‘তিস্তা চুক্তি কঠিন’ শেখ হাসিনাকে মনমোহন সিং

তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি কঠিন’ বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি বলেছেন, ইস্যুটি কঠিন হলেও ভারত তা সমাধানের চেষ্টা করছে।
মিয়ানমারের রাজধানী নেপিড’তে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সাইড লাইনে এক বৈঠকে শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞাসার জবাবে মনমোহন এ সব কথা বলেন। দিল্লির বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন বৈঠকের বিষয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করেছেন। বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন বলে জানান আকবর। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল গণমাধ্যমকে বলেছেন, তিস্তা চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণ ভারতের ইতিবাচক ও কার্যকর পদক্ষেপের অপেক্ষায় রয়েছে বলে বৈঠকে মনমোহনকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বাগড়ায় প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকা ওই চুক্তিটি সই করতে পারেননি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী। ওই বছরের তার ঢাকা সফরের সময় এটি সই হওয়ার কথা ছিল।

১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের আশ্বাস: এদিকে নেপিড’ থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, প্রায় এক ঘণ্টার ওই বৈঠকে ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রির বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন এবং তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রতিবেশী দেশটির সরকার প্রধানের সঙ্গে শেখ হাসিনার প্রথম বৈঠক ছিল এটি। বৈঠকের পর মাহবুবুল হক শাকিল সাংবাদিকদের বলেন, ত্রিপুরা থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশের সঞ্চালন লাইনে যুক্ত করার জন্য মনমোহন সিংকে অনুরোধ জানালে মনমোহন সিং দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নেয়ার ওই আশ্বাস দেন। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আওতায় ভারত বর্তমানে বাংলাদেশের কাছে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রি করছে। এজন্য গত বছর দুই দেশের গ্রিড লাইনকে সমন্বিত করে প্রায় ৯৮ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন বসানো হয়। ভারত থেকে বাংলাদেশের গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য ভারতের বহরমপুর ও বাংলাদেশের ভেড়ামারায় বসানো হয় দু’টি সুইচিং স্টেশন। গত বছর ৫ই অক্টোবর বিদ্যুৎ আমদানি প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে দুই দেশের সরকার। এছাড়া ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার পালটানায় স্থাপিত ৭০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে অন্তত ১০০ মেগাওয়াট বাংলাদেশে বিক্রির জন্য রাজ্য সরকার আগ্রহ দেখালেও নয়া দিল্লির সবুজ সঙ্কেত না পাওয়ায় বিষয়টি আটকে আছে। পালটানায় ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ভারতের পশ্চিম অংশ থেকে ভারি যন্ত্রপাতি পূর্বাংশে নিয়ে যাওয়া হয় বাংলাদেশের ওপর দিয়েই। আশুগঞ্জে ট্রান্সশিপমেন্ট চালুর মধ্য দিয়ে ভারতকে সেই সুযোগ দেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী উল্লেখ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান-এই চার দেশ আঞ্চলিক উদ্যোগে পানিবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে পারে। এ উদ্যোগ এই অঞ্চলের অর্থনীতিকেও গতিশীল করবে। দুই দেশের স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টিও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। স্থলসীমা প্রটোকল ভারতের লোকসভায় উত্থাপন করায় মনমোহন সিংকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ওই প্রটোকল বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের বিল শিগগিরই ভারতের পার্লামেন্টে পাস হবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি এবং ২০১১ সালে সই হওয়া স্থল সীমানা প্রটোকল বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন। ওই চুক্তির আওতায় ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের মোট ৭১১০ একর আয়তনের ৫১টি এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের মোট ১৭ হাজার ১৬০ একর আয়তনের ১১১টি ছিটমহল বিনিময়ের কথা রয়েছে। শাকিল জানান, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জয়ী হয়ে সরকার গঠন করায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার প্রধানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টারও প্রশংসা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ সহকারী জানান, প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসকে এ অঞ্চলের ‘অভিন্ন শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে এর বিরুদ্ধে ‘ঐক্যবদ্ধভাবে’ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ এম. জিয়াউদ্দিন ও পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শংকর মেনন ও পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকায় বিসমটেক সচিবালয়কে স্বাগত মনমোহনের: এদিকে বাংলাদেশে বিমসটেকের সচিবালয় স্থাপন হলে তা এর লক্ষ্য পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার আঞ্চলিক এই জোটের স্থায়ী সচিবালয় স্থাপনে সম্মত হওয়ায় বাংলাদেশকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন তিনি। গতকাল বিমসটেকের তৃতীয় সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ আঞ্চলিক এই জোটের সরকার প্রধানরা। ঢাকা বিমসটেকের স্থায়ী সচিবালয় স্থাপনের সিদ্ধান্তকে সাত জাতির এ সংস্থার জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক’ হিসেবে চিহ্নিত করেন মনমোহন। জোটের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ‘সরাসরি ও প্রযুক্তিগত’ যোগাযোগ এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও ঐক্যের চালিকাশক্তি হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মনমোহন বলেন, ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিপক্ষীয় মহাসড়ক, কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট-ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প, এশিয়ান হাইওয়ে এবং আসিয়ান মাস্টারপ্ল্যান ফর কানেকটিভিটির মতো বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করার মধ্য দিয়ে ভারত বিমসটেক সদস্যদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ অঞ্চলে সন্ত্রাস প্রতিরোধে জোটভুক্ত দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। দেশগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে সন্ত্রাসের মতো কিছু সাধারণ সমস্যায় ভুগছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব সমস্যা দূর করতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই সহযোগিতার অংশ হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সংগঠিত অপরাধ ও মাদক পাচার প্রতিরোধে বিমসটেক দেশগুলোর মধ্যে আইনি সহযোগিতা চুক্তির ওপর গুরুত্ব দেন। বিমসটেক দেশগুলোর মধ্যে অপরাধী বিনিময়ের বিষয়ে আলোচনা শুরুরও তাগিদ দিয়ে জোটের সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো তুলে ধরে এর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আশা করেছেন তিনি।
নিরাপদ ও স্থিতিশীল অঞ্চল গড়ার আহ্বান: এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমসটেকভুক্ত সদস্যদের প্রতি এই অঞ্চলের সকল মানুষের মর্যাদা ও শান্তি রক্ষায় একটি নিরাপদ স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধশালী এলাকা গড়ে তোলার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। নেপিড’তে তৃতীয় বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা তার ভাষণে সমন্বিত অর্থনীতি ও অভিন্ন সমৃদ্ধির স্বার্থে সম্মিলিত প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে বিমসটেক সদস্য দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে কাজ করার প্রয়োজনীযতার উপর জোর দেন। বলেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে- বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে সমন্বিত অর্থনীতি ও অভিন্ন সমৃদ্ধির স্বার্থে আমাদের সম্মিলিত প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে ঐক্যবদ্ধ শক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে কাজ করতে হবে। ১৯৯৮ সালে বিমসটেক গৃহীত সহযোগিতার ছয়টি ক্ষেত্র ১৪টি লক্ষ্যে সমপ্রসারিত হয়েছে। এর কয়েকটি ক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্রগতি হয়েছে, অন্যগুলো নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিমসটেককে গতিশীল করতে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস এবং সুফলের ন্যায়সঙ্গত ও সুষম বণ্টন। অনুষ্ঠানে সংস্থার চেয়ার মিয়ানমার-এর প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন স্বাগত ভাষণ দেন। উদ্বোধনীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকশে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী সেরিং তুবগে ও থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পার্মানেন্ট সেক্রেটারি ও বিশেষ দূত সিহাসাক ফুয়ানকেটকেউ বক্তৃতা করেন। ১৯৯৭ সালের জুনে বে অব বেঙ্গল ইনিসিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন-বিমসটেক প্রতিষ্ঠা হয়। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড নিয়ে গঠিত ওই সংস্থার এবারের শীর্ষ সম্মেলনে ঢাকায় স্থায়ী সচিবালয় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক (এমওএ’স), ভারতে আবহাওয়া ও জলবায়ু বিমসটেক সেন্টার প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং ভুটানে বিমসটেক কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিজ কমিশন ও বিমসটেক কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিজ অবজারভেটরি প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক (বিসিআইও) স্বাক্ষরিত হয়। সদস্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। ঢাকায় বিমসটেকের স্থায়ী সচিবালয় সংস্থাটির চুক্তি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকে আর ত্বরান্বিত করবে আশা করে প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের জন্য ঢাকাকে নির্বাচন করায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে সদস্য রাষ্ট্রের নেতাদের ধন্যবাদও জানান। ওই প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.