ভুজপুরে তান্ডব: জামায়াত সমর্থক জনপ্রতিনিধিরাই হামলার পরিকল্পনাকারী by সুজন ঘোষ

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর ইউনিয়নের কাজিরহাট এলাকায় সংঘটিত স্মরণকালের ভয়াবহ নৃশংস তান্ডবের ঘটনার তদন্তে বর্তমান ও সাবেক বেশ কয়েকজন জামায়াত সমর্থক জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততার অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ।
এর মধ্যে ভুজপুরের ইউপি চেয়ারম্যান শফিউল আলম নূরী গ্রেফতার হলেও অপর জনপ্রতিনিধিরা এখনও গ্রেফতার হয়নি। প্রাথমিক তদন্তে কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর থানায় দায়ের হওয়া মামলায় এদের কয়েকজনকে আসামী করা হয়েছে।

এসব জনপ্রতিনিধি ও জামায়াত নেতার ইন্ধনে জামায়াত-শিবির সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিতভাবে ওইদিন আওয়ামী লীগের হরতাল বিরোধী শান্তিপূর্ণ মিছিলে সহিংস হামলা চালায় বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।।

সহিংস এ তান্ডবের নেপথ্যে ছিলেন স্থানীয় জামায়াত সমর্থক জনপ্রতিনিধিরা। তারা হামলার পরিকল্পনার জন্য দফায় দফায় বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে তারা হামলার নীল-নকশা চূড়ান্ত করে। তাদের পরিকল্পনা ও অর্থে এ বর্বর ঘটনা ঘটে।

জামায়াত সমর্থক জনপ্রতিনিধিদের এ পরিকল্পনা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে শিবিরের তিন ক্যাডার এয়াকুব, তৌফিক ও বেলাল। মাঠ পর্যায়ে তাদের নেতৃত্বে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর নৃশংস হামলা চালায়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এলাকাবাসী, প্রত্যক্ষদর্শী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে সহিংস এ হামলার নেপথ্য কারণ খুঁজে বের করতে ভুজপুর থানা পুলিশ ভুজপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শফিউল আলম নূরীসহ জামায়াত-শিবিরের ৪২ জন নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়েছে। এছাড়া বুধবার আরও ১২ জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ডে নেয়া এ ৫৪ জনকে পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

ভুজপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অং সা থোয়াই বাংলানিউজকে জানান, তান্ডবের ঘটনার নেপথ্য কারণ খুঁজে বের করতে আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের হরতাল বিরোধী মিছিলের সিদ্ধান্তটি ছিল পূর্বনির্ধারিত। ওইদিন তারা শিবিরের ডাকা হরতালের বিরুদ্ধে এলাকায় শান্তিপূর্ণ মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সংক্রান্ত সংবাদ গত বুধবার স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আর এ সুযোগ নেয় জামায়াত-শিবির।

গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম অভিযোগ করেন, জামায়াত-শিবির শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলা করার জন্য পবিত্র মসজিদ ও মাদ্রাসাকে ব্যবহার করে স্থানীয় জনতাকে উসকে দেয়।

গত বৃহস্পতিবার ফটিকছড়ি উপজেলায় হরতাল বিরোধী মিছিল-সমাবেশ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। এ মিছিলে নেতৃত্ব দেন গত সংসদ নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম। তিনি মিছিল নিয়ে ভুজপুর ইউনিয়নের কাজিরহাট এলাকায় যাওয়ার আগে কাজিরহাট বড় মাদ্রাসার বড় হুজুরের সঙ্গে কথা বলেন। বড় হুজুর তাকে আশ্বস্ত করলে তিনি মিছিল নিয়ে ওই এলাকায় প্রবেশ করে।

মিছিল শেষে ফেরার পথে হেফাজত, জামায়াত-শিবির মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে এলাকাবাসী ও বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্রদের উত্তেজিত করে ওই মিছিলে হামলা চালায়। এতে স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের তিন নেতাকর্মী নিহত হন এবং অর্ধশতাধিক আহত হন। এসময় প্রায় শতাধিক মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয় তারা।

আওয়ামী লীগ নেতা এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম অভিযোগ করেন, জামায়াত-শিবির পরিকিল্পতভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে তালেবান স্টাইলে শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলা করে। তাদের সঙ্গে নৃশংস এ হামলায় হেফাজতের একটি ক্ষুদ্র গ্রুপ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে কারাবন্দী সাকা চৌধুরীর অনুসারীরা অংশ নেয়।

এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘মসজিদের মাইক থেকে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শফি নূরী ঘোষণা দেয় ‘আমি শফী নূরী বলছি, আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা বড় হুজুরকে হত্যা করেছে এবং বিএনপি নেতা নুরুল আলম আজাদকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। তারা মসজিদ ও মাদ্রাসায় হামলা করেছে। যার  যা আছে তা নিয়ে এসব নাস্তিকদের উপর হামলা কর’। একই ঘোষণা দেয়ে আরেক ক্যাডার বেলাল হোসেন। তারা ক্রমাগত মসজিদের মাইক থেকে এ ঘোষণা দিতে থাকে। মসজিদের মাইক থেকে এ ঘোষণা দিয়ে স্থানীয় জনতাকে নিয়ে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা আমাদের উপর হামলা করে।”

হামলার আগে কাজীর হাটে বৈঠক:

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের মিছিলে হামলা চালাতে আগের দিন বুধবার রাতে কাজীরহাটে জামায়াত ও হেফাজাতে ইসলামের নেতারা গোপন বৈঠকে বসে। এ বৈঠকটির মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা নুর মোহাম্দ আল কাদেরি, সাবেক চেয়ারম্যান ও জামায়াতের আমীর মাওলানা হাবিব আহমেদ, সাবেক চেয়ারম্যান ও ‍বিএনপি নেতা নুরুল আলম আজাদ ও ভুজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিউল আলম নূরী।

বৈঠকটিতে স্থানীয় একটি কওমী মাদ্রাসার কিছু ছাত্র-শিক্ষক ও স্থানীয় পর্যায়ের জামায়াত-শিবিরের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠক থেকে মিছিলে হামলার ছক সাজানো হয়।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, একই দিন রাতে উপজেলার হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের জামায়াত অধ্যুষিত বড়বিল ও কোম্পানি টিলা এলাকায়ও বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকের নেতৃত্বে ছিলেন জামায়াত নেতা ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন চৌধুরী।

এই দুটি বৈঠকে বৃহস্পতিবারের মিছিলে হামলার নীল-নকশা চূড়ান্ত করা হয় বলে জানা গেছে। এসব বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত হয় মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেওয়া হবে, মিছিল নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা মসজিদ ও মাদ্রাসা আক্রমণ করতে আসছে। মুঠোফোনের ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে এ খবর ছড়িয়ে দেয়ারও পরিকল্পনা হয়।

এছাড়া জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের মিছিলে হামলা করার জন্য বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বাজার ও রাস্তার পাশে ইটের টুকরো এবং লাঠির মজুদ করে রাখে।

দু’টি বৈঠকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে করতে ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন অর্থ যোগান দেয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া ভুজপুরের পার্শ্ববর্তী দু’ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও এ হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেপথ্যে সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই দু’চেয়ারম্যান এলাকায় জামায়াত সমর্থক হিসেবে পরিচিত।

কাজিরহাটে হামলার নেপথ্যে কারণ:

আওয়ামী লীগের ওপর হামলার জন্য কাজিরহাট এলাকাকে নির্ধারণ করার পেছনেও সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল।

জানা গেছে, ফটিকছড়ির অন্যান্য এলাকায় কওমী মাদ্রাসা থাকলেও সেসব এলাকায় জামায়াত-শিবিরের তেমন কোনো আধিপত্য নেই। এদিক থেকে কাজীরহাট এলাকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে কওমী মাদ্রাসা যেমন রয়েছে,তেমনি জামায়াত-শিবিরের শক্ত অবস্থান রয়েছে। আবার এ কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সম্পর্ক ভাল।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মসজিদের মাইকে বড় হুজুরকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা এবং মসজিদ-মাদ্রাসায় হামলার গুজব ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় জনতাও হামলায় এগিয়ে আসে। এছাড়া আগে থেকে প্রস্তুত থাকা জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাদের সঙ্গে হেফাজতের অনেকে যোগ দেয়।

পুলিশের বক্তব্য: কাজিরহাটে আওয়ামী লীগের মিছিলে সহিংস তান্ডবের নেপথ্যে এ জনপ্রতিনিধিদের জড়িত থাকার বিষয়ে হাটহাজারী সার্কেলের এএসপি আ ফ ম নিজাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন,‘আমরাও এ ধরণের অভিযোগ শুনেছি। তবে সম্ভাব্য সব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন,‘এ সহিংস হামলা সম্পূর্ণভাবে পূর্বপরিকল্পিত, এ বিষয়ে আমরা শতভাগ নিশ্চিত। পূর্ব পরিকল্পনার মাধ্যমে এ হামলা চালানো হয়েছে।’

হামলার নেতৃত্ব দেন তিন শিবির ক্যাডার:

স্থানীয় জামাযাত-শিবির মিছিলে হামলার পরিকল্পনা করে নেতাকর্মীদের মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে তাদেরকে মসজিদে সংগঠিত করে। পুরো হামলায় নেতৃত্ব দেন তৌফিকুল ইসলাম, বেলাল ও এয়াকুব।

বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ হওয়া ভিডিও ফুটেজে তাদেরকে সামনে থেকে হামলায় অংশ নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। এর মধ্যে তৌফিককে ধারালো অস্ত্র হাতে হামলায় অংশ নিতে দেখা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.