মিয়ানমারের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে কি? by সোহরাব হাসান

গত কিস্তিতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা সম্পর্কে লিখেছি। অনেকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। তাঁদের মতে, মূল সমস্যা পাশ কাটিয়ে আমি জঙ্গিদের নিয়ে কানুর গীত গাইছি। আসলে প্রতিটি সমস্যারই বহুমাত্রিক রূপ আছে। কোনোটি বাদ দিয়ে বা এড়িয়ে সমস্যা সমাধানের সুযোগ নেই।

সত্য যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে জঙ্গিবাদী-মৌলবাদীরা রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে মিয়ানমার সরকার তাদের মৌলিক মানবিক অধিকারগুলো হরণ করেছে বলেই। এমনকি তাদের নাগরিক অধিকারও নেই। সরকার ‘হোয়াইট কার্ড’ নামে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী পরিচয়পত্র দিয়েছে। ফলে সরকারের অনুমতি ছাড়া তারা যেখানে বাস করে, তার বাইরে যেতে পারে না। যদিও ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজের খোঁজে অনেককেই বাইরে যেতে হয়। উপায় কী? স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিয়ে তারা বাইরে যায়। কখনো কখনো নিরাপত্তা বাহিনী তাদের বেগার শ্রম দিতে বাধ্য করে। রাজি না হলে নির্যাতন চালায়।
সবচেয়ে অমানবিক হলো বিয়ে করতে বা সন্তান নিতেও রোহিঙ্গাদের সরকারের অনুমতি নিতে হয়। তারা দুটির বেশি সন্তান নিতে পারে না। কিন্তু মিয়ানমারের অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর এ নিষেধাজ্ঞা নেই। তারা নিজেদের রোহিঙ্গা বা আরাকানি হিসেবে পরিচয় দিতেও পারছে না। অনেকে মুসলমান নাম গোপন করে বর্মি নাম ব্যবহার করে। সরকারের ভাষায় রোহিঙ্গারা ‘বহিরাগত বাংলাভাষী।’ আগে রাজ্যের নাম ছিল আরাকান, যার সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঐতিহাসিক যোগসূত্র ছিল। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাখাইনদের দাবিতে এখন রাজ্যের নাম হয়েছে রাখাইন।
মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর যতটা বৈরী, তার চেয়ে বেশি রুষ্ট রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধরা। দুই সম্প্রদায়ের ‘ঐতিহাসিক বিরোধকে’ উসকে দেয় ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকেরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রোহিঙ্গা মুসলমানেরা শর্ত সাপেক্ষে ব্রিটিশদের সমর্থন জানায়, তাদের হয়ে যুদ্ধ করে। আর রাখাইন বৌদ্ধরা জাপানিদের পক্ষ নেয়।
রোহিঙ্গারা এখন নিজ দেশে কেবল পরবাসী নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রান্তিক ও নির্যাতিত জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। অথচ ঐতিহাসিকভাবে তারা মিয়ানমারের অবিচ্ছেদ্য অংশই নয়, দেশটির স্বাধীনতাসংগ্রামেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। ১৯৪৭ সালে অং সানের সঙ্গে যে কজন স্বাধীনতাসংগ্রামী নিহত হন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন রোহিঙ্গা মুসলমান।
১৯৮৮ সালে অং সান সূচিকে রাজনীতিতে আনার ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গা মুসলিম লেখক ও রাজনীতিক মং থু কার (মুসলিম নাম নূর মোহাম্মদ) ভূমিকা ছিল। তিনি পরে এনএলডির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন।
কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মি শাসকেরা এসব মনে রাখেননি। তাঁরা জাতিবিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিয়ানমারের বহুজাতিক ও গণতান্ত্রিক চরিত্র। ১৯৬২ সালের আইনে রোহিঙ্গাদের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়নি। সেখান থেকেই তাদের দুঃখ ও বঞ্চনার শুরু।
নিকট অতীতে রোহিঙ্গাদের ওপর সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা ঘটে ২০১২ সালের জুন ও অক্টোবরে। তিন মুসলিম যুবকের হাতে একজন বৌদ্ধ নারীর ধর্ষিত ও নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। বহু রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পাঁচ মাস ধরে চলা এ সংঘর্ষে প্রায় ২০০ লোক নিহত এবং লক্ষাধিক লোক বাস্তুচ্যুত হয়। সে সময় বাংলাদেশের সীমান্তে কড়াকড়ি থাকায় অধিকাংশ রোহিঙ্গা পালিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। যারা বাইরে যেতে পারেনি, তাদেরও ঠাঁই হয় বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে।
এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, দেশটিতে মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বর্মি ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। এ ছাড়া আছে কারেন, চিনসহ ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী। খ্রিষ্টান ও মুসলমান আছে ৪ শতাংশ করে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তালিকাভুক্ত ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর বাইরে যারা আছে, তারা ‘অন্যান্য’ বলে পরিচিত হবে। কিন্তু রাখাইনের বৌদ্ধরা তাও মানতে রাজি নয়।
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমরা ইয়াঙ্গুনে থাকতে রাখাইন রাজ্যে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। একটি হলো আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা মেডিসিন সান ফ্রন্টিয়ার (এমএসএফ) কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা। সংস্থাটি ২২ বছর ধরে সেখানে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছিল। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এক নির্বাহী আদেশে কেন্দ্রীয় সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়। সংস্থার একজন প্রতিনিধি জানান, সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে ৩০ হাজার এইচআইভি বা এইডসে আক্রান্ত রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া তিনটি বড় ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদেরও স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হবে। সবচেয়ে হাস্যকর হলো, তারা রোহিঙ্গাদের প্রতি পক্ষপাত দেখাচ্ছে বলে সরকারের অভিযোগ। অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনের হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার অবাধ সুযোগ থাকলেও রোহিঙ্গা মুসলমানদের নেই। তারা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ঘরের বাইরে যেতে পারে না। দ্বিতীয়ত, অর্থ দিয়ে ওষুধ কেনা বা চিকিৎসাসেবা নেওয়ার সামর্থ্য নেই। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক এ সংস্থার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার অর্থ হলো তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া।
মিয়ানমার টাইমস ১০ মার্চের সংখ্যায় লিখেছে, চিকিৎসাসুবিধা না থাকায় রোহিঙ্গাদের জীবন হুমকিতে পড়েছে। অনেক মৃত্যুপথযাত্রীর একজন সাজিব আহমেদ রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিটুর কাছে অং মিংগুলার গিট্টোতে বন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন আরও চার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানের সঙ্গে। এখানে তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা—কোনো কিছুরই নিশ্চয়তা নেই। সশস্ত্র রক্ষীদের কঠোর পাহারা এড়িয়ে তারা বাইরেও যেতে পারছে না। আর রক্ষীদের উৎকোচ দিয়ে যদি তারা ক্যাম্পের বাইরে যায়, রাখাইন বৌদ্ধদের কাছ থেকে আক্রমণের ভয় আছে। অং মিংগুলারের অনেক রোহিঙ্গা মুসলমানেরই ১০ হাজার চ্যাত দেওয়ার সামর্থ্য নেই, আর এ অর্থ না দিলে তাদের বাইরেও যেতে দেবে না যমরূপী রক্ষীরা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল উ সু লিং লুইনের দাবি, সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা ‘বেঙ্গলি’দের স্বাস্থ্যসেবা দেবে, কিন্তু ক্যাম্পের বাসিন্দারা ভরসা পাচ্ছেন না। এমএফএসের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কোনো সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী সেখানে যাননি। গ্রামের কাছে যে ট্রাকটি আছে, তাতে করে সপ্তাহে দুবার তাঁরা কাছের বাজারে যেতে পারেন।
৬৩ বছর বয়সী মাং মাং বলেন, ‘আমরা চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে পারছি না। হয়তো এখানেই বিনা চিকিৎসায় মারা যাব।’
মিয়ানমার টাইমস আরও জানায়, শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত তিন বছর বয়সী একটি শিশুকে এখানে নিয়ে আসার পাঁচ দিন পর মারা যায়। তাকে ঠিকমতো চিকিৎসা করা হয়নি বলে অভিযোগ আছে। এ ব্যাপারে একজন পুলিশ কর্মকর্তা তদন্ত করতে আসেন এবং তিনি দাবি করেন, চিকিৎসক তাঁর সাধ্যমতো সবকিছু করেছেন। তবে স্বাস্থ্যকর্মীরা ঠিকমতো যত্ন নেননি। সে সময় একজন ইউরোপীয় চিকিৎসকও হাসপাতাল পরিদর্শন করেন এবং চিকিৎসার অব্যবস্থাপনা দেখে মর্মাহত হন। একজন বৃদ্ধার মুখে সেলাই করতে গিয়ে কেন মোটা সুতা ব্যবহার করা হচ্ছে জিজ্ঞাসা করা হলে জানানো হয়, ‘তিনি একজন নারী এবং মুসলিম।’
দ্বিতীয় ঘটনা। ২০১৫ সালের নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের লোকগণনা। সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকার না করলেও তাদের ‘অন্যান্য’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে। কিন্তু রাখাইন বৌদ্ধরা এর তীব্র বিরোধিতা করছে।
এ ছাড়া সম্প্রতি মিয়ানমারের উচ্চ পরিষদ অস্থায়ী নাগরিকেরা রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারবে না বলে একটি প্রস্তাব পাস করে। আরাকান ন্যাশনাল পার্টি এএনপি গত বছর এ প্রস্তাব এনেছিল। উচ্চ পরিষদের পর নিম্ন পরিষদ এটি অনুমোদন করলে আইনে পরিণত হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারের শাসকদের মনোভাব বদলাবে কি না। তারা কি একটি জনগোষ্ঠীর ওপর দমন-পীড়ন চালাতে থাকবে, না তাদের মৌলিক ও মানবিক অধিকারগুলো স্বীকার করে নিয়ে একসঙ্গে বসবাসের সুযোগ করে দেবে? তাদের মনে রাখা উচিত, একটি জনগোষ্ঠীকে কখনোই এভাবে উচ্ছেদ বা বিতাড়িত করা যায় না। মিয়ানমারের সরকার যদি দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায়, তাহলে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে একটি সমঝোতায় আসতেই হবে।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.