বৃক্ষরোপণের গাড়ি, স্যার দাদুর প্রকৃতি রক্ষার মমত্ব-বগুড়ার স্যার দাদু by সমুদ্র হক

গাছের চারা বয়ে নিয়ে যাওয়া গাড়িটি দেখলেই মনে পড়ে ‘স্যার দাদুর’ কথা। সেই ৪০’র দশকের শুরুতে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে বগুড়ায় এসে বিশ্ব প্রকৃতি রক্ষার মমতার ঘর বেঁধেছিলেন গাছের সঙ্গে। স্যার দাদুর সেই দর্শনকে ছড়িয়ে দিতে মাঠে নেমেছেন বগুড়ার সমাজসেবী আইনুল হক সোহেল।


শহরে ও গ্রামের পথের দু’ ধারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও যে কোন জায়গায় নিজে উদ্যোগী হয়ে বৃক্ষরোপণ করছেন। কোন এলাকার যে কেউ গাছ রোপণের আহ্বান জানালে সেখানেই সোহেলের মিনি ট্রাকে চারা গাছ ও পানির ট্যাঙ্ক নিয়ে সেখানে যায়। চারা রোপণের পর পানি ছিটিয়ে দিয়ে কিছুটা সময় থেকে কিভাবে পরিচর্যা করতে হয় তা শিখিয়ে দেন চালক আব্দুস সোবহান ও সহযোগী আব্দুল জলিল। বৃক্ষরোপণের যাবতীয় ব্যয় বহন করেন সোহেল। কাউকেই নিজ অর্থ ব্যয় করতে হয় না। চারা ও পানি বহনকারী গাড়ির গায়ে লেখা আছে “সবুজ সৃষ্টিতে বৃক্ষরোপণ, ছায়া শীতল পৃথিবীর স্বপন।
সোহেলের এই প্রকল্পের নাম ‘অধ্যাপক ফখরুদ্দীন সবুজ সৃষ্টি প্রকল্প। মানবতাবাদী সাধক ও দার্শনিক ফখরুদ্দীন আহমেদই হলেন সোহেলের সেই ‘স্যার দাদু।’ অপার শ্রদ্ধা ও ভালবাসার এই ডাক বর্তমান প্রজন্মের মুখেও ফেরে। যারা তাঁর কথা শুনেছেন পূর্বসূরীর কাছ থেকে। সোহেলের ইচ্ছা বংশ পরম্পরায় যেন বেঁচে থাকে নীরবে নিভৃতে থাকা মহান এক দার্শনিকের নাম। সেই লক্ষ্যেই গত বছর গড়ে তুলেছেন প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপণের এমন ব্যতিক্রমী এক ধারা। সোহেল জানালেন মূলত স্যার দাদুর বৃক্ষ রোপণের সবুজের স্পর্শ সৃষ্টির ধারাবাহিকতায় এই যাত্রার শুরু। যারা আজ মধ্য বয়সী অধ্যাপক ফখরুদ্দীনের নাম মনে পড়লেই স্মৃতিতে ভেসে আসে বগুড়া সরকারী আযিযুল হক কলেজের সেই অধ্যাপককে যিনি বৃষ্টি শুরু হলেই মাথায় মাতুল এঁটে লুঙ্গি পরে হাতে খুরপি নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই মাটি আলগে চারা গাছ রোপণ করতেন। প্রবীণরা বলেন, বগুড়া শহর ও আশপাশের এমন কোন এলাকা নেই যেখানে ফখরুদ্দীন সাহেবের রোপণ করা গাছ নেই। তিনি গাছের সামনে দাঁড়িয়ে বিরবির করে কথা বলতেন। গাছের চারধারে হাত বুলিয়ে দিতেন। লোকজন বলতেন, ‘প্রফেসর সাহেব গাছের সঙ্গে কথা বলেন।’ ফখরুদ্দীন আহমেদ ১৯৩৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবীতে মাস্টার্স করে গোল্ড মেডেল পান। এরপর ইংরেজীতেও মাস্টার্স করে পুরস্কার পান। ঢাকার কেরানীগঞ্জের বারোঘরটোলায় তাঁর বাড়ি। পরিবারের ইচ্ছ ছিল মেধাবী ছেলে আইসিএস (তৎকালীন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) করে আমলা হবে। ফখরুদ্দীন আহমেদের ইচ্ছা শিক্ষক হবেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আযিযুল হক প্রস্তাব দেন তাঁর নামে স্থাপিত বগুড়া আযিযুল হক কলেজে যোগদান করতে। তখন ওই কলেজের অধ্যক্ষ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর ছাত্র ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমেদ। একবাক্যে রাজি হয়ে চলে এলেন বগুড়ায়। এ কথা জানালেন তাঁর ভাইপো সারোয়ার হোসেন। তারপর মহান এই দার্শনিকের লুকানো বিষয়গুলো উদ্ভাসিত হতে থাকে তাঁর কর্মে। ড. শহীদুল্লাহ তা অনুভব করতে পেরে প্রকাশের সূযোগ করে দেন। রসায়ন পদার্থ অঙ্ক ইতিহাস ভূগোল ইংরেজী বাংলা আরবীসহ সকল বিষয়ের ক্লাস নিতে থাকেন তিনি। ক্লাসের পর কলেজের মাঠের চারধারে প্রতিটি জায়গায় গাছ রোপণ করেন। বনায়ন করেন কলেজের পেছনের জায়গায়। নাম হয় বোটানিক্যাল গার্ডেন। বগুড়া শহর ও শহরতলি এবং কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের গ্রামের প্রতিটি প্রান্তে যত গাছগাছালি চোখে পড়ে তার বেশিরভাগই ফখরুদ্দীন আহমেদের রোপিত। ইতোমধ্যে অনেক গাছ কাটাও হয়েছে। তাঁর সান্নিধ্যে থাকা পৌরসভার কাউন্সিলর নুরুল ইসলাম বললেন, এলাকার লোক যখন জঙ্গল কাটছিল তখন তিনি বাধা দিয়ে বলতেন প্রকৃতিকে মেরে ফেলো না। বৃক্ষই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখবে। তাঁর কথা আজ বিশ্বব্যাপী ধ্বনীত হচ্ছে। নুরুল ইসলাম বললেন, কি স্পিরিচুয়াল পাওয়ার ছিল ফখরুদ্দীন সাহেবের, যা অনেকেই টের পেতেন। মানবতাবাদী এই সাধকের কাছে সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল। ‘সেকিউলারিজম’ বলতে যা বোঝায় তা লালন করতেন ফখরুদ্দীন আহমেদ। বগুড়া শহরের সুলতানগঞ্জপাড়ায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন চিরকুমার হয়ে। ১৯৯৫ সালের ১১ নবেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পর এলাকার অনেকেই তাঁর ধারা রক্ষার চেষ্টা করেছেন। তবে সফলভাবে এগিয়ে এসেছেন দীর্ঘদিন সান্নিধ্যে থাকা আইনুল হক সোহেল। তিনি জানালেন, স্যার দাদুর বৃক্ষ রোপণের দীক্ষায় আজীবন বৃক্ষরোপণ করবেন। জেলার যেখানেই কেউ গাছ রোপণের জন্য ডাকবে সেখানেই যাবেন। গত প্রায় এক বছরে তিন হাজারেরও বেশি গাছ রোপণ করেছেন। আম জাম কাঠাল লিচু বেলসহ ফলদ গাছ, দেবদারু অর্জুন নিম মেহেগিনিসহ ঔষধি গাছ রোপণ করা হচ্ছে। বেশিরভাগ গাছ কলম চারা, যাতে দ্রুত ফল ধরে। মহাস্থানের সবুজ নার্সারি ও বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (আরডিএ) নার্সারি থেকে বেশিরভাগ চারা সংগ্রহ করা হয়। রোপণের পর তা ফলোআপ করা হয়। আব্দুল জলিল বললেন, গাছ বড় না হওয়া পর্যন্ত মোবাইল ফোনে খোঁজ খবর নেয়া হয়। মাসে দুই বার প্রতিটি স্থানে গিয়ে রোপিত গাছ দেখা হয়। এ পর্যন্ত রোপিত নব্বই ভাগই টিকে আছে ভালভাবে। উদ্যোক্তা বাংলাদেশ ফাউন্ড্রি ওনার্স এ্যাসেসিয়শেনের (ফোয়াব) সভাপতি আইনুল হক সোহেল জানালেন, স্যার দাদু প্রকৃতি রক্ষার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়নের এই ক্ষুদ্র ধারাকে আরও বড় পরিসরে এগিয়ে নিয়ে যাবেন যাতে চির অম্লান থাকেন তিনি। সোহেলের এই কর্মকান্ডে তরুণরাও অনুপ্রাণিত হয়ে স্যার দাদুর ধারাকেই অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.