ট্রাইব্যুনাল সংশোধনী বিল পাশঃ জামায়াত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধে কোনো বাঁধা নেই

সংশোধীত আইনে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার ও বাদী-বিবাদীর আপীল করার সুযোগ এবং আপীল নি®পত্তির জন্য ৬০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে এবং সারাদেশে চলমান গনআন্দোলনের মধ্যেই
বহুল আলোচিত আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০১৩ জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে। রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতেই আইনটি পাশ হয়। সংশোধীত আইনে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার ও বাদী-বিবাদীর আপীল করার সুযোগ এবং আপীল নি®পত্তির জন্য ৬০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে ব্যাক্তির বিচারের পাশাপাশি সংগঠনের বিচার করারও বিধান রাখা হয়েছে। এর ফলে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকারের আর কোনো বাঁধা রইলো না। আইন পাশের সঙ্গে সঙ্গে সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে তাদের আনন্দ প্রকাশ করেন। এটাকে তারা তারুণ্যের বিজয় বলেও আখ্যায়িত করেন। রোববার বিকেলে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সংসদীয় কমিটির চূড়ান্ত করা ট্রাইব্যুনাল সংশোধনী বিলের প্রতিবেদন সংসদে উত্থাপন করার পর ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ব্যাক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচারের বিধান যুক্ত করার জন্য সংশোধনী প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধ শুধুমাত্র কোনো ব্যাক্তির বিষয় নয়। একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিকভাবে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো। যার দায় তারা এখনো স্বীকার করেনি।
তিনি বলেন, শুধুমাত্র ব্যাক্তির বিষয়টি অর্ন্তভূক্ত থাকলে নানা অজুহাতে তারা পার পেয়ে যেতে পারে। তাই সংগঠনের বিচারের বিষয়টি অর্ন্তভূক্ত থাকতে হবে। এসময় আইনমন্ত্রী জানান, সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা যায়। এরপর স্পিকার অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ সংশোধনী প্রস্তাবটি সংসদে উত্থাপন করলে উপস্থিত সদস্যরা কন্ঠভোটে তাদের সম্মতি প্রকাশ করেন।
সংশোধীত আইনে অপর্যাপ্ত শাস্তি বা খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করার বিধান রাখা হয়েছে। বর্তমান আইন অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামিপক্ষ বা দন্ডপ্রাপ্তরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারলেও আসামি যে অভিযোগ থেকে খালাস পাবেন, কেবল ওই খালাসের রায়ের বিরুদ্ধেই সরকার আপিল করতে পারে। আইনটি সংশোধন হলে পুরো রায়ের বিরুদ্ধেই আপিল করা যাবে। এছাড়া বিদ্যমান আইনে আপিল নিষ্পত্তির কোনো সময়সীমা ছিল না। সংশোধনীতে আপিল নিষ্পত্তির জন্য ৬০ দিন সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। বিলে রায়ের ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করার বিধান রাখা হয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায়ের পর এ বিধানটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ঢাকার আলুব্দী গ্রামে ৩৪৪ জন মানুষকে হত্যার অভিযোগসহ পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এরমধ্যে তাকে দুইটি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদন্ড দেয়া হয়।
এই রায়ের পরপরই প্রতিবাদে ফেটে পড়ে গোটা দেশ। কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে রায়ের দিন (৫ ফেব্রুয়ারি) বিকাল থেকেই আন্দোলনে নামে তরুন প্রজš§। টানা ১৪ দিন ধরে চলা গণআন্দোলনে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাবি করছে দেশবাসী। মূলত এসব দাবির পরই আইনটি নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করে সরকার। পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমান আইনে শুধু যে অভিযোগ থেকে কাদের মোল্লা খালাস পেয়েছেন, একমাত্র তার বিরুদ্ধেই আপিল করতে পারবে সরকার। এরপরই সরকার ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়।
গত সোমবার আর্ন্তজাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধন) অ্যাক্ট, ২০১৩ নামে বিলটি মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন পায়। এরপর গত বুধবার বিকেলে মানবতাবিরোধী অপরাধের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার বা সংক্ষুব্ধ যেকোনো ব্যক্তির আপিল করার বিধান এবং আপিল করার ক্ষেত্রে বাদী-বিবাদীর সমান সুযোগের বিধান রেখে বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। উত্থাপনের দেড় ঘন্টার মাথায় ওইদিন রাতেই বিশেষ বৈঠকে বসে সংক্ষুব্ধ ব্যাক্তির আপিলের বিষয়টি বাদ দিয়ে বিলটি অনুমোদন দেয় সংসদীয় কমিটি। রোববার বিলটি পাশের জন্য সংসদে উত্থাপন করা হবে।
সংশোধীত আইন সম্পর্কে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিককে আইনের সমান আশ্রয় লাভের যে অধিকার প্রদান করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়েরের ক্ষেত্রে এই বিধান প্রতিফলিত হয়নি। ট্রাইব্যুনালের বিচারের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আইনের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের দেয়া খালাস আদেশ বা দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে সরকার ও দন্ডিত ব্যক্তির আপিল দায়েরের সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তি দ্রুত বিচার লাভের অধিকারী। এর প্রতিফলনে আপিল নিষ্পত্তির মেয়াদ নির্দিষ্ট করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিলটি আইনে পরিণত হলে যুদ্ধাপরাধসহ মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারকে দন্ডিত ব্যক্তি কর্তৃক আপিল দায়েরের সমান সুযোগ অর্জনের অধিকারসহ সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপিল মামলা নিষ্পত্তি হবে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের বিচারের কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালের আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনেই এই বিচার শুরু হয়। এই আইনে আসামিপক্ষের আপিলের বিধান থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের কোনো সুযোগ ছিলোনা। পরবর্তীতে  ২০০৯ সালের ৯ জুলাই আইনটিতে সংশোধনী এনে কেবল খালাসের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ সংযোজন করা হয়। ২০১২ সালেও আইনটিতে আরেক দফা সংশোধনী আনা হয়। ২০১২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফা সংশোধনীতে আপিলের সময়সীমা ৬০ দিন থেকে কমিয়ে ৩০ দিন করা হয়। আসামির অনুপস্থিতিতে বিচারের বিধানও সংযুক্ত করা হয়। এক ট্রাইব্যুনাল থেকে আরেক ট্রাইব্যুনালে মামলা স্থানান্তরের ব্যবস্থাও করা হয় এই সংশোধনীতে। এ ছাড়া যে দিন রায় হবে, সে দিনই রায়ের সত্যায়িত কপি উভয় পক্ষকে বিনামূল্যে দেয়ার বিধান করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.