চূড়ান্ত আন্দোলনে আসছে ঢাকা ঘোষণা by কাফি কামাল

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনে প্রস্তুত বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল। আগামী ২৫শে অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপির সমাবেশেই হতে পারে চূড়ান্ত আন্দোলনের সূত্রপাত।
বিরোধী নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়া ঢাকা ঘোষণার মাধ্যমে রাজধানীসহ সারা দেশে একই দিনে ছড়িয়ে দেবেন আন্দোলনের বার্তা। চূড়ান্ত আন্দোলনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে এখন মরিয়া হয়ে কাজ করছেন বিরোধী দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল। বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের নেতারা জানান, ২৫শে অক্টোবরের ঢাকা ঘোষণায় কি কর্মসূচি আসছে তা কৌশলগত কারণে এখনই প্রকাশ হচ্ছে না । তবে চূড়ান্ত আন্দোলনের সব ধরনের কর্মসূচি ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১৮ দলের শীর্ষ নেতৃত্ব খালেদা জিয়াকে তাৎক্ষণিক যে কোন ধরনের কর্মসূচি নির্ধারণ ও ঘোষণার দায়িত্বও দিয়েছে। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। তবে সম্ভাব্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ঢাকা ঘেরাও, রেল-সড়ক ও নৌপথ অবরোধের মাধ্যমে সারা দেশকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া, স্বেচ্ছাকারাবরণ, লাগাতার হরতাল ও অসহযোগসহ নতুন কিছু কর্মসুচি। এদিকে নিয়ম মেনে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্ভাব্য ৩টি স্পটে সমাবেশের অনুমতি চাওয়া হলেও একই দিন পাল্টা সমাবেশের ডাক দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সরকার দলীয় রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে, ২৫শে অক্টোবর সমাবেশের অনুমতি পাবে না বিএনপি। কিন্তু ২৫শে অক্টোবর যে কোন মূল্যে সমাবেশ করতে বদ্ধপরিকর বিরোধী দল। বিএনপিসহ প্রতিটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ইতিমধ্যে আলাদা যৌথ ও জরুরি সভার মাধ্যমে প্রস্তুতি নিয়েছে। গতকালও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকার সভাপতিত্বে মহানগর বিএনপির যৌথসভা হয়েছে নয়া পল্টনে। সমাবেশ সফল করতে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব জোটের শরিক দল, বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকে সর্বাত্মক প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছে। ঢাকা সমাবেশ সফল করতে এবার ঢাকা মহানগর বিএনপি ও অঙ্গদলকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন খালেদা জিয়া। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী ৬ জেলার নেতাকর্মীদের ঢাকা সমাবেশে অংশগ্রহণ এবং কোন বাধার সৃষ্টি হলে রাজধানীর প্রতিটি প্রবেশমুখ বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই সঙ্গে ২৫শে অক্টোবর ঢাকার পাশাপাশি প্রতিটি জেলা শহরে সমাবেশের নির্দেশ, যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসূচি ঘোষণার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাসহ নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার অনুমতি দিক না দিক চূড়ান্ত আন্দোলনের সময়ে এসে আমাদের আর পিছু হটার সুযোগ নেই। যে কোন পরিস্থিতিতে এ সমাবেশ করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল। শনিবার রাজধানীতে ২৪তম বাটেক্সপো ২০১৩-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আগামী ২৫শে অক্টোবর ঢাকার জনসভা থেকে বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। কর্মসূচি দেয়া ছাড়া আমাদের আর ভিন্ন কোন পথ নেই। ২৫শে অক্টোবর কোন বিশৃঙ্খলা হলে তার দায়ভার সরকারকেই বহন করতে হবে। তবে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে ড. মোশাররফ বলেছেন, আমরা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই, শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করবো। কর্মসূচির কারণে যাতে পোশাক শিল্পের ক্ষতি না হয় সেদিকে আমরা খেয়াল রাখবো। বর্তমান সরকারকে স্বৈরাচারী আখ্যায়িত করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেছেন- স্বৈরাচার কখনও আপস করে না, আলোচনাও করে না। স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে হয়। এ সরকারেরও পতন ঘটাতে হবে। এদিকে পরিস্থিতি বিবেচনায় বরিশাল সমাবেশ স্থগিত করা হয়েছে। এদিকে বিরোধী দলের অভিযোগ করেছে চূড়ান্ত আন্দোলন দমাতে সারা দেশে বিরোধী নেতাদের বাসাবাড়িতে সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হানা দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে ১৮ দলীয় জোটের শরিক ইসলামিক পার্টির সভাপতি এডভোকেট আবদুল মুবিনকে তার কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মশিউর রহমান ও ঢাকা মহানগর বিএনপির বেশ কয়েকজন যুগ্ম আহ্বায়কের বাসায় হানা দিয়েছে পুলিশ। বিরোধী দলের একাধিক নেতা জানান, সারা দেশে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ‘ঈদের পর গণগ্রেপ্তার করা হবে’ একটি গুঞ্জন ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সরকারের তরফে। এদিকে রোববার বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ অভিযোগ করে বলেছেন, সারা দেশে বিরোধী দলের আন্দোলন দমনে টর্চার সেল গঠন করার খবর পাওয়া যাচ্ছে, এটি কিলিং স্কোয়াডে পরিণত করা হবে বলে আলোচনা আছে। দলীয় সূত্রে জানাগেছে, নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এদিকে বিএনপি সূত্র জানায়, আগামী ২৪শে অক্টোবরের আগে জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার পুনর্বহাল বা নির্বাচনকালীন কোন নিরপেক্ষ সরকার গঠনে সরকার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিলে ২৫শে অক্টোবর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে সে প্রস্তাবে সাড়া দেবে বিরোধী দল। আগামী ২০শে অক্টোবর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠেয় সম্মিলিত পেশাজীবী সমাবেশ থেকে সরকারের প্রতি শেষ আহ্বান জানাবেন বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া। এক বছর ধরে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে জনমত গঠনের মাধ্যমে আন্দোলন এগিয়ে নিলেও সরকার বিরোধী দলের দাবির ন্যূনতম তোয়াক্কা করেনি। কূটনীতিক মহল, সুশীল সমাজসহ সব মহল থেকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পরামর্শও আমলে নেয়নি সরকার। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বিরোধী দল ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও সেটাকে দুর্বলতা হিসেবে আচরণ করেছে সরকারি দল। এমন পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের বিকল্প দেখছেন না বিরোধী নেতারা। ওদিকে নির্দলীয় সরকারের চূড়ান্ত আন্দোলন বেগবান ও একদলীয় নির্বাচন প্রতিহত করতে সারা দেশে সর্বদলীয় প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটি গঠনের কার্যক্রম চলছে জোরেশোরে। ৫ই অক্টোবর সিলেট সমাবেশে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠনের আহ্বান জানান বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া। পরদিন ৬ই অক্টোবর মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দাশের বাজার হাইস্কুল ভোট কেন্দ্রেই সারা দেশে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। প্রধান অতিথি বিএনপি দলীয় মহিলা এমপি শাম্মী আক্তার উপস্থিত থেকে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি তৈমুজ আলীকে আহ্বায়ক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটি গঠন করেন। গত ৭ই অক্টোবর রাতে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে খালেদা জিয়া বৈঠক করে ৯ই অক্টোবর সারাদেশে জেলা ও মহানগর নেতৃত্বের কাছে শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে নির্দেশনামূলক একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে, একদলীয় নির্বাচন প্রতিহত করতে সারা দেশে ২৪শে অক্টোবরের মধ্যেই প্রতিটি ভোটকেন্দ্র ভিত্তিক ‘একদলীয় নির্বাচন প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে কেন্দ্রীয় দপ্তরে তালিকা পাঠানোর নির্দেশও দেয়া হয়েছে। দলীয় সূত্র জানায়, প্রতিটি এলাকার ১৮দলীয় নেতৃবৃন্দ, আন্দোলন ইস্যুতে সমমনা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পেশাজীবীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সে কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। ওদিকে খালেদা জিয়ার আহ্বানের পর জোটের শরিক দলগুলো তাদের প্রতিটি ইউনিটে সে কমিটিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে আন্দোলনের অংশগ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক শরিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা। ইতিমধ্যে খুলনাসহ একাধিক জেলায় কমিটি গঠন সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ২৪শে অক্টোবরের মধ্যেই সারা দেশের কেন্দ্রভিত্তিক এ কমিটি গঠন সম্পন্ন এবং ২৭শে অক্টোবর থেকে ‘সংগ্রাম কমিটির’ কার্যক্রম দেখতে পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ। আগে থেকেই বিরোধীদলীয় নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন সরকার একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কলাকৌশল করছে। তারা বিরোধী দলকে নির্বাচনে চায় না বলেই সমঝোতামূলক কোন উদ্যোগই নিচ্ছে না। এদিকে দুই প্রধান দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে সঙ্কটের আশঙ্কা দেখা দিলেও রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য অপেক্ষা না করে দশম সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন। সর্বশেষ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ঘোষণার পর নতুন মোড় নিয়েছে পরিস্থিতি। সিইসি বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী, আগামী ২৫শে অক্টোবর থেকে ২৪শে জানুয়ারির মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচন হবে। এ সময়ে বর্তমান সরকারই ক্ষমতায় থাকবে, বহাল থাকবে সংসদও। আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। যথাসময় সম্ভব সময়মতো এটা (তফসিল) ঘোষণা করবো। নির্বাচনে যাতে জনগণের কোন অসুবিধা না হয়, ভয়-ভীতিতে পড়তে না হয় সেজন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো। সিইসির এমন ঘোষণার পর একদলীয় নির্বাচনের ব্যাপারে নড়েচড়ে বসেছে বিরোধী দল। এদিকে একদলীয় নির্বাচন প্রতিহত করতে কেন্দ্রে কেন্দ্রে পাহারা বসানোর ঘোষণা দিয়েছে যুবদল। যুবদলের সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, নির্বাচনের অপচেষ্টা করলে তা প্রতিহত করতে সারা দেশের ভোট কেন্দ্রে কেন্দ্রে পাহারা বসাবে যুবদল। বিএনপির এ অঙ্গ-সংগঠনের সাংগঠনিক শক্তিই নির্বাচন প্রতিহতের জন্য যথেষ্ট। শুধু বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চূড়ান্ত নির্দেশের প্রয়োজন। বিএনপি নেতাদের আত্মবিশ্বাসের নিয়ে বলছেন, বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতিতে নির্দলীয় সরকার ইস্যুতে সমর্থনকারী দুই জোটের বাইরের সমমনা রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, সুশীল সমাজ, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ সাধারণ মানুষ তাদের পাশে থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.