ অপশাসনের জন্য বেশি সমালোচিত বিএনপির গত আমলে বাংলাদেশ জাপানি গ্রান্ট লাভে বৃহত্তম গ্রহীতার খেতাব কুড়ায়৷ সেটা কী প্রমাণ করে? ২০০৪ সালে মাত্র ১ দশমিক ৪২১ বিলিয়ন ডলার নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সবে৴াচ্চ ওডিএ গ্রহীতা ছিল পাকিস্তান৷ ১ দশমিক ৪০৪ বিলিয়ন নিয়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয়৷ মাত্র ৬৯১ মিলিয়ন ইয়েন নিয়ে ভারত তৃতীয়৷ আর সেটাই ছিল ভারতের হিম্মত-নির্দেশক৷
‘ঋণং ঘৃতং পিবেৎ’—চূড়ান্ত অর্থে কোনো রাষ্ট্রের বিদেশনীতির সাফল্যের মানদণ্ড হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার নয়৷ তদুপরি এর সার্থক ব্যবহার দেখলে আমরা বর্তে যাব৷
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.