মোদি-মমতা বাগযুদ্ধ

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নরেন্দ্র মোদি
১২ মে শেষ পর্বের ভোট গ্রহণ হবে, তারপর ১৬ মে ভোটের ফল ঘোষণা। এত দিন লোকসভা নির্বাচনে নজর থাকত উত্তর প্রদেশ, বিহারসহ হিন্দিবলয়ের বড় রাজ্যগুলোর ওপর। কারণ, লোকসভা আসনের সংখ্যার নিরিখে তারাই এগিয়ে। দুটি কারণে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি নজর থাকত খুবই কম। উত্তর প্রদেশের মোট আসনসংখ্যা ৮০, বিহারের ৪০, মহারাষ্ট্রের ৪৮, তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মোট আসনসংখ্যা ৪২। তার ওপর দীর্ঘদিন ধরে, পশ্চিমবঙ্গে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস এবং বিজেপির শক্তি খুবই সীমিত। nকংগ্রেস সেই ১৯৭৭ থেকে পশ্চিমবঙ্গে অনেক দুর্বল,
হাতে গোনা কয়েকটি আসন তারা পায়। ভারতীয় জনসংঘ, যা ১৯৭৯ সাল থেকে বিজেপি নামে রূপান্তরিত, তাদের এ রাজ্যে সবচেয়ে বড় সাফল্য ১৯৯৯ সালে, মাত্র দুটি আসন, তাও তৃণমূল কংগ্রেসের হাত ধরে। বামপন্থীরাই এখানে এত দিন দাপট দেখিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতা হারিয়ে গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে এ রাজ্যে বিরোধী রাজনীতির জায়গায় একটা বড় শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই শূন্যতা ভরাট করতে মোদি হাওয়ায় ভর করে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে তৃণমূল কগ্রেস, সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসকে। ফলে, এত দিন জাতীয় রাজনীতিতে মোটামুটিভাবে প্রান্তিক অবস্থানে থাকা পশ্চিমবঙ্গের ওপর এখন গোটা দেশের নজর। বিজেপি এতটাই উজ্জীবিত যে নরেন্দ্র মোদি চার-চারবার পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচার করে গেলেন। প্রথমবার তিনি কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে জনসভা করেন। তখন রাজ্যে ক্ষমতাসীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আক্রমণ করেননি। কিন্তু ভোটের হাওয়া জোরালো হতে শুরু করতেই মোদি মমতা ও তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হতে লাগলেন। শিলিগুড়িতে, তারপরে দক্ষিণবঙ্গের আসানসোল বাঁকুড়াতেই মোদির সুর চড়তে শুরু করে। শেষে কৃষ্ণনগর, বারাসাত ও কলকাতায় তা তীব্র মমতাবিরোধী আক্রমণে পরিণত হয়। মোদি মমতাকে প্রধানত তিনটি বিষয়ে আক্রমণ করেছেন। বাম শাসনের পরিবর্তন চেয়ে রাজ্যের মানুষের যে দাবি জোরালো হচ্ছিল, তা সম্বল করে তিনি ক্ষমতায় এলেও মানুষের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে তিনি ও তঁার দল জড়িত বলেই তঁার সরকার এত দিন ধরে সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করেছে। এ ছাড়া বামপন্থীদের মতোই মমতাও ভোটব্যাংকের কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের অবাধে ঢুকতে ও এ রাজ্যে বসবাস করতে সাহায্য করছেন। প্রথম দুই অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গের ভোটদাতাদের মনে সাড়া জাগালেও এই তৃতীয় প্রসঙ্গে মোদি যে নিজেও বিজেপির ঘোষিত নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সংকীর্ণ রাজনীতি করছেন, তা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। মমতাও এই সুযোগে প্রথম দুই অভিযোগের উত্তর এড়িয়ে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রশ্নে মোদি তথা বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচারণার সুযোগ নিয়েছেন। তাঁরও লক্ষ্য, মোদি যেমন বিভেদের রাজনীতি করে হিন্দুদের ভোট বিজেপির দিকে টানতে চেষ্টা করছেন, তিনিও তেমনই মোদির জুজু দেখিয়ে সংখ্যালঘুদের ভোট তৃণমূলের দিকে এককাট্টা করা। এই অবস্থায় লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে এখন রাজনীতির লড়াইটা আর শাসক তূণমূল কংগ্রেস এবং প্রধান বিরোধী বামফ্রন্টের মধ্যে সীমিত নেই। লড়াই এখন বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের, বিজেপির সঙ্গে বামপন্থীদের, বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের। এককথায় মোদি ও তাঁর দল বিজেপি এবার সাফল্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক লড়াইয়ের আঙিনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন। মমতা নির্বাচনী প্রচারের প্রথম পর্বে প্রকাশ্যে দাবি করছিলেন, এবার ৪২ আসনের ৪২টিই তাঁরা জিতবেন। মমতাঘনিষ্ঠ মুকুল রায় প্রমুখ তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা অবশ্য ঘরোয়া আলোচনায় বলতেন, ৩০-৩২ আসন তাঁরা পাবেন। কিন্তু এখন সব হিসাব গোলমাল হয়ে গেছে। বিজেপির দিকে ভোটের টান বাড়ছে বুঝতে পেরে তাঁরা দৃশ্যতই উদ্বিগ্ন। এপ্রিলের গোড়ায়ও মমতা রাজ্যে নির্বাচনী জনসভায় কখনো মোদির নাম করতেন না। বিজেপিকে আক্রমণও করতেন নরম সুরে। তুলনায় তাঁর আক্রমণ বেশি করে থাকত দিল্লির প্রতি৷
রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.