নওয়াজ শরিফের জন্য মুখিয়ে থাকা সমস্যাগুলো

রথমবারের মতো একটি নির্বাচিত সরকারের মেয়াদপূর্তি এবং একই ধারাবাহিকতায় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়াটা পাকিস্তানের মতো একটি দেশের জন্য আশা-জাগানিয়া। পাকিস্তান পিপলস পার্টির  (পিপিপি) পরাজয়, নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগের জয়লাভ কিংবা ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির উত্থান গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রথমবারের মতো সরকারের মেয়াদ পূর্ণ করে নিয়মিত বিরতির নির্বাচন হতে পারাটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণতম। তবে কথা হচ্ছে, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাড়ে ছয় দশকের বেশি সময় পরে প্রশংসা করার মতো সাফল্যটি এলেও, এ নিয়ে আদিখ্যেতা করার সময় হাতে থাকছে না নতুন শাসকদের। পাকিস্তানে মূলধারার রাজনীতিকেরা বলতে গেলে এক একটি ‘রত্ন’! ক্ষমতাহারা পিপিপি-প্রধান আসিফ আলী জারিদারির কথা ধরা যাক; সেই কবে থেকে ‘মিস্টার টেন পার্সেন্ট’ নাম নিয়ে বসে আছেন। নতুন করে বিজয়ী নওয়াজ শরিফ? তাঁর অতীত শাসনামলগুলো মনে আছে অনেকের, নিদারুণ দুর্নীতিতে ভরপুর। বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থায় দুর্নীতি অবধারিত নাকি দুর্নীতির কারণেই বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থায় নানা রকমের সংকট দেখা দেওয়া—সব নিয়ে নানামুখী কথাবার্তা আছে। অনেকে মনে করেন, বুর্জোয়া ব্যবস্থা বিকাশের জন্য দুর্নীতিটা লাগে! এসব তর্ক-বিতর্ক সত্ত্বেও এটুকু মানতে হয় যে উচ্চপর্যায়ের নানামুখী দুর্নীতির চোটে উত্তর-ঔপনিবেশিক অনেক রাষ্ট্রের মতো পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাসিন্দাদেরও প্রাণ ওষ্ঠাগত। পিপিপির জায়গায় শরিফের মুসলিম লিগ সরকার আসছে। সন্দেহ নেই, এদের ব্যাপারেও জনগণের মধ্যে পিছলা স্মৃতিগুলো কাজ করবে। জনগণের কাছ থেকে এরা বেশি ভোট পেয়েছে বটে, তার মানে এই নয় যে জনগণ নতুন শাসকদের ব্যাপারে সশ্রদ্ধ। আর এ কারণে শরিফের সরকার শুরু থেকেই একটা আস্থার সংকটের মধ্যে থাকবে বলে মনে হয়। এমন একটা পরিস্থিতি থেকে উত্তরিত হয়ে জনমনে নিজেদের জন্য সম্মাননার বোধ তৈরি করতে পারাটা হবে নতুন সরকারের জন্য সাংঘাতিক এক চ্যালেঞ্জ। এবার আসা যাক, দায়িত্ব নেওয়ার মুহূর্ত থেকে যেসব বাস্তবতা তাড়া করতে থাকবে, সেগুলোর দিকে। প্রথম চ্যালেঞ্জটি হবে ধর্মীয় উগ্রবাদের ব্যাপারে অবস্থান গ্রহণ। ধর্মীয় উগ্রবাদ পাকিস্তানে প্রচণ্ড শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে চলেছে অনেক দিন থেকে; এটাই তার কৌশল। পাকিস্তানি বাস্তবতায় নিজেদের মতো করে একধরনের সেক্যুলার দলগুলোর ওপর এবারের নির্বাচন মৌসুমে তাণ্ডব চালিয়ে তাদের একেবারে কোণঠাসা করে দিয়েছে এরা। পিপিপি, আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট ছিল মূল লক্ষ্য। শরিফরা এসব হামলার বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলেছিলেন বলে জানা যায় না। এখন কী হবে? শরিফের সরকার যদি ভাবে, পিপিপির জায়গায় তারা ক্ষমতায় আসায় ধর্মীয় উগ্রবাদ ঠান্ডা মেরে যাবে, তাহলে ভুল হবে। কেননা একটি ধর্মবাদী পাকিস্তান কায়েম করার জন্যই লড়াইটি চালানো হচ্ছে। পিপিপিকে শায়েস্তা হতে দেখে মজা লাগলেও এবার ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রকোপ নিয়ে সরাসরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে শরিফকে। অবশ্য তলে তলে কিছু থাকলে ভিন্নকথা। সন্ত্রাসবাদী দমনের অজুহাতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রধান সাম্রাজ্যবাদী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলা অব্যাহত আছে। পিপিপির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছিল। ভোটের আগের দিনও শরিফ জানান যে ক্ষমতায় গেলে ড্রোন হামলা করতে দেওয়া হবে না। এত দিন পিপিপিকে গালাগাল করে পার পাওয়া গিয়েছিল। এবার দেখা যাবে মুসলিম লিগ কী করে। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে নিজেকে মার্কিন-মুঠির বাইরে প্রমাণের ক্ষমতা শরিফের দলের আছে কি না, তা কিছুদিনের মধ্যে দেখা যাবে। প্রতিবেশী আফগানিস্তানের সরকারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন হবে আরেকটি শক্ত কাজ। বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকাজুড়ে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের মোকাবিলায় ইসলামাবাদ-কাবুল দৃঢ় সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও বাস্তবতা একেবারে উল্টো। দুই দেশ পরস্পরকে ধর্মীয় উগ্রবাদী চালান দেওয়ার দোষে অভিযুক্ত করে চলেছে। এ ছাড়া ইসলামাবাদ আবার কাবুলের সঙ্গে নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ‘ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া’ ধরে নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। শরিফ সরকারের আমলে পাকিস্তান-আফগান সম্পর্কে নতুন কোনো মাত্রা দেখা যাবে কি? মনে রাখতে হবে, এটা আচমকা শুভেচ্ছা দেখিয়ে ঝটপট কিছু করার বিষয় নয়। পিপিপিকে হঠানোর জন্য শরিফ সাহেব যাঁদের মন রক্ষা করেছেন, তাঁদের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদের সমর্থকেরাও আছেন; আচমকা তাঁদের আশা-ভরসা ভাঙা এত সহজ নয়। আরেকটা কথা হচ্ছে, শরিফের নিজের দলটিও ঠিক লিবারেল নয়। মনে হয়, পাকিস্তান-আফগান সম্পর্ক আগামী দিনগুলোতে তিক্তই থাকবে, যা থেকে লাভবান হতে থাকবে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে কী করবেন নওয়াজ শরিফ? সমস্যা জিইয়ে রাখবেন? ভারতের সঙ্গে প্র্রয়োজনে লড়াই করবেন? ঠিক কোন জায়গায় পিপিপির সঙ্গে পার্থক্যটা দেখাবেন? শরিফ কাশ্মীর নিয়ে ভালো বিপাকে পড়বেন বলেই মনে হয়। ভারতের সঙ্গে সামগ্রিক সম্পর্ক নিয়েও শরিফের পদক্ষেপগুলো হবে দেখার মতো। একদিকে আছে ভোটব্যাংক, যেখানে ভারত-বিরোধিতা অত্যন্ত ফলদায়ী হয়। অন্যদিকে, ভারতের মাটিতে সহিংসতায় মদদ দানসংক্রান্ত নয়াদিল্লির কড়া অভিযোগ। একই প্রসঙ্গে পুরোনো মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের দিক থেকে আসা বেশুমার সমালোচনা-সতর্কতাগুলোও শরিফের ওপর চাপ হিসেবে থাকবে। ভোটব্যাংক বনাম সীমানার ওপার তথা বহির্বিশ্বের চাপ—শরিফের সরকারের কঠিন পরীক্ষা হয়ে যাবে। জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে পাকিস্তান সমস্যায় ভুগছে শুরু থেকে। ১৯৭১ সালে অঙ্গহানি হয়ে যাওয়ার পরেও দেশটি পুরোনো সমস্যা থেকে বের হতে পারেনি। এখনো পাঞ্জাবি আধিপত্য নিয়ে অন্যদের মধ্যে রয়ে গেছে ব্যাপক ক্ষোভ। আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় প্রদেশ বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের রমরমা পাকিস্তানে জাতীয় সংহতির সমস্যার পরিচায়ক। সিন্ধু প্রদেশের ক্ষেত্রেও এ বক্তব্য কিছু মাত্রায় হলেও প্রযোজ্য। নিজস্ব ভোটব্যাংককে ক্ষুব্ধ করে হলেও, তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে পাঞ্জাবের শরিফ অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের মন থেকে পাঞ্জাবি আধিপত্যের ক্ষোভটি নিরাময় করতে কিছু করেন কি না, তার ওপর পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি অনেকটা নির্ভর করবে বলে মনে হয়। তবে সব কথার আসল কথাটি, অর্থাৎ নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক, এবার বলা দরকার। জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত পাকিস্তানে অর্ধেকের বেশি সময় ক্ষমতায় থেকেছে সামরিক বাহিনী। ক্ষমতায় না থাকলেও দোর্দণ্ড প্রতাপসম্পন্ন এই প্রতিষ্ঠান—নির্বাচিত সরকারকে যখন-তখন বকে দেওয়া, হুমকি দেওয়া, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন নিয়ে ওঠবস করানোর ক্ষমতা রাখে এই প্রতিষ্ঠান। কেবল রাজনীতি বা রাষ্ট্রক্ষমতা নয়, দেশের অর্থনীতিতেও প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে সামরিক বাহিনীর লোকজনের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা সুগভীর। আয়েশা সিদ্দিকার মতো গবেষক মিলিটারি ইনক (২০০৭) গবেষণাগ্রন্থে এ কথা হাতেনাতে প্রমাণ করে দিয়েছেন। মনে হয় যে শরিফের ভাগ্য অনেকটাই নির্ভর করবে সিভিল স্বার্থের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর স্বার্থ বা ইচ্ছার ভারসাম্য ঘটানোর ওপর। ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ কর্তৃক ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার কথা কী করে ভুলে থাকবেন নওয়াজ শরিফ? ‘ঘরপোড়া গরু’ হয়ে ‘সিঁদুর দেখে ডরায়’ অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলে আর কোনো কথাই নেই। অবশ্য তা না হলেও, সর্বস্তরের এবং সব অঞ্চলের জনগণের কাছ থেকে তেমন বিপ্লবী ম্যান্ডেট না নিয়ে আসা শরিফ-সরকারের পক্ষে আর কোনো দিকে না তাকিয়ে শুধু জনগণের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া ব্যাপারটি একেবারেই সম্ভব হবে না। এখন খালি দেখার বিষয় টালমাটাল পাকিস্তানে কতটা ভারসাম্য রক্ষা করতে চলতে পারে শরিফ-সরকার। শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগেরশিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.