মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জ নেতিবাচক রাজনীতি by মোঃ মাহমুদুর রহমান

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মুদ্রানীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের দ্বারা মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রচেষ্টা চালায়। কম মূল্যস্ফীতি ও অধিক প্রবৃদ্ধি সামষ্টিক অর্থনীতির সুস্বাস্থ্যের পরিচায়ক। বলা হয়ে থাকে, অধিক মূল্যস্ফীতি প্রবৃদ্ধির বেলুনকে ফুটো করে দেয়, লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়ার মতো। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রক হিসেবে এমন ভারসাম্যপূর্ণ অর্থের প্রবাহ নিশ্চিত করতে চায়, যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং একই সঙ্গে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়। এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক তার অভিজ্ঞতা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বর্তমান গতিধারা বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের আশ্রয় নিয়ে থাকে। তবুও অনেক সময় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয় না বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে। এবারের অর্ধবার্ষিক মুদ্রানীতিতে ১৯৯৫-৯৬ সালকে ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ শতাংশ এবং ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরলে তা হবে ৬.০-৬.৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা। অন্যদিকে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬.২০ শতাংশ ধরা হয়েছে, যা বিগত ১০ বছরের গড় প্রবৃদ্ধির হারের সমান। এ দুই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের সীমা যাতে ২৬ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম না করে সে ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছে। সরকারের ঋণসীমার বিষয়ে কঠোরতা প্রদর্শন সব মহলে প্রশংসিত হলেও বেসরকারি খাতে ঋণ সংকোচনের নীতিমালা সমালোচিত হয়েছে। গত বছর ব্যাংকিং সেক্টর থেকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮.৩ শতাংশ, এবার তা ১৫.৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্সসহ অন্যান্য ব্যবসায়ী সংগঠন ও অর্থনীতিবিদরা ঘোষিত মুদ্রানীতির বেসরকারি খাতের ঋণ সংকোচনের নীতিমালার কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এর ফলে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। তাত্ত্বিকভাবে তাদের বক্তব্য সঠিক হলেও বাস্তবতা ঘোষিত মুদ্রানীতিকে সমর্থন করে। বিগত মে মাসে ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৩ শতাংশ, যেখানে মুদ্রানীতিতে তা বাড়িয়ে ডিসেম্বরে ১৫.৫ শতাংশ এবং আগামী জুন-২০১৪ সালে ১৬.৫ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কম হলেও এ বছরের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে ঋণ সংকোচন নয়, বরং বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বর্তমান বছরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজমান থাকায় প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছেন। ফলে চলতি বছরের মে মাসে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৩ শতাংশ ছিল। আগামী ৬ মাসে রাজনৈতিক অবস্থা বিগত দিনের চেয়ে আরও খারাপ হওয়ার আশংকা রয়েছে বিধায় মুদ্রানীতিতে উল্লিখিত লক্ষ্যমাত্রা বেশি যৌক্তিক। প্রকৃত ব্যবসায়ী বা শিল্পোদ্যোক্তারা এ মুহূর্তে রাজনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা এখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে আগ্রহী নন। এখন যদি ব্যাংক অতিরিক্ত ঋণ দিতে যায়, তাহলে তা ভুল মানুষের হাতে পড়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ না হয়ে ভিন্ন খাতে ব্যবহৃত হতে পারে। এতে একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যেমন কষ্টকর হবে, অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদে তা খেলাপি ঋণে পরিণত হওয়ার অতিরিক্ত ঝুঁকি থাকবে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো অবস্থায়ই তার অধীনস্থ ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে পারে না বিধায় ঘোষিত মুদ্রানীতি বেশি যৌক্তিক।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই যৌক্তিকতা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা কি অর্জিত হবে? প্রথমেই বলতে হয়, যে ভিত্তি বছরগুলো হিসাবে নিয়ে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা হয়, তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সাধারণত কোনো স্থিতিশীল অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরা হয়। এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। ১৯৯৫-৯৬ সাল ছিল ওই সময়ের সরকারের শেষ বছর, একইভাবে ২০০৫-০৬ সালও ছিল একটি সরকারের শেষ বছর এবং আমাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী তা দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় অস্থিতিশীলই ছিল। এই মৌলিক দুর্বলতাকে অগ্রাহ্য করলেও বিভিন্ন কারণে ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে। প্রথমত, নির্বাচনের বছর আমাদের দেশে অর্থের প্রবাহ বেশি থাকে। উচ্চবিত্তের হাত থেকে টাকা প্রবাহিত হয় প্রান্তিক আয়ের মানুষের দিকে, যা আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতির একটি নেতিবাচক দিক। প্রান্তিক আয়ের মানুষের সঞ্চয়ের সুযোগ না থাকায় সব টাকাই সাধারণ ভোগ ব্যয়ে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা কোনো অবস্থায়ই সম্ভব হয় না। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়নি।
দ্বিতীয়ত, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী মাসে বিশ্বে কৃষিজ খাদ্যশস্যের বাম্পার ফলনের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্যের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এই পূর্বাভাসও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণকে প্রভাবিত করেছে। ফলে জুন মাসের ৭.৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি থেকে ডিসেম্বরে শতাংশে নামিয়ে আনার চিন্তা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো কিছুর দাম বাড়লে দেশীয় বাজারে এর প্রভাব পড়ে দ্রুততার সঙ্গে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম হ্রাস পেলে সেটা আর দেশীয় বাজারে সমন্বয় করা হয় না বললেই চলে। তাই এই পূর্বাভাস আমাদের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয় না। সরকারি-বেসরকারি খাতে সম্ভাব্য বেতন-ভাতা বৃদ্ধির কারণে চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্তরের ওপর চাপ, হরতাল-অবরোধের কারণে পণ্য সরবরাহে বিঘœজনিত কৃত্রিম মূল্যস্তর বৃদ্ধি এবং আবহাওয়াজনিত কারণে কৃষি উৎপাদনের তারতম্যের বিষয়গুলো মুদ্রানীতি প্রণয়নে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী বছরে টাকার প্রবাহ বিবেচনা না করা এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাম্পার ফলনের ওপর ভরসা করাই হচ্ছে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে বড় দুর্বলতা। তবে সাধারণ মানুষ, যাদের প্রতিদিন বাজারে যেতে হয়, তাদের কাছে মূল্যস্তর নামিয়ে আনার পরিসংখ্যানকে গল্প মনে হয়। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল তারা খুঁজে পায় না। জীবনযাত্রার ব্যয়ের বোঝা দিন দিন তাদের কাছে ভারি মনে হচ্ছে।
আমাদের সংগ্রামী মানুষের নিরলস প্রচেষ্টা প্রবৃদ্ধির হারকে ৬-এর কাছাকাছি রাখতে সহযোগিতা করছে। সরকারি খাতের ভূমিকা এক্ষেত্রে খুবই কম। উল্টো আমাদের নেতিবাচক রাজনীতি বেশিরভাগ সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে। রাজনীতিকদের আচরণ মানুষকে শংকিত করে তুলেছে। বিশেষ করে আগামী নির্বাচন নিয়ে অচলাবস্থা এবং সংঘাতময় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আগাম বার্তা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করতে বাধ্য করেছে। এর ফলেই আজ বৈদেশিক মুদ্রার মাত্রাতিরিক্ত রিজার্ভ। তিন মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে যথেষ্ট, সেখানে বর্তমানে সাড়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধের মতো মজুদ বর্তমান। অব্যবহৃত মুদ্রার মজুদ অর্থনৈতিক স্থবিরতাই নির্দেশ করে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য বিরাজ করছে। কারণ কোনো উদ্যোক্তা এই অনিশ্চয়তার মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। আর বিনিয়োগ না হলে উৎপাদন ব্যাহত হবে, প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা প্রায়ই অতিরিক্ত সুদের কথা বলেন। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি সুদ দিতে হয় ঋণের বিপরীতে। কিন্তু কেন সুদ হার বেশি, তা বলা হয় না। ব্যাংকের ঋণযোগ্য তহবিলের পেছনে ব্যয় যখন বেশি হয়, তখন ঋণের বিপরীতে সুদ বেশি নিতে হয়। সোজা কথা, বেশি দামে জিনিস কিনলে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। আমানত সংগ্রহে অতিরিক্ত সুদ দিতে হয় মূলত অর্থনীতির আকারের চেয়ে বেশি ব্যাংক দেশে ক্রিয়াশীল থাকায় অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে। একই কারণে অন্যান্য পরিচালন ব্যয়ও বেশি হয়। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের কারণে সুদের হার বেশি নির্ধারণ করতে ব্যাংক বাধ্য হয়। আর ঋণ শ্রেণীকৃত হয় বা খেলাপি হয় ব্যাংকের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাধীন বিবেচনাবোধ সরকার ও ক্ষমতাশালীদের অবৈধ প্রভাবে বাধাগ্রস্ত হলে। সাম্প্রতিক হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্র“পের কেলেংকারি বিষয়টিকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। এ অবস্থায় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও কঠিন হবে।
মুদ্রানীতি প্রণয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশ ব্যাংক নির্বাচনী বাজারে টাকার ছড়াছড়ি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে না। দেশে অর্থনীতির আকার অনুযায়ী কয়টি ব্যাংক থাকবে সেটিও তারা ঠিক করে দিতে পারে না। ব্যাংক থেকে ঋণের নামে রাজনৈতিক লুটপাট বন্ধ করার ক্ষমতাও বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমিত। তাই ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে অতিরিক্ত ব্যয় বজায় রেখে ঋণের সুদ হার বিচ্ছিন্নভাবে কমানো বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব হবে না। এ ছাড়া সংঘাতময় রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে স্থিতিশীল অবস্থা ফিরিয়ে এনে বিনিয়োগকারীদের আস্থাশীল করাও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয়। এসব আমাদের রাজনীতিকদের কাজ। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সরকারি নীতি ও নেতিবাচক দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় রাজনীতির কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তা মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
মোঃ মাহমুদুর রহমান : ব্যাংকার

No comments

Powered by Blogger.