ওয়ারশ সম্মেলন নিয়ে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা by অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম

আজ থেকে কোটি বছর আগে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বর্তমান সময়ের মতোই বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। বায়ুমণ্ডলে অধিক মাত্রার কার্বন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতির কারণে তখন বিশ্বের তাপমাত্রা বর্তমান সময়ের তুলনায় পাঁচ থেকে ১০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেশি ছিল। তখন বিশ্বে বিদ্যমান তাপমাত্রার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। অধিক উষ্ণতার কারণে এক সময় বিশ্বব্যাপী বরফের পরিমাণ ছিল খুবই কম। ওই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পৃথিবীতে কী ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিয়েছিল, সেসব নিয়ে ধারাবাহিক গবেষণা হওয়া দরকার। এতে ওই সময়ের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র পাওয়া যাবে। টেকসই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য কোটি বছর আগের সেসব তথ্যও বিস্তারিত জানা দরকার। জাতিসংঘের উদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোর মধ্যে কিয়োটো সম্মেলন ও কোপেনহেগেন সম্মেলন বিশ্ববাসীর যতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল অন্য সম্মেলনগুলো তা পারেনি। উল্লিখিত দুই সম্মেলনের বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনা ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরবর্তী সম্মেলনগুলোকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক প্রতিটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এসব সম্মেলন কাক্সিক্ষত মাত্রায় ফলপ্রসূ হচ্ছে না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনের অভিজ্ঞতা মনে রেখেই আগামীতে অনুষ্ঠেয় এ বিষয়ক সম্মেলনগুলো নিয়ে আশাবাদী হতে চাই। এসব সম্মেলনের পর তাৎক্ষণিক সুফল না মিললেও বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর আন্তঃসম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন, ফিচার ও প্রবন্ধে উল্লিখিত তথ্য বিশ্লেষণ করলে এটাই স্পষ্ট হয়, পোল্যান্ডের ওয়ারশে চলমান বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-১৯) থেকে তেমন বড় কোনো প্রাপ্তি মিলবে না। কিন্তু ওয়ারশ জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনা ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠেয় কপ-২১কে সফল করতে সহায়ক হবে। প্যারিসে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২১) প্রথম প্রস্তুতি সভাটি ১৭ জুন-২০১৩ প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাই প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন নিয়ে বিশ্ববাসী বিশেষভাবে আশাবাদী হতে শুরু করেছে। কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনের সময় আন্তর্জাতিক মিডিয়া বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যতটা সরব ছিল, বর্তমানে তা লক্ষ্য করা যায় না। এটা দুঃখজনক। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন সফল করার ক্ষেত্রে মিডিয়ার দায়িত্বশীল ভূমিকা অব্যাহত রাখতে হবে।
শিল্প বিপ্লবের পর থেকে শিল্প সমৃদ্ধ দেশগুলোর কলকারখানা থেকে বিপুল পরিমাণ দূষিত গ্যাস নির্গত হয়ে পরিস্থিতি কী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তা প্রতিনিয়ত আলোচিত হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনার অন্যতম লক্ষ্য শিল্প-কারখানা থেকে যে দূষণ নির্গত হয় তা ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসা। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে বিশ্ব সম্প্রদায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এমন প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে হবে যাতে কলকারখানা থেকে নির্গত দূষণ ন্যূনতম পর্যায়ে আনা সম্ভব হয়।
শিল্পোন্নত দেশগুলোর দায় স্বীকার করে ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। কিন্তু ক্ষতিপূরণ প্রদান নিয়ে নানা রকম জটিলতা সৃষ্টির বিষয়টি দুঃখজনক। আমরা লক্ষ্য করেছি, একেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নানামুখী আলোচনা শুরু হয়। এসব আলোচনা আবার দ্রুত থেমে যায়। বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার জন্য আরেকটি বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অপেক্ষা করতে হবে কেন? যেহেতু বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কার, তাই নতুন করে প্রকৃতির রুদ্র রূপ দেখার অপেক্ষা না করে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পেলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা বাড়বে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোও বহুমাত্রিক গবেষণায় মনোনিবেশ করতে পারবে, যেসব গবেষণার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর উপকৃত হওয়ার পথ সুগম হবে। ফিলিপাইনে টাইফুনের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও ওই ঘটনার দীর্ঘ সময় পরও ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হয়নি। দেশটিতে টাইফুন আঘাত হানার ৩৬ ঘণ্টা পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে টাইফুনের তাণ্ডবের যে চিত্রটি ফুটে উঠেছিল, এটা ছিল একেবারেই খণ্ডিত। হয়তো যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপর্যয়ই ছিল এর অন্যতম কারণ। টাইফুন আঘাত হানার প্রায় ৬০ ঘণ্টা পরই বিশ্ববাসী ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা পেল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ধ্বংসস্তূপের ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই- সেখানে এক সময় লাখো মানুষ বসবাস করত। নতুন করে যেন এ দৃশ্য আর দেখতে না হয় সেজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
২.
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাথমিক কারণ হিসেবে মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে চিহ্নিত করার পর শিল্পোন্নত দেশগুলোর উচিত ছিল গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু দুঃখজনক হল, বাস্তবে তা লক্ষ্য করা যায়নি। বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শিল্পোন্নত দেশগুলোতে কয়লার ব্যবহার কাক্সিক্ষত মাত্রায় কমেনি। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ করার বিষয়ে বিশ্বের সব দেশ বহুমুখী তৎপরতা অব্যাহত রাখার পরও বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েই চলেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, ১৮৮০ সালের তুলনায় বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই বেড়েছে ০.৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সম্প্রতি জাপানের পরমাণু চুল্লিতে দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন দেশ কয়লার ব্যবহার বাড়াতে যতটা আগ্রহ প্রকাশ করেছে, নিরাপদ জ্বালানি খাতে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ততটা মনোযোগী হয়েছে- এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। অথচ জাপানের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের দুর্ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী নিরাপদ জ্বালানি খাতে ব্যাপক পরিসরে গবেষণা শুরু হওয়া উচিত ছিল।
উন্নয়নশীল দেশগুলো কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে গ্রিন হাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণ না করেও বহুমুখী সংকটের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারছে না। বিদ্যমান বাস্তবতায় উন্নয়নশীল দেশগুলো আপাতত গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনে কৃচ্ছ্র পরিচয় দিলে কর্মসংস্থান কমবে যা প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় উন্নত দেশগুলোকে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে মনোযোগী হতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা সম্ভব হলেই গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন কমবে।
আমরা অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাশ্রয়ী মূল্যের প্রযুক্তি আবিষ্কারের কাজটি কঠিন। সেক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিশেষত এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থাৎ এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর উচ্চ প্রবৃদ্ধি যাতে অব্যাহত থাকে সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
গত কয়েক বছরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দূষণ কমানোর বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। সব দেশই এ বিষয়ে একমত হয়েছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের দূষণ ১৯৯০ সালের তুলনায় ৫০ শতাংশ কমাতে হবে। আমরা জেনেছি, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাবে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতাও বাড়বে। হাইয়ানের তাণ্ডবে ফিলিপাইনের একটি শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার একদিন আগেও আমরা কল্পনা করিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এত ভয়ংকর গতিতে আঘাত করতে পারে। টাইফুনের কারণে সৃষ্ট সুনামিতে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। হাইয়ানের তাণ্ডবে দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার প্রেক্ষাপটে গৃহহীন হয়েছে লাখো মানুষ। গণমাধ্যম কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত তথ্য দ্রুত জানতে পারেননি। দেশটিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে উদ্ধারকর্মীদের পৌঁছাতে দেরি হয়েছে। দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার পর আশ্রয় ও খাবারের সন্ধানে অনেকেই দিশাহারা হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশ থেকে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। সবার সহযোগিতায় একদিন ফিলিপাইনবাসী ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেন। কিন্তু ঝড়ের আঘাতে যারা স্বজন হারিয়েছেন, তাদের হৃদয়ের ক্ষত কি কখনও শুকাবে? বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এ রকম বা এর চেয়েও তীব্র মাত্রার ঝড় যে কোনো সময় যে কোনো দেশে আঘাত হানতে পারে। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
যে কোনো সামুদ্রিক ঝড়ের পর উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলও নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া সামুদ্রিক ঝড়ের কারণে উপকূলীয় এলাকার মাটির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বদলে যায়। এতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিসহ এসব বহুমুখী সমস্যা বাড়তে থাকবে। এতে হতদরিদ্র মানুষের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করবে।
যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর কিছু মানুষকে হিংস্র আচরণ করতে দেখা গেছে। আবার অভুক্ত মানুষকে নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে দেখা যায়। হাইয়ানের আঘাতের পর ফিলিপাইনেও তা লক্ষ্য করা গেছে। কাজেই যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্ববাসীকে দ্রুত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
হাইয়ানের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত এক মহিলা আন্তর্জাতিক এক গণমাধ্যমকে জানান, তিনি তার স্বামীকে হারিয়েছেন। তিনি জানেন না এখন তিনি কোথায় যাবেন। ওই মহিলা নিজেকে নিয়ে যতটা চিন্তিত তার চেয়ে বেশি চিন্তিত তার ছোট্ট সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। গণমাধ্যমে এখন হতাহতের সংখ্যা জানানো হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্তরা বেঁচে থাকার জন্য কী লড়াই করছে, কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে তাও বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু হাইয়ানের আঘাতে যেখানে একটি পুরো শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সেক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির চিত্র কখনোই জানা সম্ভব হবে না। যেখানে হতাহতের প্রাথমিক তথ্যের জন্য আমাদের প্রায় ৬০ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হল- এই দীর্ঘ সময়ে কত আহত ব্যক্তি সামান্য চিকিৎসার অভাবে প্রাণ হারিয়েছেন তা কি কখনও জানা যাবে? এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি অসহায়ভাবে প্রাণ হারায় শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিরা। হাইয়ানের আঘাতের কয়েক দিন পরও আমরা লক্ষ্য করি স্বজনদের খোঁজে মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়াচ্ছেন। তাদের এই আর্তনাদ কখন থামবে তা কি কেউ বলতে পারবে?
৩.
প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদারভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রতিশ্র“ত সাহায্য প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তখন ক্ষতিগ্রস্তদের ভোগান্তি বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র অনেক মানুষের ক্ষেত্রেও তা লক্ষ্য করা গেছে। তাই এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে তাদের প্রকৃত ক্ষতিপূরণ পায় সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
শিল্পোন্নত দেশগুলো দূষণের দায় স্বীকার করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হলেও ক্ষতিপূরণ প্রদান ও প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ, কোন দেশ কী হারে ক্ষতিপূরণ পাবে, ক্ষতিপূরণ প্রদানে কোন দেশ কতটা দায় নেবে- এ ধরনের অনেক বিষয় দ্রুত মীমাংসা হওয়া জরুরি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উল্লিখিত বিষয়ে আলোচনা খুব মন্থর গতিতে চলে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হতাশা বেড়েই চলেছে।
আমরা লক্ষ্য করেছি, ব্রিটেনের এক তরুণ সাংবাদিক জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত, তা জানার জন্য বাংলাদেশে দীর্ঘসময় অবস্থান করেছেন। তার এ আন্তরিকতার জন্য তিনি দেশে-বিদেশে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছেন। বাংলাদেশের গণমাধ্যম কর্মীদেরও এ ধরনের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে এবং এ তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে হতদরিদ্র মানুষের দুরবস্থার বিষয়টি বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হবে, যা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
৪.
জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক যে কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বর্তমানে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও প্রাপ্তির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়। সামুদ্রিক ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে শিল্পোন্নত কোনো দেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া আর স্বল্পোন্নত কোনো দেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি ভিন্ন। দুর্বল অবকাঠামোর কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে স্বল্পোন্নত দেশের হতদরিদ্র মানুষ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি আলোচনা হলেও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রকৃত ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি বারবার আলোচনায় এলেও অন্য অনেক ক্ষয়ক্ষতির দিক তেমন গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় আসে না। সিডরের আঘাতের পর সুন্দরবন আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবন এবং এর আশপাশের এলাকাটি আগের অবস্থায় ফিরে আসতে আরও অনেক সময় লাগবে। ওই এলাকার পরিবেশ পুরোপুরিভাবে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে কিনা তাও বলা যাচ্ছে না। কারণ সিডরের সময় জলোচ্ছ্বাসে যে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে, ওই এলাকার জীববৈচিত্র্যে যে পরিবর্তন এসেছে- এ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কতদিন লাগবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন ওই এলাকার পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদে কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে উচ্চপর্যায়ের গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্য মাছ-মাংস ক্রয় করতে পারে না। এসব দরিদ্র মানুষ প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে নদ-নদী-খাল-বিল-পুকুর এসব উৎসের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দরিদ্র মানুষের উল্লিখিত উৎস থেকে মাছ সংগ্রহের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় অনেক খাল-বিল বছরের বেশিরভাগ সময় পানিশূন্য থাকে। আবার অল্প সময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে উঁচু এলাকার পানিতে নিচু এলাকার মাঠ-ঘাট-পুকুর সব পানির নিচে তলিয়ে যায়। সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মিঠা পানির মাছের উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া সমুদ্রের পানি বেশি পরিমাণে নদী-নালায় প্রবেশ করার ফলে মিঠা পানির মাছের উৎপাদন কমে যায়। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের কারণে বিস্তীর্ণ এলাকা সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হওয়ায় পশুখাদ্যের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিরক্ষর। কিন্তু এই নিরক্ষর জনগোষ্ঠী বংশপরম্পরায় যে অভিজ্ঞতা ধারণ করে আছে তা অত্যন্ত মূল্যবান। অর্থাৎ তারা অগ্রজের কাছ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়ে থাকেন। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তথ্য ও অভিজ্ঞতার আলোকে একজন অশিক্ষিত কৃষক সফলভাবে শস্য উৎপাদন করতে সক্ষম হন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাধারণ কৃষকের হাজার বছরের অভিজ্ঞতা এখন আর কাজে লাগছে না। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত কিংবা হঠাৎ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে কী করণীয় তা তারা জানেন না। ফলে তারা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেন না। এ পরিস্থিতিতে কোনো কোনো কৃষক ন্যূনতম পরিমাণ ফসল ফলাতেও ব্যর্থ হন। এরই ধারাবাহিকতার এক পর্যায়ে তারা গৃহহীন হয়ে শহরে পাড়ি জমান। এই গৃহহীন মানুষের একটি বড় অংশ রাজধানীতে এসে আশ্রয় নেয়। রাজধানীতে আসা এসব মানুষ বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। এক পর্যায়ে এদেরই কেউ কেউ নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
সম্প্রতি কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে দেশে মাছের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। এছাড়া নিচু এলাকার জমিকে আবাদের আওতায় আনায় মাছের বিচরণ ক্ষেত্র অনেক কমেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন জাতের মুরগির উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে ডিম পাড়া মুরগির খামারের তাপমাত্রা বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাপমাত্রা নির্ধারিত মাত্রার তুলনায় কম-বেশি হলে ডিমের উৎপাদন কমে যায়। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে মুরগি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বড় খামারে তাপমাত্রা বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ছোট ছোট খামারে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে এসব খামারে ডিমের উৎপাদন কমে যায়। তাপমাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের খামারের মুরগি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বড় উদ্যোক্তাদের খামারে কোনো মুরগি রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেলে দ্রুত মৃত মুরগিকে স্থানান্তর করা হয় এবং ডাক্তারের নির্দেশমতো দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের খামারে মৃত মুরগিকে কোনো কোনো সময় আশপাশের নদী-নালায় ফেলা হয়। এতে পরিবেশ দূষিত হয়। মৃত মুরগির বিভিন্ন অঙ্গ মাছেরা খেয়ে থাকে। এসব মাছ খেলে মানবদেহে নানারকম সমস্যা সৃষ্টির আশংকা থেকে যায়। উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে এ রকম আরও কী কী সমস্যা সৃষ্টি হয়, সেসব চিহ্নিত করে সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সহিংসতাও বেড়ে যাচ্ছে। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, স্বাভাবিক মাত্রার বৃষ্টি না হলে যে কোনো এলাকার অর্থনৈতিক কাঠামো বদলে যায়। এতে সহিংসতা বাড়তে থাকে। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর ক্ষুধার্ত ও হতাশাগ্রস্ত মানুষকে নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। ক্ষুধার্ত মানুষ কতটা বেপরোয়া হতে পারে, ফিলিপাইনের ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় তা দেখা গেল। দেশটির ত্যাকলোবান শহরের নিকটবর্তী অন্য এক শহরে সম্প্রতি সরকারি চালের গুদামে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। অনুমান করা হচ্ছে, হামলাকারীরা ঘূর্ণিঝড়ে সর্বস্ব হারিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। হামলাকারীরা সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে এক লাখের বেশি চালের বস্তা লুট করে নিয়ে যায়। গুদাম লুটপাটের সময় গুদামের দেয়াল ধসে কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
উচ্চ তাপমাত্রা, খরা, হঠাৎ ভারি বৃষ্টিপাত- এসব কারণে দৃশ্যমান ক্ষয়ক্ষতির বাইরেও অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্প্রতি বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স (তড়কা) রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছিল। গবেষকরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট পরিবেশ তড়কা রোগের জীবাণুকে সক্রিয় হতে সহায়তা করে। এ বিষয়ক গবেষণাও অব্যাহত রাখতে হবে।
আমরা লক্ষ্য করেছি, জাতিসংঘের উদ্যোগে যখন জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন চলতে থাকে, তখন বিভিন্ন দেশ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে করণীয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরু করতে চায়। কিন্তু এসব আলোচনা এক সময় থেমে যায়। এ ধরনের আলোচনা যাতে সারা বছর অব্যাহত থাকে তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
হাইয়ানের আঘাতে ফিলিপাইনে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে এ ধরনের বা এর চেয়ে তীব্র মাত্রার ঝড় যে কোনো সময় যে কোনো দেশে আঘাত হানতে পারে।
৫.
গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক সম্মেলনের বাইরে ব্যাপক লেখালেখিও হয়েছে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী কয়লার ব্যবহার দ্রুত হারে কমবে এমনটা প্রত্যাশিত হলেও বাস্তবতা হল, এই সময়ে কয়লার ব্যবহার কমেনি। বরং গত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী কয়লার ব্যবহার ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০০৮ থেকে ২০১১ সালে কানাডায় কয়লার ব্যবহার কিছুটা কমলেও ওই সময়ে মেক্সিকোতে কয়লার ব্যবহার বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও দেশটিতে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ সালে এর ব্যবহার বেড়েছে। দেশটিতে ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে ধারাবাহিকভাবে কয়লার ব্যবহার কমলেও ২০১২ সালেও যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ কয়লা ব্যবহৃত হয়েছে। ব্রাজিলে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও দেশটিতে ২০০৯-এর তুলনায় ২০১০ ও ২০১১ সালে কয়লার ব্যবহার ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও ২০১২ সালে দেশটিতে বিপুল পরিমাণ কয়লা ব্যবহৃত হয়েছে। বেলজিয়ামে ২০০৮ সালে যে পরিমাণ কয়লা ব্যবহৃত হয়েছে, ২০১২ সালে এর অর্ধেকেরও কম কয়লা ব্যবহৃত হয়েছে। বুলগেরিয়ায় ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে কয়লা কম ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু ২০১২ সালে দেশটিতে ২০০৮ সালেরও বেশি কয়লা ব্যবহৃত হয়েছে। ডেনমার্কে ২০০৮ সালে যে পরিমাণ কয়লা ব্যবহৃত হয়েছে, ২০১২ সালে এর চেয়ে অনেক কম কয়লা ব্যবহৃত হয়েছে। ফ্রান্সে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও ২০০৯-এর তুলনায় ২০১০ সালে কয়লার ব্যবহার বেড়েছে। দেশটিতে ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে এর ব্যবহার বেড়েছে। জার্মানিতে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও দেশটিতে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে ধারাবাহিকভাবে কয়লার ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রিসে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে কয়লার ব্যবহার বেড়েছে। দেশটিতে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ ও ২০১২ সালে এর ব্যবহার বেড়েছে। আয়ারল্যান্ডে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ ও ২০১০ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও দেশটিতে ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ ও ২০১২ সালে এর ব্যবহার বেড়েছে। ইতালিতে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও দেশটিতে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে কয়লার ব্যবহার ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। নেদারল্যান্ডসে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ ও ২০১০ সালে কয়লার ব্যবহার বাড়লেও দেশটিতে ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ ও ২০১২ সালে এর ব্যবহার কমেছে। নরওয়েতে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও দেশটিতে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ সালে কয়লার ব্যবহার বেড়েছে; দেশটিতে ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ ও ২০১২ সালে এর ব্যবহার কমেছে। পোল্যান্ডে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ ও ২০১১ সালে এর ব্যবহার বেড়েছে। দেশটিতে ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে এর ব্যবহার কমেছে। স্পেনে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ ও ২০১০ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও দেশটিতে ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ ও ২০১২ সালে এর ব্যবহার বেড়েছে। সুইডেনে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও দেশটিতে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ ও ২০১১ সালে এর ব্যবহার বেড়েছে। দেশটিতে ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে এর ব্যবহার কমেছে। সুইজারল্যান্ডে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও দেশটিতে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ ও ২০১১ সালে এর ব্যবহার বেড়েছে। যুক্তরাজ্যে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও দেশটিতে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ সালে এর ব্যবহার বেড়েছে। দেশটিতে ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে এর ব্যবহার কমলেও ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে এর ব্যবহার বেড়েছে। রাশিয়ায় ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে কয়লার ব্যবহার কমলেও দেশটিতে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে এর ব্যবহার ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। উপরের আলোচনায় ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বিভিন্ন দেশে কয়লার ব্যবহার হ্রাস-বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছি। নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড ছাড়া উল্লিখিত বেশিরভাগ দেশেই ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বিপুল পরিমাণ কয়লা ব্যবহৃত হয়েছে। উল্লিখিত আলোচনা থেকে এটাই স্পষ্ট হয়, শিল্পোন্নত দেশগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বের পরিবেশ সুরক্ষার জন্য জোরালো প্রতিশ্র“তি দিলেও বাস্তবে তারা প্রতিশ্র“তি রক্ষায় কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছে না।
দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলো বিকল্প জ্বালানির ব্যবহারে সক্ষম না হলেও শিল্পোন্নত দেশগুলো বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে বিশ্বের পরিবেশ সুরক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোও যদি কয়লার মতো সাশ্রয়ী জ্বালানির ওপর নির্ভর করতে থাকে, তাহলে বিশ্বের পরিবেশ সুরক্ষার জন্য কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। স্বল্পোন্নত দেশগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই কয়লার মতো সাশ্রয়ী জ্বালানির ওপর নির্ভরতা অব্যাহত রাখতে চায়।
শিল্পোন্নত দেশগুলোর আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধি পেলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোও কয়লার পরিবর্তে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারে আগ্রহী হবে। এক্ষেত্রে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে উদারতার পরিচয় দিতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রযুক্তির গবেষণা প্রসারে শিল্পোন্নত দেশগুলো আন্তরিক হলে উল্লিখিত বিষয়ে অনেক জটিল সমস্যা সমাধানের পথ বিস্তৃত হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ধারাবাহিক আলোচনার পরও বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। শিল্পোন্নত দেশগুলো আন্তরিক না হলে এ বিষয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে বিলম্ব হবে। এর ফলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও বাড়তে থাকবে। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্বল্পোন্নত দেশের জনগণের ভোগান্তি বেড়ে যায়। তাই এদের জীবনমানের উন্নয়নে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুততম সময়ে ত্রাণ পৌঁছানো নিশ্চিত করার জন্য স্বেচ্ছাসেবী কর্মী বাহিনীও গড়ে তুলতে হবে। প্রতিশ্র“ত অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা প্রদানে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি খাতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। প্রযুক্তি খাতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তেল, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস- এসব সম্পদ এক সময় ফুরিয়ে যাবে। তাই বিকল্প জ্বালানির বিষয়ে এখনই ভাবতে হবে। পরমাণু প্রযুক্তিকে সাশ্রয়ী ও সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত প্রযুক্তিতে রূপান্তর করা গেলে স্বাভাবিকভাবেই কয়লার ওপর নির্ভরতা কমে যাবে। তাই এ বিষয়ক গবেষণার ওপর জোর দিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভোগান্তি বেড়েই চলেছে। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের পরিবর্তনে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই জনগোষ্ঠীর বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে, তাই শিক্ষার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। বয়স্ক জনগোষ্ঠীকেও এ কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশে সহায়ক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মও উপকৃত হবে। এভাবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। ওয়ারশ সম্মেলন যাতে গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে শেষ না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অবশ্য পালনীয় নীতিমালা প্রণয়নের কাজটি ওয়ারশ সম্মেলনেই সম্পন্ন করতে হবে। এ সম্মেলনে প্যারিস সম্মেলনের লক্ষ নির্ধারণসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাজও সম্পন্ন করতে হবে। বিশ্ববাসীর স্বার্থে ওয়ারশ সম্মেলনকে সফল করার জন্য সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। যেহেতু শিল্পোন্নত দেশগুলোর কর্মকাণ্ডের ফলে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে, তাই এ বিষয়ক বহুমুখী সংকট মোকাবেলায় শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ন্যায্য ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য জরুরি বিষয়ে ওয়ারশ সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সমঝোতায় পৌঁছাতে সক্ষম হবেন, এটাই বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম : প্রতিমন্ত্রী; সম্পাদক ও প্রকাশক, যুগান্তর

No comments

Powered by Blogger.