দু’বছর খোঁজ নেই ওদের by জহুরুল ইসলাম

দরজায় কেউ শব্দ করলেই মনে হয় এই বুঝি আমার মোকাদ্দাস এসেছে। কেউ ফোন করলে বড় আশা নিয়ে ফোন ধরি মোকাদ্দাসের খবর শোনার জন্য। কেউ কোথায়ও থেকে এলে মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। ছুটে যাই তার কাছে মোকাদ্দাসের সংবাদ জানার জন্য। কিন্তু আড়াই বছরেও কেউ আমার প্রিয় সন্তানের সংবাদ এনে দিতে পারেনি।’
কথাগুলো বলতে বলতে অঝোরে কাঁদছিলেন আল-মোকাদ্দাসের হতভাগ্য মা আয়েশা সিদ্দিকা। বড় সন্তান নিখোঁজের পর থেকেই শোকে প্রায় উম্মাদ হয়ে পড়েছেন এই মা। পুত্রের সন্ধানে পুলিশ আর র‌্যাবের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চোখ শুকিয়ে ফেলেছেন মোকাদ্দাসের পিতাও। একই অবস্থা নিখোঁজ ওয়ালি উল্লাহর পরিবার। উভয়ের স্বজনরা এখনও চেয়ে আছেন তাদের প্রিয় দু’টি মুখ ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায়। আর কত দিন এভাবে পথ চেয়ে থাকতে হবে তা কেউ জানে না। মোকাদ্দাস ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবি চতুর্থ বর্ষের মেধাবী ছাত্র। দুই বছর পাঁচ মাস আগে র‌্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন তিনি। তার সঙ্গে নিখোঁজ হয়েছেন তারই প্রিয় বন্ধু ওয়ালিউল্লাহ। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারী মাস্টার্সের ছাত্র। ২০১২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা থেকে ব্যক্তিগত কাজ শেষে হানিফ পরিবহনের গাড়িতে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে নবীননগরে চেকপোস্ট বসিয়ে র‌্যাব-৪ পরিচয়ে আল-মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহকে বাস থেকে নামিয়ে নেয়া হয়। প্রকাশ্যে যাত্রীদের সামনে র‌্যাবের পোশাক ও সাদা পোশাকের ১০-১২ জন ব্যক্তি তাদের বাস থেকে নামিয়ে নেয়ার দিন থেকে নিখোঁজ রয়েছেন তারা। তাদের উদ্ধারের দাবিতে ক্যাম্পাসে মাসের পর মাস ধর্মঘট, মানববন্ধন, মিছিলসহ বিভিন্ন আন্দোলন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সরব প্রতিবাদ এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুই মাধাবী ছাত্রকে উদ্ধার করতে পারেনি। এমনকি দুই ছাত্রের স্বজনরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ন্যূনতম সহানুভূতি কিংবা সহায়তাও পাননি বলে অভিযোগ।
ধরে নেয়া হয় যেভাবে: ২০১২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ব্যক্তিগত কাজ শেষে ক্যাম্পাসে ফেরার জন্য আল-মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহ রাত সাড়ে ১১টার হানিফ পরিবহনের বাসের টিকেট কাটেন। ঝিনাইদহ-৩৭৫০ নম্বর গাড়ির সি-১ ও সি-২ সিটে বসে ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার পর রাত সাড়ে ১২টার দিকে বাসটি সাভারের নবীননগর পৌঁছালে র‌্যাব-৪ এর সদস্য পরিচয় দিয়ে গাড়িটি থামানো হয়। এ সময় র‌্যাবের পোশাক ও সাদা পোশাকধারী ১০-১২ জন গাড়িতে উঠে আল-মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে যায় বলে গাড়িতে অবস্থানকারী যাত্রী, সুপার ভাইজার এবং ড্রাইভার নিশ্চিত করেন। এরপর থেকে আটককৃত দুই ছাত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি। র‌্যাব তাদের আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে। আল-মুকাদ্দাস পিরোজপুর জেলার সদর থানার ২ নম্বর কদমতলী ইউনিয়নের খানাকুনিয়ারী গ্রামের মাওলানা আবদুল হালিমের বড় ছেলে। ওয়ালিউল্লাহ ঝালকাঠি জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলার সোলজালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম সোলজালিয়া গ্রমের মাওলানা ফজলুর রহমানের ছেলে। তারা উভয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরের নেতা ছিলেন।
নিখোঁজ দুই ছাত্রের স্বজনরা যা বলেন: ‘মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহকে র‌্যাব পরিচয়ে আটক করার পর আমরা র‌্যাব ৪-এর তৎকালীন সহকারী পরিচালক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও দেখা করতে না পেরে নবীনগর ক্যাম্পে যাই। সেখানে র‌্যাবের লোকজন তাদের আটকের কথা অস্বীকার করে। পরে দারুসসালাম ও আশুলিয়া থানায় পৃথক দু’টি জিডি করি। আশুলিয়া থানা পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। একই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বিচারপতি আবদুল আওয়াল ও বিচারপতি মো. আকরাম হোসাইন চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ তাদের উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি রুল জারি করে। সে বছরের ৭ই মার্চের মধ্যে অপহৃতদের আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হলেও তা আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। র‌্যাবের হাতে আটকের পর নিখোঁজ হওয়া দু‘ছাত্রকে উদ্ধারের দাবিতে ২০১২ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলনে নামে। দফায় দফায় জাতীয় প্রেস ক্লাব ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, ক্যাম্পাসে ছাত্র ধর্মঘট, মিছিল-সমাবেশসহ টানা দুই মাস ছাত্র আন্দোলন হলেও অপহৃত দুই ছাত্র উদ্ধারে পুলিশের দৃশ্যমান কোন ভূমিকা দেখা যায়নি।’

No comments

Powered by Blogger.