খোলা চোখে- নেতা কেন চোর? by হাসান ফেরদৌস

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে পালিয়ে যাওয়ার সময় বাক্সভর্তি সোনা-দানা যা পারেন নিয়ে গেছেন, কিন্তু ফেলে গেছেন তাঁর সাধের সাতমহলা বাড়ি। সাড়ে তিন শ একর জমির ওপর সে বাড়ি, বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভালো।
আলিশান সেই প্রাসাদে কয়েক ডজন বাসকক্ষ ও অতিথিনিবাস ছাড়াও রয়েছে ১৮-হোলের গলফ ময়দান, টেনিস কোর্ট, একটি বোলিং কেন্দ্র ও ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা। হরিণ-টরিন তো ছিলই, বিরল ও দুর্লভ কিছু জীবজন্তুও এনে জড়ো করা হয়েছিল সেখানে, যেগুলো ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখা বেআইনি। শুধু নতুন ও সাবেকি মডেলের মোটরগাড়ি ও ইউরোপের নানা দেশ ঝেঁটিয়ে সংগ্রহ করা ঝাড়বাতির দাম ধরলেই তা কয়েক শ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে।

এ তো গেল প্রাসাদ বানাতে ও সাজাতে কী পরিমাণ অর্থ তিনি জলে ঢেলেছেন। কী পরিমাণ অর্থ তিনি ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা হাতিয়েছেন, সে হিসাব এখনো পুরোপুরি করা হয়ে ওঠেনি। ইউক্রেনের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী আইন পরিষদকে জানিয়েছেন, রাজকোষ থেকে কম করে হলেও ৩৭ বিলিয়ন ডলার লোপাট গেছে। ইয়ানুকোভিচ যে কয়েক বছর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সে সময় প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। যাঁরা পাচার করেছেন, তাঁরা হয় সাবেক প্রেসিডেন্টের নিকটাত্মীয়-স্বজন অথবা তাঁর তাঁবেদার। এখন এমন অবস্থা যে দেশ চালাতে ইউক্রেনকে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে নামতে হবে।
খবরটা পড়ে আমাদের দেশের রাজনীতিকেরা হয়তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন। দেখলেন তো, টাকা কেবল আমরাই হাতাই না, ক্ষমতায় গেলে ইউরোপের নেতা-নেত্রীরাও টু-পাইস কামানোর ব্যাপারে কম যান না। অথচ দোষ ধরার বেলায় আপনারা পত্রিকাওয়ালারা ওত পেতে থাকেন শুধু এই নন্দ ঘোষ আমাদের কথা গলা ফাটিয়ে বলার জন্য।
ক্ষমতা ও দুর্নীতি—এই দুইয়ের মধ্যে যে একটি অদৃশ্য যোগসূত্র আছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। ইউক্রেনে হোক বা বাংলাদেশে বা আমেরিকায়, সর্বত্রই অবস্থা কমবেশি একই রকম। এই আমেরিকার কথা ধরা যাক। এ দেশে প্রতিবছরই এক-আধজন করে রাজনীতিক উৎকোচ গ্রহণের দায়ে ধরা পড়েন। অঙ্কের হিসাবে খুব বড় নয়, কিন্তু একবার সে ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে, টিকে থাকা অসম্ভব। গত মাসে ধরা পড়লেন নিউ অরলিন্সের মেয়র রে নাগিন। তিনি উৎকোচ নিয়ে সরকারি কাজ পাইয়ে দিয়েছেন এবং আয় অনুসারে কর প্রদান করেননি, এমন অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁর কারাদণ্ড হতে যাচ্ছে।
আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ ১০ জন রাজনীতিকের একটি তালিকা । তৈরি করেছে ‘রিয়েল ক্লিয়ার পলিটিক্স’ নামের একটি ওয়েব পত্রিকা (http://www.realclearpolitics.com/lists/most^corrupt^politicians/intro.html?state=play)। সে তালিকায় সিনেটর-কংগ্রেসম্যান তো রয়েছেনই, একজন ভাইস প্রেসিডেন্টও আছেন। তবে তাঁরা কেউই টাকা মেরে গাপ করার সুযোগ পাননি। ধরা পড়ার ফলে যথারীতি বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ক্ষমাভিক্ষা না পেলে জেলের ভাতও খেতে হয়েছে। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় চোর যে ভদ্রলোক, তাঁর নাম বস টুইড। জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি এক বিলিয়ন ডলারের মতো হাতিয়েছিলেন, এই অভিযোগে তাঁর মোট ১২ বছরের কারাদণ্ড হয়। পরে কারাগার থেকে পালিয়ে স্পেনে গিয়ে লুকানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু সেখান থেকে তাঁকে বেঁধে আনা হয়। শেষে ভদ্রলোক মারা যান কারাগারেই। সে প্রায় সোয়া শ বছর আগের ঘটনা।
সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকায় যাঁরা চুরির অভিযোগে ধরা পড়েছেন, তাঁদের কোনোটাই ঠিক পুকুরচুরির ঘটনা নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেসব দুর্নীতির অভিযোগে এ দেশে রাজনীতিকেরা ধরা পড়েন, সে কথা শুনলে আমাদের কর্তারা হেসে কুটি কুটি হবেন। লবিস্টের কাছ থেকে বিদেশভ্রমণের খরচাপাতি, বাড়ি মেরামতের খরচ নেওয়া ইত্যাদির মতো ঘটনাই এ দেশে বেশি। তো অপরাধ যত কম বা বেশি হোক না কেন, একবার ধরা পড়লে তাঁর নিস্তার পাওয়া সোজা ব্যাপার নয়। অপরাধী, তা তিনি যত ক্ষমতাবানই হোন না কেন, আইনের লম্বা হাত ফসকে পার হবেন, তেমন সম্ভাবনা খুবই কম।
আমাদের দেশে অবশ্য অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে চোর ছোট বা বড় যেমনই হোক, তাঁরা ধরা পড়েন না। যদি কখনো ধরা পড়েনও, ক্ষমতার সমীকরণে উল্টো দিকে না থাকলে তিনি কখনোই বিচার ও শাস্তির সম্মুখীন হন না। আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দুটোই তাঁদের পকেটে। কিন্তু আমেরিকায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে পার পাওয়া কঠিন। কারণ, রাজনীতিকদের কাবু করার জন্য রয়েছে দুর্নীতি দমন বিভাগ। কয়েক বছর আগে লুইজিয়ানায় এক কংগ্রেসম্যানের রেফ্রিজারেটরে ৭৫ হাজার ডলার পাওয়া গিয়েছিল। সেই টাকা উদ্ধারের জন্য আইন বিভাগ থেকে নাইজেরীয় ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে এক লোককে পাঠানো হয় এবং তাঁদের কথাবার্তার পুরোটা রেকর্ড করে নেওয়া হয়। এ ছাড়া রয়েছে সিভিল সোসাইটি গ্রুপসমূহ, যারা রাজনীতিকদের প্রতিটি কাজের ওপর নজর রাখে। রাজনীতিকের গায়ে বিন্দুমাত্র বিষ্ঠা লেগেছে, তা টের পেলে পত্রপত্রিকাও সহজে পিছু ছাড়ে না। আমাদের দেশে সে ভয় নেই। দুর্নীতি দমন বিভাগ ও পাড়ার দারোগা বাবুর মধ্যে কোনো তফাত নেই। সিভিল সোসাইটির অধিকাংশও কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের মধ্যে যাঁদের ঘাড় ত্যাড়া, তাঁদের ঘাড় মটকানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে, ফলে লাইনে কথা না বলে উপায় নেই। কোনো কোনো পত্রিকা নরম-গরম কথা বলে বটে, কিন্তু যেখানে দেশের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর, সেখানে পত্রিকার ভূমিকা সীমিত হতে বাধ্য। তা ছাড়া আজকাল সবাই টিভি দেখে, সে কথা টের পেয়ে আমাদের রাজনীতিকেরা নিজেরাই এক-একটা টিভি চ্যানেলের মালিক বনে গেছেন।
আসলে রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী—এই দুই ধরনের মানুষকে যদি চোখে চোখে না রাখা হয়, তাঁরা নয়-ছয় করবেনই, তা সে ইউক্রেনে হোক বা আমাদের দেশে। এই অবস্থায় রাজনৈতিক দুর্নীতির যারা ভুক্তভোগী, অর্থাৎ সাধারণ মানুষ, তাদের এগিয়ে আসতে হবে। শুধু গেল গেল বলে চেঁচালে হবে না, চোর পালানোর আগে তাকে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। যেহেতু মুরগি আমাদের, ফলে আমাদেরই মুরগি পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। ভারতে আম আদমি পার্টির শুরু এই সচেতনতা থেকেই।
বাংলাদেশে আমরা বরাবর তাকিয়ে থেকেছি আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের দিকে। তাঁরা যেদিকে যেতে বলেছেন, আমরা সে পথে চলেছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারেননি। দেশটাকে নিজেদের তালুকদারি ভেবে যা ইচ্ছে করে গেছেন। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ ৪০০ থেকে ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি করে নিয়েছেন, তারপর বুক চেতিয়ে বলেছেন, ক্ষমতায় থাকলে সম্পদ তো কিছু বাড়বেই।
ইউক্রেনের মানুষ আমাদের শেখাল, নেতা যখন চোর হয়, তখন তাকে শায়েস্তা করতে হয় কীভাবে।

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.