একে একে নিভিছে দেউটি

তিউনিসিয়া থেকে খবর এসেছে, সে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল একে অপরের বিরুদ্ধে লাঠালাঠি থামিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণে সম্মত হয়েছে। তিন বছর আগে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সফল বিপ্লবের পর প্রথম যে নির্বাচন হয় তাতে বিজয়ী হয়েছিল রাশিদ ঘানুচির নেতৃত্বে ইসলামপন্থী আন-নাহদা পার্টি। সে বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিল দেশের, প্রধানত শহরকেন্দ্রিক ধর্মনিরপেক্ষ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক দল।
কিন্তু আন-নাহদার জনপ্রিয়তা ঠেকানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরে বেজি সাইদের নেতৃত্বে তারা নিদা তুনেস (বা তিউনিসিয়ার ডাক) নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে যোগ দেয়। প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে পরাজয় তারা খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেনি, ফলে প্রথম দিন থেকেই ঘানুচি সরকারের বিরোধিতা করেছে। সে বিরোধিতা ক্রমেই সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে। ঘানুচি সরকারের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে দেশজুড়ে আন্দোলনও গড়ে তোলে তারা। সবাই ভয় পাচ্ছিল, দুই দলের এই কোন্দলের সুযোগে পেছন দরজা দিয়ে সামরিক বাহিনী ক্ষমতার কুর্সিখানি দখল না করে বসে। না, তেমন কিছু ঘটেনি। অন্ততপক্ষে এখন পর্যন্ত নয়। ঘানুচি ও বেজি সাইদ প্যারিসে বৈঠক করে ঠিক করেছেন, লড়াইটা রাস্তায় নয়, ব্যালটের মাধ্যমেই হবে। আগামী নির্বাচন যাতে স্বচ্ছ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, সে উদ্দেশ্যে তাঁরা একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার (না, আপনারা ভুল পড়ছেন না) গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটাই কাজ হবে, আর তা হলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা একদম নতুন নয়, কিন্তু বাস্তবে, হাতে-কলমে তেমন সরকার প্রতিষ্ঠা প্রথম বাংলাদেশেই। সে অর্থে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আঁতুড়ঘর বাংলাদেশ, এ কথা বলাই যায়।
এরপর বাংলাদেশের দেখাদেখি নেপালে ও পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি গৃহীত হয়েছে। পাকিস্তানে এ বছর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার পরিচালনায় ছিল সে রকম একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০৬ সালে সাবেক মার্কিন সিনেটর টম ড্যাশলের নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যাপারটা কী, তা কতটা বাস্তবসম্মত, তা দেখতেই তারা এসেছিল। সব দলের ও মতের লোকজনের সঙ্গে কথা বলার পর তাদের সিদ্ধান্ত ছিল, বাংলাদেশের মতো সংঘাতসংকুল ও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত দেশে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা একটি বাস্তবসম্মত বিকল্প। এই ব্যবস্থাকে ‘ইউনিক ইনোভেশন’ হিসেবে অভিহিত করে তারা মন্তব্য করে, এই অভূতপূর্ব উদ্ভাবনার জন্য বাংলাদেশের মানুষ ‘গর্ববোধ করতে পারে।’ পরিণত গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীন সরকারই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব বর্তায় চলতি সরকারের ওপর। সমস্যা হলো, যারা ক্ষমতায় বসে, ক্ষমতা ত্যাগের কোনো ইচ্ছাই তাদের থাকে না। ফলে যেভাবেই হোক নির্বাচনী ফল নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী করার সব চেষ্টাই তারা করে থাকে। (শুধু তৃতীয় বিশ্বে কেন, এই আমেরিকাতেও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য চৌদ্দ রকম ফিকিরবাজি প্রতিদিনই ঘটছে।) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যে দল হারল, খোলা মনে তারা ফলাফল কখনোই গ্রহণ করে না। অবশ্য তার একটি কারণ ক্ষমতাসীন দলের হরেক রকম কারচুপি।
উদাহরণ হিসেবে জিম্বাবুয়ের কথা ভাবুন। বুড়ো হাড় মুগাবে ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায়। প্রথম দুটি নির্বাচনে তাঁর দলের বিজয় নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি। তিনি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতা, তাঁর প্রতি দেশের মানুষের অগাধ শ্রদ্ধা। কিন্তু দিন যতই গেছে, ততই স্পষ্ট হয়েছে লোকটা কেবল অকর্মণ্য নয়, দুর্নীতিবাজও বটে। ফলে তাঁর জনপ্রিয়তা কমেছে, বিরোধীপক্ষের পাল্লা ভারী হয়েছে। শেষ দুটি নির্বাচনে তাদেরই জেতার কথা, সব জনমত গণনা থেকেই সে কথাই জানা গেছে। কিন্তু তা হলে কী হবে, নয়ছয় করার অগাধ ক্ষমতা মুগাবের। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত। অনেকেই বলছেন, একদম টেসে না যাওয়া পর্যন্ত এই লোক গদি ছাড়ছেন না। ১৯৯০-এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থাও অনেকটা সে রকম ছিল। স্বাধীনতার পর প্রথম ২০ বছর ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়েছে সামরিক নেতৃত্ব, অথবা সামরিক সমর্থিত সরকার। সময় সময় নির্বাচন হয়েছে ঠিক, কিন্তু সে নির্বাচনের ফল যে কেউ ভোট নেওয়ার আগেভাগেই বলে দিতে পারত। এই অবস্থা যাতে না ঘটে সে জন্যই দেশের সব প্রধান রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা মেনে নিয়েছিল। পরে নির্বাচনী ফলে অসন্তুষ্ট হারু পার্টি নানা রকম অভিযোগ তুলেছে।
কেউ সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ তুলেছে, কেউ বা সরাসরি ভোট চুরির। তবে দেশের মানুষের সমর্থন থাকায় গত ২০-২২ বছরে প্রতিটি সরকারই তার নির্ধারিত মেয়াদ উত্তীর্ণ করেছে। এই দুই দশকে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের জন্য জরুরি এমন সব প্রধান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। সমস্যা ছিল, দুর্বলতা ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও আস্থাপূর্ণ গণতন্ত্রের জন্য যে ভিত চাই, বাংলাদেশ তার অনেকটাই অর্জন করেছিল। আমার ভয় হচ্ছে, এখন গত দুই দশকের সব অর্জন আমরা হারাতে বসেছি। নির্বাচনের নামে যে প্রহসন আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে, তার ফল হবে একটাই। আর তা হলো, গত ২০-২২ বছরের সব চেষ্টা, সব অর্জন জলে ডোবানো। শেষ পর্যন্ত যদি এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, আমার মনে হয় না দেশের মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দিতে তারা বিস্তর রক্ত দিয়েছে, বিস্তর ত্যাগ স্বীকার করেছে। হয় আজ, অথবা আগামীকাল, বা আগামী বছর, অথবা পাঁচ বছর পর তাদের আবার সেই শূন্য থেকেই শুরু করতে হবে। তিউনিসিয়ার কথায় আরেকবার ফিরে যাই। বাংলাদেশের দুটি প্রধান দলের মধ্যে যেমন সাপে-নেউলে সম্পর্ক, তিউনিসিয়ার আন-নাহদা ও নিদা তুনেস দলের নেতা-কর্মীদেরও তাই। জনপ্রিয়তার বিচারে আন-নাহদা সম্ভবত এগিয়ে, নিম্নবিত্তদের অধিকাংশই তাদের পক্ষে। কিন্তু দেশের মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, বিশেষ করে শহুরে যুবকদের মধ্যে নিদা তুনেসের জনপ্রিয়তা বিপুল। ফলে, তাদের মতামত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দেশ চালানো অসম্ভব। মিসরে একই ঘটনা ঘটেছিল। ইসলামিক ব্রাদারহুড গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু সে কথার অর্থ এই নয়, দেশের বাকি প্রায় অর্ধেক মানুষের মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের ইচ্ছামতো তারা দেশ চালাবে। তাদের সে চেষ্টার ফল দাঁড়াল দেশব্যাপী নাগরিক অসন্তোষ, আর তার সুযোগে পেছনের দরজা দিয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় পুনঃপ্রত্যাবর্তন। ঘানুচির আন-নাহদা দলেরও সে ভয় ছিল। নিদা তুনেসও সে ভয়কে উপেক্ষা করতে পারেনি।
ফলে দুই পক্ষ থেকেই সমঝোতার উদ্যোগ এল। বেজি সাইদ এক টিভি সাক্ষাতে বললেন, তিউনিসিয়ার আজকের যে হাল, তার জন্য ঘানুচি দায়ী। ফলে তার সমাধানের দায়িত্বও তাঁকে নিতে হবে। ‘সে উদ্যোগ নিতে আপনাকে আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’ তাঁর এ কথার অর্থ, আসুন আমরা দুজনে কথা বলি, সমস্যা সমাধানের একটা পথ বের করি। বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে ঘানুচি সে প্রস্তাব ছিনিয়ে নিলেন। কথা বলতে দুই পক্ষই রাজি, কিন্তু বেজি সাইদকে জরুরি কাজে প্যারিসে যেতে হলো। ঘানুচি বললেন, ঠিক আছে, আমিও প্যারিসে যাব, দুজনের কথা সেখানেই হবে। সেই আলাপ-আলোচনার ফলই দাঁড়াল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে উভয়ের সম্মতি। ঘানুচি ও বেজি সাইদ দুজনেই তাঁদের ব্যক্তিগত ও দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে দেশের স্বার্থ দেখেছিলেন। সবাই যে তাঁদের প্রস্তাবিত ফর্মুলায় সম্মত ছিল, তা নয়। কিন্তু নিজের সমর্থকদের তাঁদের গৃহীত সমঝোতার যৌক্তিকতা বোঝাতে তাঁরা সক্ষম হন। তাঁদের ধীমান নেতৃত্বের ফলেই সম্ভবত বড় ধরনের বিপর্যয় এড়াতে পেরেছে তিউনিসিয়া। (সম্ভবত বলছি, কারণ আগামীকাল অবস্থা কী দাঁড়াবে, সে কথা হলফ করে বলা অসম্ভব। ভয় এখনো পুরোপুরি মিটে যায়নি)। তিউনিসিয়া যা পেরেছে তা হয়তো আমরাও পারতাম। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন এমন নেতা-নেত্রী, যাঁরা দেশটাকে নিজেদের ব্যক্তিগত ফুটবল ভেবে ইচ্ছামতো লাথি মারার বদলে তাকে নিজের মাতার মতো আগলে রাখবেন।
কবে, আরও কত দিন পরে এমন অসম্ভব সম্ভব হবে?
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.