কোথায় চলেছি? by বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

সংবিধানের নির্দেশ অনুসারে আর খুব একটা বেশি সময় নেই। বড় জোর ৭-৮ দিন। তারপর মহাজোটের এ যাত্রায় শেষ। ২৪শে অক্টোবর নির্ধারিত সময়। ২৪শে অক্টোবর সংসদ ভেঙে গেলে ২৪শে বা ২৫শে জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচনী সময়।
২৪শে অক্টোবর থেকে ২৪শে জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন না হলে এ সরকার অবৈধ। সংবিধানের নির্দেশমতো অবশ্যই ২৫শে জানুয়ারি পর্যন্ত নিশ্চয়ই তারা থাকতে পারেন। কিন্তু তারপর এক মুহূর্তও সংসদ এবং সরকারের বৈধতা থাকে না। অনেক পণ্ডিত বলছেন, সংসদ থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে। এ রকম গোঁজামিলের মনোভাবে আর যা কিছু হোক কোন রাষ্ট্র চলতে পারে না। প্রতি মুহূর্তে মানুষ বড় শঙ্কায় কাটাচ্ছে। সংবিধান বলে জনগণ দেশের মালিক কিন্তু প্রকৃত মালিক এখন আর জনগণ নয়। মালিকের কর্তৃত্বে সেবকরা চালাচ্ছে। সেবকরূপী দখলদারদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ছাড়া কিছুই চলে না। সবক্ষেত্রে কর্মচারীরাই যেন সর্বেসর্বা মালিক মোক্তার। আগেকার দিনে রাজা-বাদশারাও এমন দায়িত্বহীন একরোখা ছিলেন না। সব যেন জমিদারি স্টাইল। জনগণ একেবারেই বেপাত্তা। শঙ্কায় শঙ্কায় মানুষের জীবন শেষ। রাস্তাঘাটে যানজটের ঠেলায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। ১ ঘণ্টার পথ ১০ ঘণ্টায় পাড়ি দিতে হচ্ছে। এ অসহনীয় অবস্থার হাত থেকে কবে মানুষ মুক্তি পাবে কেউ জানে না। চারদিকে অন্ধকার, তার মধ্যে আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বদলের অনিশ্চয়তা। কারও সামান্য একটু স্বস্তিতে শ্বাস নেয়ার পথ নেই। ১ ঘণ্টার পথ ১০ ঘণ্টায় যাতায়াতে বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা ৭-৮ গুণ জ্বালানি খরচ হচ্ছে, পরিবশ দূষণ হচ্ছে, তাতে নানা রকমের রোগ-বালাইয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। যাদের দেখার দায়িত্ব তারা বেপরোয়া নির্বিকার। নিজেদের সন্তান সন্ততি বিদেশে রেখে তারা আয়েশ করছেন, কোন ভাবনা নেই। এ রকম অবস্থায় এবারের ঈদুল আজহা কত শ’ শ’ হাজার হাজার কিংবা কত লাখ পশু কোরবানি হবে জানি না। কিন্তু আমরা মানব সমাজ, আমাদের ভিতরের জিঘাংসা পশুত্ব কতটা কোরবানি দেবো বা দিতে পারবো? কতটা কোরবানি আল্লাহর রাস্তায় তার রাজি খুশির জন্য হবে, আর বিত্তশালীরা কতটা দেখাবার জন্যে দেবে, সেটা দয়াল মাবুদই জানেন। অন্যকে দেখিয়ে নিজে বড় হওয়ার বড় বিশ্রী দৃষ্টিকটু প্রতিযোগিতা চলছে দিবানিশি। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কোন ক্ষেত্রে সুস্থতা নেই। এক অশুভ অসুস্থ প্রতিযোগিতা জাতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কেমন যেন কেহ কারে নাহি হারে সমানে সমান। দেশবাসী অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে গঠিত সংসদের মাধ্যমে সরকার চান। কিন্তু বর্তমান সরকার তাদের অধীনে তথাকথিত নির্বাচনী নাটক করে ক্ষমতায় থাকতে চান। কিছু কিছু নেতা কলের গানের মতো বলে চলেছেন, সংবিধান অনুসারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন হবে। কেন হবে? বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর কাছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা, নিরপেক্ষতা বহু আগেই হারিয়ে ফেলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কোন মন্ত্রীর ওপর আস্থা না থাকলে যেমন তার মন্ত্রীত্ব থাকে না, তেমনি দেশবাসীর প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা না থাকলে তার মন্ত্রীত্ব থাকে কি করে? সরকারের প্রতি আস্থা অনাস্থা নিয়ে একটি গণভোট হোক, দেখুন ক’টা ভোট পান। বর্তমান সরকারের মতো এমন অপ্রিয় সরকার পৃথিবী সৃষ্টির পর আর কেউ কোনদিন দেখেনি। তবু তারা বলে চলেছেন তারাই প্রিয়। জাতিসংঘের ৬৮তম অধিবেশনে ১৪০ জন তামিশগীর নিয়ে সরকারি অর্থের শ্রাদ্ধ করেছেন, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একটি রাষ্ট্র জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সর্বমোট ৬ জন থেকে ৮ জন প্রতিনিধি নিতে পারে। কোথাকার কোন মুদির দোকানি সে-ও প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী! প্রতিটি লোকের জন্যে কমবেশি ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কে যোগায় এ অর্থ? গালি ধরা ঘুড়ির মতো সরকার বলে চলেছে, তারা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দিচ্ছে। বর্তমান সরকার যে উন্নয়নের কথা বলছে দেশের মানুষের মনে শান্তি ও ফুর্তি থাকলে সরকার লাগতো না। বিশ্বায়নের যুগে দেশের বুদ্ধিমান নাগরিকরাই যার যার মতো করে উন্নয়ন করতে পারতো। ৮০-৯০ লাখ মানুষ প্রবাসে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে প্রতিনিয়ত টাকা পাঠাচ্ছে। সে টাকায় পোদ্দারি করে সরকার উন্নয়নের ঢোল পেটায়। এসব আর কত কাল চলবে? বিদেশের কর্মজীবী বন্ধুরা যদি প্রতিদিন টাকা না পাঠাতো তাহলে শহর ও গ্রামের অর্থনৈতিক বৈষম্য যে পরিমাণ তাতে গ্রামে মন্বন্তর দেখা দিতো। রাষ্ট্রীয় বাজেটের যে অর্থ শহর-বন্দরে খরচ হয় তার ১০ ভাগের এক ভাগও গ্রামে খরচ হয় না। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, নিয়ন বাতি- এসবের জন্যে যে অর্থ খরচ হয়েছে, ওই পরিমাণ অর্থ দিয়ে ১০ হাজার গ্রামের রাস্তাঘাট স্কুল মাদরাসার উন্নয়ন করা যেতো। কিন্তু তা করা হয়নি। কেন হয়নি? সরকারের উচ্চস্তরে গ্রামীণ মানুষের প্রভাব নেই। রাজনীতিতে গ্রামনির্ভর নেতা নেই, সংগঠন নেই। হুজুর মওলানা ভাসানী মরে যাওয়ার পর গ্রামীণ সমাজের দাবি তুলে ধরার মতো কোন নেতৃত্ব নেই। যাদের রক্তঘামে বাংলাদেশ, সেই কৃষক, সেই শ্রমিক আজ সব থেকে বেশি বঞ্চিত, অবহেলিত। যে ছাত্র যুবক দেশের জন্যে সর্বস্ব ত্যাগ করেছে, সমাজপতিরা সুকৌশলে তাদের অস্তিত্বহীন করে দিতে চাইছে। আগে যে ছাত্রকে সাধারণ মানুষ দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরতো আজ তাদের টেন্ডারবাজ, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ সাজিয়ে সমাজের নিচে ফেলে দেয়া হয়েছে। ছাত্র যুবকরা চরিত্রবান থাকলে মেধাহীন অযোগ্যরা সমাজপতি থাকতেন না। সেজন্য চরিত্রবানের চরিত্রহনন হচ্ছে বর্তমান সমাজপতিদের প্রধান কাজ। তা তারা বেশ সফলতার সঙ্গে করে চলেছেন। আমাদের কোমলপ্রাণ ছাত্র যুবক বন্ধুরা খুব তাড়াতাড়ি একটা কিছু হয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে মরীচিকার পিছে ছুটছে। স্বাভাবিক বিকাশ বা স্বাভাবিক বর্ধনের লেশমাত্র নেই। কেমন যেন এক অস্থিরতা, সবাই রাতারাতি বড় হতে চায় বা একটা কিছু হয়ে যেতে চায়। কোন মা-বাবা তার ছেলেমেয়ে বিয়ে দিয়ে দাদা-দাদী হতে চাইলে কিছুটা সময় যে অপেক্ষা করতে হয়, তা-ও মনে হয় ভুলে গেছে। অপেক্ষা না করলে চলবে কি করে। কেন যেন কেউ কোন সময় দিতে চায় না, ধৈর্য রাখতে চায় না, এক অবাক কাণ্ড।
৯ই অক্টোবর রংপুরের এক আদালত জনাব আশিকুর রহমানের মানহানি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তার মান আছে তাই তিনি মানহানির মামলা করেছেন। তিনি যদি আওয়ামী লীগে না থেকে বিএনপি, জামায়াত অথবা জাতীয় পার্টিতে থাকতেন তাহলে পাকিস্তানের সেবাদাস হিসেবে তার এখন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার হতো। আমি শুধু বলেছি, পাকিস্তানকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের পক্ষে অস্ত্র ধরেছিলাম। আর তিনি তখনও পাকিস্তানের অনুগত একজন সিএসপি ছিলেন। তারাই আর্জিতে বলেছেন, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসে টাঙ্গাইলের ডিসির দায়িত্ব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। এমন বেকুব গাছে ধরে? পাকিস্তানের কর্মচারী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নিতে পারেন? তাহলে এখনকার সরকারি কর্মচারীরা যদি বিরোধী দলের পক্ষ নেয় তাহলে দোষ কোথায়? এখন তো স্বাভাবিক সময়, তখন তো তা ছিল না। তা-ও কোন কর্মচারীর সঙ্গে বিরোধীদের যোগাযোগ আছে জানতে পারলে তখনই তাকে ঘাড় ধরে বের করে দেবে। আর যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের কাছে হত্যা ছিল ডাল-ভাত। সে সময় কোন বাঙালি দালালের বুকের পাটা ছিল না যে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। হ্যাঁ, সেটা করেছে গ্রামগঞ্জের হতদরিদ্র সাধারণ মানুষ। পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে যে সমস্ত দালাল হানাদারদের ছায়া হয়ে কাজ করেছে তাদের পক্ষ নিয়ে তথাকথিত আওয়ামী লীগের কোন লোক কথা বলতে পারে- এটা কখনও ভাবিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ায় একটু সাহসী হয়ে কথাটি বলেছিলাম। রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি তো বেসরকারি, অস্থায়ী দালাল। কিন্তু একাত্তরে কর্মরত সিএসপিরা সরকারি তালিকাভুক্ত হানাদারদের আজ্ঞাবহ স্থায়ী দালাল- খাতাপত্র বের করলেই তা দেখা যাবে। পাকিস্তানের পূর্ব অংশে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ডিসি, এডিসি, ম্যাজিস্ট্রেটদের ওপর। তারা গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছেন। এজন্যে পাকিস্তান হানাদারদের কাছে তারা প্রশংসাও পেয়েছে। কত বাঙালি অফিসারকে সন্দেহ করে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানি হানাদাররা। বিখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদের পিতা এসডিপিও ছিলেন, মহকুমা পুলিশ অফিসার। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি কর্মস্থল ত্যাগ না করে সেখানেই ছিলেন। পাকিস্তান প্রশাসনের একজন এসডিপিও-র দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার কর্মস্থলে যখন হানাদাররা যায় দু’চার দিন পর তাকে জিজ্ঞেস করে তোমার কুওতের অস্ত্র কই, এটা কই, ওটা কই? তুমি বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়ে দিয়েছো, গোপনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছো- এসব অভিযোগ এনে নিষ্ঠুরভাবে তাকে মেরে ফেলে। কই তার চাইতেও এক দুই পদ উপরে থাকার পরও আশিকুর রহমানকে তো মারেনি? তিনি তো হানাদারদের বিশ্বস্তই ছিলেন। ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে করে, স্বাধীনতার ৪২-৪৩ বছর পর যখন কোন বাঙালি বলে পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছে। এ কেমন উন্মাদ? আমরা পরাজিত হলে বঙ্গবন্ধুর যেমন ফাঁসি হতো, আমাকেও তার সঙ্গী হতে হতো। কিন্তু আশিকুর রহমান ভাল ডিউটি করার জন্যে প্রমোশন পেতেন। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হন বা না হন, চাকরি শেষে প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হতেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানি দালালরা হয় নন্দিত আর মুক্তিযোদ্ধারা নিন্দিত। এটাই আওয়ামী সরকারের বড় সফলতা! আমার নামে অভিযোগ আমি বঙ্গবন্ধুকে রাজাকার কমান্ডার বলেছি। আমি তা বলতে যাবো কেন? আমি বলেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অস্ত্র ধরেছিলাম, তার অনুরোধে স্বাধীনতার পর তারই পায়ের নিচে সমস্ত অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছি। বঙ্গবন্ধু আমার নেতা, আমার কমান্ডার। আমি রাজাকার হলে বঙ্গবন্ধু রাজাকার কমান্ডার- এটা তো আকাশ বাতাস চন্দ্র সূর্যের মতো ধ্রুব সত্য। আমার কমান্ডার তো গোলাম আজম নয়। আমার কমান্ডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই আমি মুক্তিযোদ্ধা হলে মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার, রাজাকার হলে রাজাকারের কমান্ডার। বঙ্গবন্ধু যে আমার নেতা, আমার ভালবাসা, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য- এটা আজ আওয়ামী লীগের কারও সার্টিফিকেট নিয়ে প্রমাণ করতে হবে না। আরও অভিযোগ, আমি নাকি সরকারের সমালোচনা করে লিখেছি, জননেত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অশালীন লেখা লিখেছি। যারা অভিযোগ করেছেন তাদের চেয়ে অনেক বেশি শালীনতাবোধ আমার আছে। দেশবাসী তা ভাল করেই জানেন। সংসদে যেসব ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে লেখার অঙ্গহানি হয় তবুও ওসব অরুচিকর শব্দ আমার লেখায় ব্যবহার করতে পারিনি। অভিযোগকারীরা কোনটা রুচি, কোনটা অরুচি তা উল্লেখ করেননি। পাকিস্তানি আজ্ঞাবহদের মানহানির অভিযোগে একজন মুক্তিযোদ্ধার নামে মাননীয় আদালত গ্রেপ্তার পরোয়ানা জারি করেছে। আমি খুশি হয়েছি। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকরী করা যে কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব তারা যথাসময়ে সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আমি তাদের নামে আদালত অবমাননা ও অবজ্ঞার অভিযোগে মামলা করবো। তাই সরকার এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালনে অনুরোধ জানাচ্ছি। অন্য  জায়গায় যতই ফাঁকি দেন, এক্ষেত্রে ফাঁকি দেয়ার কোন সুযোগ নেই। ফাঁকি দিতে গেলে কি কঠিন বিপদে পড়বেন তা তারা চিন্তাও করতে পারবেন না।
এখন যখন যেখানেই যাই সবার একই প্রশ্ন, সরকার কিসের জোরে গণদাবি এভাবে উপেক্ষা করছে? তাদের কি আর বলবো, মাঝেসাঝে বলার চেষ্টা করি, খোঁটার জোরে পাঁঠা কোঁদে। কিন্তু বলতে পারি না খোঁটা কোথায়? অনেকেই মনে করেন ভারতই মহাজোটের প্রধান খোঁটা। তালেবানদের কারণে আমেরিকা খোঁটা, সেনাবাহিনী আরেক খোঁটা। কিন্তু কেন যেন আমার তেমন মনে হয় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনেক আগে থেকে ভারতকে চিনি। সত্যি কথা বলতে ভারত কারও নয়, মহান ভারত শুধুই ভারতের। নিজের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ত্যাগ করে ভারত এক পা-ও নড়ে না। আমি যতটুকু জানি, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে অসন্তুষ্ট করে ভারত কারও পক্ষ নিতে যাবে না, কোনদিন নেয়ওনি। পছন্দ অপছন্দের জন্যে একটু আধটু সহযোগিতা সমর্থন করতেই পারে। কিন্তু দেশের সব মানুষের অসন্তুষ্টি মাথায় নিয়ে মহান ভারত পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরু অথবা মহাত্মা গান্ধীর পিছনেও দাঁড়াতো না। বাংলাদেশের কোন নেতানেত্রীর পিছনে দাঁড়ানোর তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমেরিকার সঙ্গে মহাজোটের সম্পর্ক কই? সাদা চোখে তো আমি তেমন দেখতে পাই না। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে তিনি কথা বলেন না, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসকে যেভাবে খোঁচাচ্ছেন তাতে আমেরিকার বড় রকমের সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনা কোথায়? এখন থাকলো দারোগা পুলিশ, সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী। পুলিশদের রাস্তাঘাটে দাঙ্গা হাঙ্গামা মোকাবিলা করতে হয়, তাতে কখনও সখনও মনে হয় তারা জনতার সামনাসামনি, দেশবাসীর প্রতিপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ দেশবাসীর প্রতিপক্ষ নন। তারা আমাদের সন্তান-সন্ততি, বেটা-ভাইপো। দলকানা সরকারের অনেক নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তাদের কখনও সখনও অপ্রিয় হতে হয়। কিন্তু সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী কখনও দেশবাসীর মুখোমুখি হয়নি। ভবিষ্যতেও কোন শাসক আমাদের এ দেশপ্রেমী নিবেদিত সন্তানদের তাদের বাপ-চাচা, ভাই-বোনদের মুখোমুখি করতে পারবে না। যদি তেমন হতো, নব্বইয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের সময়ই হতো। তখন সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল নুরুদ্দীন। নভেম্বর-ডিসেম্বরে যখন জনতা উত্তাল হয়ে ওঠে তখন তা মোকাবিলা করতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাস্তায় নামতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকে। জেনারেল নুরুদ্দীন ‘বাবা’ বলে ডাকতেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও তাকে খুব বিশ্বাস করতেন, ভালবাসতেন। কিন্তু সেদিন প্রধান সেনাপতি নুরুদ্দীন সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, জনতার সামনে দাঁড়ানো আমাদের কাজ নয়। জনগণের সমর্থন পক্ষে রাখা আপনার কাজ। আপনার প্রতি জনগণের সমর্থন থাকলে আমাদের সমর্থন থাকবে। আপনার পক্ষে জনসমর্থন আদায়ের জন্যে আমরা রক্তারক্তি করতে পারি না। এ কারণে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এখনও জেনারেল নুরুদ্দীনের সঙ্গে কথা বলেন না। সেদিন মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মেয়ের আংটি বদলের অনুষ্ঠানে সোনারগাঁও হোটেলের বলরুমে দেখেছি, ড. কামাল হোসেন আর জেনারেল নুরুদ্দীন বসেছিলেন এক টেবিলে। পরে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস অংশ নেন। আমি যখন যাই তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যে টেবিলে ছিলেন তার বামে সাবেক এফবিসিসিআই-র সভাপতি এ কে আজাদ ছিলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নব্বইয়ের সেদিন অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ করেছিলেন। জনগণ পক্ষে নেই, রাজনৈতিক দল পক্ষে নেই, সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতায় রাখতে পাশে দাঁড়াবে না- এটা বুঝতে পেরে পদত্যাগ করেছিলেন। এই উপমহাদেশের আর কোন সেনাশাসক ক্ষমতা থেকে পড়ে তার মতো সরাসরি ভোটে আর নির্বাচিত হননি। তিনি যে ক’বার যে ক’টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, প্রত্যেকটিতে জনগণ তাকে জয়ী করেছে। তার অনেক কিছুই সাধারণ মানুষের পছন্দ নয়। অনেকেই তার সকাল বিকাল ধরতে পারে না, তবুও রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন প্রয়োজনীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিন্দা প্রশংসা নিয়ে এখনও তিনি বিচরণ করছেন তা সেই নব্বইয়ে রক্তপাত না ঘটিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে আসার কারণে, অন্য কোন কারণে নয়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট আমাদের সেনাবাহিনী গণসমর্থনহীন কোন শাসকের জন্যে দেশবাসীর বুকে বন্দুক ধরবে না, ধরতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.