ঈদ বাজারের অর্থনীতি by ড. আর এম দেবনাথ

পবিত্র রমজান মাস শেষ হতে চলেছে। ঢাকার বাজারগুলোয় উপচেপড়া ভিড়। যেখানেই শপিংমল অথবা হকার্স মার্কেট, সেখানেই অসহনীয় যানজট। যানজট ঢাকার নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু রোজার বাজার উপলক্ষে এই যানজটের বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য ভিন্ন রকমের। এতে রাগ হয় আবার আনন্দও হয়। রাগানন্দ মিশ্রিত এই যানজট ও শপিংয়ের স্বাদই আলাদা। ইফতারের পর শপিং চলে গভীর রাত পর্যন্ত। ভারি মজার। স্বাধীনতার আগে এসব ছিল না। ছিল না ১০ বছর আগেও। এখন প্রয়োজনে হচ্ছে। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী, মধ্য বয়স্ক পুরুষ-মহিলা ও শিশুদের মিলনমেলা এখন শপিং কমপ্লেক্সগুলো। আমার ভাবতেই ভীষণ আনন্দ হয়। গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম ‘বসুন্ধরা সিটিতে’। শপিং নয়, ঘড়ি সারাতে। গাড়ি রাখার জায়গা নেই। শপাররা গিজগিজ করছে। কত রকমের দোকান, পসরা। আমার অনুমানের বাইরে। সব আধুনিক জমানার বস্তু। আমি পুরনো জমানার লোক। আমার কাছে এসব বিস্ময়, অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। আমি লিখি অর্থনীতির ওপর- বরাবর। লিখি দেশে ছয় কোটি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে। তারা দুই বেলা ভাত পায় না। দেখা যাচ্ছে এর পাশাপাশিই রয়েছে একটি ভিন্ন জগৎ। মধ্যবিত্ত, নিুমধ্যবিত্তের জগৎ। ২০ শতাংশ ধরে হিসাব করলেও তিন কোটি লোক হয় যারা মধ্যবিত্ত- শহরবাসী, বিভাগীয় শহরবাসী, উপজেলা শহরবাসী, জেলা শহরের বাসিন্দা। অনেক দেশের মোট লোকসংখ্যাই তিন কোটির কম। এ অবস্থায় তিন কোটি লোক মধ্যবিত্ত- খেলা কথা নয়। এরা সবাই বাজারের অংশীদার। এরাই ‘শপার’- মলে মলে, বাজারে বাজারে এরাই যায়। আবার রয়েছে নিুবিত্ত তথা গরিব মানুষ- এমনকি গ্রামে।
গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম দেশের বাড়িতে। দেখলাম যেখানেই বাস স্টপেজ, সেখানেই একটা বাজার। ফলমূলের দোকান আছে, চা-বিস্কুটের দোকান আছে। জামাকাপড়, জুতা, শাকসবজি থেকে শুরু করে সব ধরনের দোকান। চারদিকে শুধু দোকান আর দোকান। কটিয়াদী কিশোরগঞ্জের একটা বড় বাজার। এটি পাটের বাজারের জন্য বিখ্যাত। দেখলাম শুধু দোকান আর দোকান। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এসব দোকানে বিক্রি কী রকম? ও বলল, কী বলেন, একদরের দোকানও আছে! কোনো দোকানে বাজারের দিনে ঢোকার ব্যবস্থা নেই। আর এখন তো রোজার মাস, সামনে ঈদ। দোকানে দোকানে শুধু পণ্য আর পণ্য। চারদিক থেকে ট্রাক আসছে, লরি আসছে। ঢাকা থেকে, ভৈরব থেকে, ময়মনসিংহ থেকে পণ্য আসছে। ক্রেতার কোনো অভাব নেই। ঢাকার মতো এখানেও জৌলুসপূর্ণ বাড়ি আছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আছে। এসব শুনি আর শুনি- মাথায় গরিব মানুষের কথা। তাদের অবস্থা কী? তারা কি এই বাজারের অংশীদার? মনে হয় না। তাতে কী, যারা পারে তারা বাজার করবে না কেন? এসব ভাবি আর ভাবি, আর মনে প্রশ্ন জাগে, রোজার ঈদ উপলক্ষে দেশে মোট কত টাকার বিকিকিনি হয়? কেমন হয় অর্থনীতি ও ব্যবসার অবস্থা?
প্রকৃতপক্ষে রোজার ঈদে কত টাকার বেচাকেনা হয় এবং তা কোন কোন খাতে, তার হিসাব করা খুবই কঠিন। আমি তো নস্যি, বড় বড় অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ীও এর হিসাব দিতে পারবেন না। পারবে না কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানও। তবে একটা আলোচনা হতে পারে। রোজার ঈদে সবচেয়ে বেশি কেনাবেচা হয় জামাকাপড়ের। শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিস, প্যান্ট, শার্ট, জুতা, স্যান্ডেল ইত্যাদিই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় এই ঈদে। অলঙ্কার, কসমেটিকস, খাবার জিনিসপত্র ইত্যাদির বেচাকেনাও কম হয় না। এ উপলক্ষে শহরে যেমন বেচাকেনা হয়, তেমনি আজকাল সমানতালে গ্রামেও বেচাকেনা বেড়ে যায়। কী করে এসবের হিসাব করা যায়? আমার কাছে কোনো পদ্ধতি নেই। তবে খবরের কাগজে বাবুরহাটের একটা খবর দেখলাম। এটি ঢাকার কাছে, নরসিংদীর আরও কাছে। পুরনো বিখ্যাত বাজার। শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিস, থান কাপড়, পর্দা ও সোফার অঢেল সরবরাহ এই বাজারে। বস্তুত বাংলাদেশের অন্যতম বড় কাপড়ের বাজার। সারাদেশের লোক, বাজারিরা এখানে আসে প্রতি সপ্তাহে। সপ্তাহের তিন দিন হাট হয়- শুক্র, শনি ও রোববার। এখন অবশ্য তিন দিন নয়, এখন বাজার সাত দিনই। দিন-রাত। এ জায়গাটি এখন বাসে-গাড়িতে ক্রস করা এক অসম্ভব ব্যাপার। এই বাজারে এখন সপ্তাহে কত টাকার পণ্য বিক্রি হয়? কাগজের খবর থেকে বুঝলাম, সপ্তাহে এখন এখানে কমপক্ষে তিন-চার হাজার কোটি টাকার শাড়ি-লুঙ্গি ইত্যাদি বিক্রি হয়। ভাবা যায়?
উত্তরবঙ্গের পাবনার দিকেও আরেকটি শাড়ি-লুঙ্গির বাজার আছে। আমার ধারণা, ওই বাজারের লেনদেন এত বেশি হবে না। তারপরও অনুমান করা যায়, সেখানেও সপ্তাহে হাজার দুয়েক কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। দুই বাজার মিলে সপ্তাহে যদি পাঁচ হাজার কোটি টাকারও কম হয়, তাহলে রোজার মাসে কম করে হলেও হাজার দশেক কোটি টাকার শুধু শাড়ি-লুঙ্গি বিক্রি হয়। কী বিশাল বাণিজ্য ভাবা যায়! বলা দরকার, এই দুটি বাজার গ্রামাঞ্চলের লোকদের জন্য। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটানোর জন্য। শহরবাসীর- ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী নগরীর লোকদের চাহিদা ওই বাজার দুটি মেটায় না। শহুরে মধ্যবিত্তের বাজার চাহিদা ভিন্ন এবং তাদের জামাকাপড় ভিন্ন ধরনের। তাদের ক্রয় তালিকাও ভিন্ন ধরনের। অবশ্যই এগুলো ‘হাই ভ্যালু গুডস’। যদিও এক্ষেত্রে গ্রামবাসীর তুলনায় ক্রেতার সংখ্যা কম, কিন্তু বাজার মূল্যে এদের জন্য ক্রয়-বিক্রয় হবে অনেক অনেক বেশি। কত তা অনুমান করা কঠিন। জামাকাপড়, জুতা, শাড়ি-লুঙ্গি, শার্ট, কসমেটিকস, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, সেলফোন ইত্যাদি ছাড়াও ঈদের বাজারে অন্য অনেক পণ্য আছে। অবশ্যই এই মাসে বিশাল বাণিজ্য হয় ভোগ্যপণ্যের। তেল, সয়াবিন, চিনি, ছোলা, পিঁয়াজ, রসুন, মসলা ইত্যাদির বেচাকেনা এ মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ। এই মাসে সবাই একটু ভালো খেতে চায়, যে পারে না সেও চেষ্টা করে। ধনীরা তো করেই। রোজার মাসে ভোগের মাত্রা অনেক বেশি। সরবরাহ ঠিক রাখা যায় না বলেই কিন্তু জিনিসপত্রের দাম এ মাসে বাড়ে। চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের অনেক ক্ষেত্রেই মিসম্যাচ হয়। আবার রয়েছে দোকানদারদের কারসাজি। এই মাসে ফলের চাহিদা, শাকসবজির চাহিদাও বাড়ে। মাছ-মাংসের চাহিদাও বেশি। অর্থাৎ রোজার মাস ও ঈদ উপলক্ষে কাঁচাবাজার, মাছ-মাংস, দুধ-ডিম, তেল, মরিচ, পিঁয়াজ, রসুন, ছোলা, খেজুর ইত্যাদি ভোগ্যপণ্যের বেচাকেনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয়, এ মাসের বেচাকেনাতেই ব্যবসায়ীরা যা করার তা করে ফেলেন। প্রকৃতপক্ষে বছরের ব্যবসা এ মাসেই হয়। বাকি ১১ মাস দোকানদাররা অল্প-স্বল্প লাভ করে, দোকানের দৈনন্দিন খরচা, কর্মচারীর খরচা তোলে। এটা রোজার মাসে ঈদ উপলক্ষে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক দেখেও বোঝা যায়। শত শত কোটি টাকা এ মাসে উত্তোলন করা হয়। ব্যাংকের আমানত কমে যায়। অনেক ব্যাংক এ সময়ে ‘ক্যাশ’ ঘাটতিতে পড়ে।
ঈদ উপলক্ষে একটা বড় ব্যাপার ঘটে অর্থনীতিতে, ব্যবস্থাতে। প্রচুর ‘ক্যাশ’ যায় গ্রামাঞ্চলে। এমনিতেই আজকাল গ্রামাঞ্চলে অনেক ‘ক্যাশ’ যায়। ব্যাংকিং খাতের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ‘ক্যাশ’ ঢাকায়। ব্যাংক-আমানতেরও তাই। ঢাকায় আগে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফরিদপুরের লোকই ছিল বেশিÑ বিশেষ করে দোকানদার, রিকশাওয়ালা ও চাকরিজীবীদের মধ্যে। এখন এই অবস্থা নেই। ঢাকায় এখন উত্তরবঙ্গের প্রচুর কর্মজীবী ও রিকশাওয়ালা আছে। রিকশাওয়ালা, কাজের বুয়া এখন বৃহত্তর ময়মনসিংহেরও আছে। এটা আগে ছিল না। এ কারণে সারা বছরই গ্রামে ঢাকা থেকে ‘রেমিট্যান্স’ যায়। এর পরিমাণ অনেক। এর ফলও গ্রামে এখন অনুভূত হয়। এখন একজন স্বাস্থ্যবান রিকশাওয়ালাও গ্রামে গিয়ে সুদের ব্যবসা করে। জমি বন্ধক দেয়। গ্রামের চিত্র এভাবে বদলাচ্ছে। ‘রেমিট্যান্স’ বা নগদ টাকা শুধু ঢাকা থেকে নয়, আসছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। এই মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেড়ে যায়। কত এর পরিমাণ? ২০১২-১৩ অর্থবছরের সাত মাসে সারাদেশে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসে ৭০,৭৮৪ কোটি টাকা। সাত মাসের হিসাবের ভিত্তিতে হিসাব করলে মাসে হয় ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এটা সরকারি হিসাবে। আমরা জানি, অবৈধ পথে প্রায় সমপরিমাণ টাকা দেশে আসে। অর্থাৎ মাসে আসে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। যদি এর পরিমাণ কাটছাঁট করে ১৫ হাজার কোটি টাকাও ধরে নিই, তাহলেও ঈদ ও রোজার মাস উপলক্ষে দেশে আসবে আরও বেশি টাকা। কারণ এ মাসে সবাই বাবা-মা, ভাইবোন, চাচা-ভাতিজা, শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য বেশি টাকা দেশে পাঠায়। তাহলে ভাবুন, এই মাসে গ্রামাঞ্চলে কত টাকা ‘ক্যাশ’ হিসাবে প্রবাহিত হয়। অবশ্য এক্ষেত্রে একটা কথা আছে। যে টাকা আসে, তার একটা অংশ যায় ঋণ পরিশোধে। কিছু যায় জমি ক্রয়ে। বাকি টাকা অবশ্যই ভোগে। যেভাবেই যাক না কেন, গ্রামাঞ্চলে রোজার মাসে হাজার হাজার কোটি টাকা ‘ক্যাশ’ প্রবাহিত হয়। তারপর রয়েছে আরেক উৎস। ঈদ উপলক্ষে লাখ লাখ ঢাকাবাসী, মূলত মধ্যবিত্ত ঢাকাবাসী গ্রামমুখী হয়। তারা সাধারণত বছরে একবারই গ্রামে যায়। তারাও প্রচুর ক্যাশের উৎস। এ মাসে পরিবহন ও পর্যটন ব্যবসাও জমজমাট হয়। সব মিলিয়ে এ এক বিশাল বাণিজ্য। সারাদেশের সার্বিক অর্থনীতির একটা বড় ‘ইভেন্টে’ পরিণত হয়েছে রোজার মাস ও ঈদ। এছাড়া রয়েছে ধনাঢ্য ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধিদের দানমূলক কর্মকাণ্ড। রয়েছে সরকারের দান কর্মকাণ্ড। বলা যায়, সারা বছরের লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বেচাকেনা হয় এ মাসেই। অতএব এ ধরনের উৎসব যত বেশি হবে, তত টাকা যাবে গ্রামে।
ড. আর এম দেবনাথ : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম

No comments

Powered by Blogger.